হুসাইন আহমদ
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াকু বামপন্থী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই জয়ের মাধ্যমে যেমন দ্বীপ দেশটির জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বজুড়েই আশাবাদ জাগিয়েছে। গত সোমবার প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার পর ৭০ বছরের সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে ডুবন্ত শ্রীলঙ্কাকে টেনে তোলার অঙ্গীকার করেছেন দিসানায়েকে। কিন্তু সেটা কি তিনি পারবেন? বলতে গেলে পর্বতের মতো চ্যালেঞ্জের বিশাল স্তূপ ঠেলে সরিয়ে ফেলার কাজ তাঁর সামনে।
তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাহস ও উদ্যমের যেকোনো কমতি নেই, তার জোরালো প্রমাণ দিয়ে ফেলেছেন ৫৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ। জনতুষ্টিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের মতো ফাঁপা আশাবাদের কথা জনগণকে তিনি একেবারেই শোনাতে চান না। স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছেন, আলাদিনের চেরাগ তাঁর হাতে নেই যে ক্ষমতা নিয়েই চোখের পলকে শ্রীলঙ্কাকে পাল্টে দেবেন। সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে সম্পর্কে যে সম্যক ও গভীর উপলব্ধির পরিচয়ও দিয়েছেন তিনি।
শপথ গ্রহণের পর দেওয়া ভাষণে পরিবর্তনের জন্য ‘নতুন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার’ ওপর জোর দিয়ে অনুরা দিসানায়েকে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, আমি কোনো জাদুকর নই। আমি একজন সাধারণ নাগরিক। কিছু বিষয় আমি জানি এবং জানি না।’ তিনি বলেন, ‘আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো—যাদের জ্ঞান ও দক্ষতা আছে তাদের একত্রিত করে এই দেশকে উন্নত করা।’
‘ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার কোয়ালিশন’ নামে জোটের প্রধান হিসেবে শনিবারের নির্বাচনে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) বা গণমুক্তি ফ্রন্টের এই নেতা। বিরোধী দলের নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেসহ ৩৮ প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় অভিযুক্ত কায়েমি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে লাখ লাখ শ্রীলঙ্কানের মন জয় করেন।
পরিবারতন্ত্রের খপ্পরে থাকা শ্রীলঙ্কায় দিসানায়েকেকে ক্ষমতা বলয়ের বাইরের লোকই বলা চলে। সেই বিবেচনায় বহিরাগত হয়েও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, যা দ্বীপ দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন।
১৯৯৭ সালে সালে জেভিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার আগে একেডি নামে পরিচিত দিসানায়েকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেন। পরে তিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান; প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকে কুমারাতুঙ্গার সরকারে মন্ত্রীও হন। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। সেই বিবেচনায় দিসানায়েকের এবারের উত্থান একেবারেই সবিশেষ।
এর পেছনে শ্রীলঙ্কার তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও গণবিক্ষোভে সরকারের পতনের প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। খাদ্য, ওষুধ, রান্নার গ্যাস ও জ্বালানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম সংকটের কারণে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষে দেশ ছেড়ে পালান এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বীপ দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর এবং জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ওপর চেপে বসা দেউলিয়া রাজনৈতিক রাজবংশগুলিকে উপড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই রাজনীতির মাঠ দখলে নিতে সফল হন দিসানায়েকে ও তাঁর দল।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক অমির্থনায়াগাম নিক্সনের মতে, সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সচেষ্ট হলেও জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। দুর্নীতি ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া রাজাপাক্ষে গোত্রের একজন হিসেবেই তাঁকে দেখা হয়। সে কারণে ক্ষমতা থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করে নতুন মুখ বসানোর সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে জনগণ।
কিন্তু এমন সংকটময় সময়ে একেবারে আনকোড়া একজন প্রেসিডেন্ট কতটুকু সফল হবেন তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। দিসানায়েকের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল—অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য আইএমএফের সঙ্গে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল, তার শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা এবং কর হার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলেও সামনে তাঁর আরও অনেক সমস্যা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ অর্থাৎ বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান দিসানায়েকে কীভাবে করবের তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তার দল জেভিপিকে ঐতিহাসিকভাবে তামিল স্বার্থের বিরোধিতাকারী হিসেবে দেখা হয়। এই কারণে তামিল ও মুসলিমপ্রধান শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিতে তাঁর পক্ষে কম ভোট পড়েছে।
থামিলান সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক শিভা রামাসামি বলেন, দিসানায়েকের দল ‘তামিলবিরোধী কর্মকাণ্ডে’ লিপ্ত। এই সাংবাদিক দাবি করেন, এককালে একসঙ্গে থাকা উত্তর ও পূর্বের প্রদেশগুলোকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে জেভিপি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
শ্রীলঙ্কার তামিলদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মানুষের সঙ্গে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সম্পর্ক আছে। সিংহলি জাতিগোষ্ঠী দেশটির জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। কয়েক দশক ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের সঙ্গে তামিলদের গৃহযুদ্ধ চলে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্যাপক রক্তক্ষয়ী এই গৃহযুদ্ধে প্রায় লাখখানেক মানুষ প্রাণ হারান।
সেই গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে এই জনগোষ্ঠী। অনেক শ্রীলঙ্কান তামিল উত্তর ও পূর্বের ক্ষমতা হস্তান্তর চান, একই সঙ্গে গৃহযুদ্ধ–পরবর্তী পুনর্মিলনও সমর্থন করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক রামাসামি বলেন, ‘জেভিপি কখনোই তামিলদের সহায়তা করেনি। সেই দলের নেতা দিসানায়েকে কীভাবে সমস্যাটির সমাধান করবেন, তা স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো—তামিল সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নের জন্য আনা শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তাঁরা বাস্তবায়ন করতে ইচ্ছুক কি না।’ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে দীর্ঘদিনের চাপের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তবে এটা সম্ভব হবে বলে মনে করেন না রামাসামি। তাঁর বিশ্বাস, বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদই দিসানায়েকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
দিসানায়েকের সামনে আরেকটি বড় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো দুই প্রভাবশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক। একটি প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে— ভারত না চীন, কার দিকে ঝুঁকবেন দিসানায়েকে?
ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত এরই মধ্যে জয়ের জন্য দিসানায়েকেকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আর চীনের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিংয়ের বলেছেন, ‘ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে’ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি উন্মুখ।
বিশ্বমঞ্চে বেশ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন দিসানায়েক। চীন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দিসানায়েকে ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম (এলটিটিই) ও শ্রীলঙ্কান বাহিনীর মধ্যে গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের তদন্তেরও বিরোধী ছিলেন তিনি।
শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও দেশের স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে বর্ণনা করে নির্বাচিত হলে সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে শত্রুতার প্রভাব মোকাবিলার মতো জোর এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার নেই। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফ সহায়তা দিলেও এই দ্বীপ দেশকে বাঁচাতে ভারতই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী দেশটি ৪০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।
সুতরাং, ভূরাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে তাঁকে অবশ্যই দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ টেনে অর্থনীতির মন্দা দূর করার লক্ষ্য অর্জনেও কোনো দেশই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু খুবই কঠিন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল না ব্যর্থ হবেন, সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াকু বামপন্থী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর এই জয়ের মাধ্যমে যেমন দ্বীপ দেশটির জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বজুড়েই আশাবাদ জাগিয়েছে। গত সোমবার প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার পর ৭০ বছরের সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে ডুবন্ত শ্রীলঙ্কাকে টেনে তোলার অঙ্গীকার করেছেন দিসানায়েকে। কিন্তু সেটা কি তিনি পারবেন? বলতে গেলে পর্বতের মতো চ্যালেঞ্জের বিশাল স্তূপ ঠেলে সরিয়ে ফেলার কাজ তাঁর সামনে।
তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাহস ও উদ্যমের যেকোনো কমতি নেই, তার জোরালো প্রমাণ দিয়ে ফেলেছেন ৫৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ। জনতুষ্টিবাদী রাজনৈতিক নেতাদের মতো ফাঁপা আশাবাদের কথা জনগণকে তিনি একেবারেই শোনাতে চান না। স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছেন, আলাদিনের চেরাগ তাঁর হাতে নেই যে ক্ষমতা নিয়েই চোখের পলকে শ্রীলঙ্কাকে পাল্টে দেবেন। সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে সম্পর্কে যে সম্যক ও গভীর উপলব্ধির পরিচয়ও দিয়েছেন তিনি।
শপথ গ্রহণের পর দেওয়া ভাষণে পরিবর্তনের জন্য ‘নতুন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার’ ওপর জোর দিয়ে অনুরা দিসানায়েকে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, আমি কোনো জাদুকর নই। আমি একজন সাধারণ নাগরিক। কিছু বিষয় আমি জানি এবং জানি না।’ তিনি বলেন, ‘আমার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হলো—যাদের জ্ঞান ও দক্ষতা আছে তাদের একত্রিত করে এই দেশকে উন্নত করা।’
‘ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার কোয়ালিশন’ নামে জোটের প্রধান হিসেবে শনিবারের নির্বাচনে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) বা গণমুক্তি ফ্রন্টের এই নেতা। বিরোধী দলের নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেসহ ৩৮ প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় অভিযুক্ত কায়েমি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে লাখ লাখ শ্রীলঙ্কানের মন জয় করেন।
পরিবারতন্ত্রের খপ্পরে থাকা শ্রীলঙ্কায় দিসানায়েকেকে ক্ষমতা বলয়ের বাইরের লোকই বলা চলে। সেই বিবেচনায় বহিরাগত হয়েও শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি, যা দ্বীপ দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন।
১৯৯৭ সালে সালে জেভিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার আগে একেডি নামে পরিচিত দিসানায়েকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেন। পরে তিনি নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান; প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা বন্দরনায়েকে কুমারাতুঙ্গার সরকারে মন্ত্রীও হন। ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন তিনি। সেই বিবেচনায় দিসানায়েকের এবারের উত্থান একেবারেই সবিশেষ।
এর পেছনে শ্রীলঙ্কার তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও গণবিক্ষোভে সরকারের পতনের প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। খাদ্য, ওষুধ, রান্নার গ্যাস ও জ্বালানির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চরম সংকটের কারণে ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রচণ্ড গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষে দেশ ছেড়ে পালান এবং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বীপ দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর এবং জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ওপর চেপে বসা দেউলিয়া রাজনৈতিক রাজবংশগুলিকে উপড়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই রাজনীতির মাঠ দখলে নিতে সফল হন দিসানায়েকে ও তাঁর দল।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক অমির্থনায়াগাম নিক্সনের মতে, সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সচেষ্ট হলেও জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। দুর্নীতি ও পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি চাপিয়ে দেওয়া রাজাপাক্ষে গোত্রের একজন হিসেবেই তাঁকে দেখা হয়। সে কারণে ক্ষমতা থেকে তাঁদের উচ্ছেদ করে নতুন মুখ বসানোর সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে জনগণ।
কিন্তু এমন সংকটময় সময়ে একেবারে আনকোড়া একজন প্রেসিডেন্ট কতটুকু সফল হবেন তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। দিসানায়েকের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল—অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য আইএমএফের সঙ্গে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল, তার শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা এবং কর হার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলেও সামনে তাঁর আরও অনেক সমস্যা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো— শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ অর্থাৎ বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সমস্যার সমাধান দিসানায়েকে কীভাবে করবের তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তার দল জেভিপিকে ঐতিহাসিকভাবে তামিল স্বার্থের বিরোধিতাকারী হিসেবে দেখা হয়। এই কারণে তামিল ও মুসলিমপ্রধান শ্রীলঙ্কার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলিতে তাঁর পক্ষে কম ভোট পড়েছে।
থামিলান সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক শিভা রামাসামি বলেন, দিসানায়েকের দল ‘তামিলবিরোধী কর্মকাণ্ডে’ লিপ্ত। এই সাংবাদিক দাবি করেন, এককালে একসঙ্গে থাকা উত্তর ও পূর্বের প্রদেশগুলোকে বিভক্ত করার ক্ষেত্রে জেভিপি মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
শ্রীলঙ্কার তামিলদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মানুষের সঙ্গে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সম্পর্ক আছে। সিংহলি জাতিগোষ্ঠী দেশটির জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। কয়েক দশক ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের সঙ্গে তামিলদের গৃহযুদ্ধ চলে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ব্যাপক রক্তক্ষয়ী এই গৃহযুদ্ধে প্রায় লাখখানেক মানুষ প্রাণ হারান।
সেই গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে এই জনগোষ্ঠী। অনেক শ্রীলঙ্কান তামিল উত্তর ও পূর্বের ক্ষমতা হস্তান্তর চান, একই সঙ্গে গৃহযুদ্ধ–পরবর্তী পুনর্মিলনও সমর্থন করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক রামাসামি বলেন, ‘জেভিপি কখনোই তামিলদের সহায়তা করেনি। সেই দলের নেতা দিসানায়েকে কীভাবে সমস্যাটির সমাধান করবেন, তা স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো—তামিল সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়নের জন্য আনা শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তাঁরা বাস্তবায়ন করতে ইচ্ছুক কি না।’ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এবিষয়ে দীর্ঘদিনের চাপের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
তবে এটা সম্ভব হবে বলে মনে করেন না রামাসামি। তাঁর বিশ্বাস, বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদই দিসানায়েকের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
দিসানায়েকের সামনে আরেকটি বড় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো দুই প্রভাবশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক। একটি প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে— ভারত না চীন, কার দিকে ঝুঁকবেন দিসানায়েকে?
ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারত এরই মধ্যে জয়ের জন্য দিসানায়েকেকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আর চীনের রাষ্ট্রপতি সি চিন পিংয়ের বলেছেন, ‘ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে’ সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তিনি উন্মুখ।
বিশ্বমঞ্চে বেশ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন দিসানায়েক। চীন ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দিসানায়েকে ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলম (এলটিটিই) ও শ্রীলঙ্কান বাহিনীর মধ্যে গৃহযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের তদন্তেরও বিরোধী ছিলেন তিনি।
শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় ব্যবসায়ী গৌতম আদানির ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত ও দেশের স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে বর্ণনা করে নির্বাচিত হলে সেটি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভারতের সঙ্গে শত্রুতার প্রভাব মোকাবিলার মতো জোর এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার নেই। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আইএমএফ সহায়তা দিলেও এই দ্বীপ দেশকে বাঁচাতে ভারতই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রতিবেশী দেশটি ৪০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।
সুতরাং, ভূরাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে তাঁকে অবশ্যই দুই আঞ্চলিক পরাশক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ টেনে অর্থনীতির মন্দা দূর করার লক্ষ্য অর্জনেও কোনো দেশই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু খুবই কঠিন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা সফল না ব্যর্থ হবেন, সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক:
সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
১ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৪ দিন আগেনবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন ডিপার্টমেন্ট অব গর্ভমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা সরকারি কার্যকারী বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন ধনকুবের ইলন মাস্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প জানিয়েছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থা পুনর্গ
৭ দিন আগেপরিশেষে বলা যায়, হাসিনার চীনা ধাঁচের স্বৈরশাসক শাসিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যর্থ হয় একাধিক কারণে। তাঁর বৈষম্যমূলক এবং এলিটপন্থী বাঙালি-আওয়ামী আদর্শ জনসাধারণ গ্রহণ করেনি, যা চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গণমুখী আদর্শের বিপরীত। ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর শাসনকে দুর্বল করে দেয়, পাশাপাশি
১২ দিন আগে