রিয়াদ আল ফেরদৌস
ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।
ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যক উপনিষদ শ্রুতি সাহিত্যের ভেলায় মহাকালের স্রোতে ভেসে এসেছে বাঙ্গালা (আজকের বাঙলা) শব্দটি। এই বোধটি এই ভূগোলের মানুষের স্নায়ু ও করোটিতে প্রাণ সঞ্জীবনী যুগিয়ে যাচ্ছে। এখানে ঔপনিবেশিক যুগে শাসক ও শোষিতের মধ্যে সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছিল কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনকে কেন্দ্র করে। এই জনপদের মানচিত্র বহিঃশক্তির হাতে বারবার লুণ্ঠিত হতে হতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আত্মপরিচয়ের জায়গা থেকে। পরিণত হয়েছে অসহায় পরিস্থিতির শিকারে, হারিয়েছে ভাতের অধিকার। তাই বারবার সংগ্রাম করেছে প্রভুত্ববাদী ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
বহুতলীয় ওই ইতিহাস-সংস্কৃতি চর্চার পথে ষাণ্মাসিক গবেষণা কাগজ ‘মনন রেখা’ দৃষ্টান্তস্থানীয়। এর প্রতিটি সংখ্যাই অচর্চিত, ভিন্নতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। ফলে ইতিমধ্যে মনন রেখা দেশে ও দেশের বাইরে পাঠকেদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। মনন রেখার চলতি সংখ্যাটিও বরাবরের মতো সমৃদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ। ‘নূরলদীন ও রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ নামের এই সংখ্যাটি বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, কৃষক বিদ্রোহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে যখন কোনো সাহিত্যের কাগজ মনোযোগী হয় তখন তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। সংখ্যাটিতে দেখা যায়, ঐতিহাসিক রংপুর কৃষক বিদ্রোহকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের নানা আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে। কাজটি বহু শ্রমলব্ধ—বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা নিঃসন্দেহে টেকসই চিন্তাচর্চার লক্ষণ। নূরলদীনকে নির্দিষ্ট এলাকার যোদ্ধা না ভেবে বরং শতাব্দীর ক্যানভাসে বাঙালির স্বাধীনচেতা বীরত্বের প্রতীক বলা সমীচীন।
সংখ্যাটির প্রচ্ছদে দেখা যায়, বাঙলার দুই শোণিত পেশিবহুল কৃষক সশস্ত্র প্রতিরোধে ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি। চিত্রটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, একটি অসম শক্তি ও সামর্থ্য ভুলে, বিজয়ের আশা ক্ষীণ জেনেও প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তুলছে। বিশেষ নিবন্ধে অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস নূরলদীনের তালাশ করেছেন কৃষি উৎপাদন ও ভূমি অধিকারের অনিবার্যতায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার কৃষি উৎপাদনকে জবরদস্তির ফরমান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন ও নির্যাতন করে। দেশীয় সামন্তদের তাঁরা ব্যবহার করেছিল দস্তানা হিসেবে যার স্বরূপ আমরা দেখি রায়ত বনাম দেবী সিংহ দ্বন্দ্ব কীভাবে কৃষক চৈতন্যে বিদ্রোহের একটি শক্ত উপাদান হয়ে উঠেছিল। হেস্টিংসের একান্ত সুহৃদ দেবী সিংহের অবর্ণনীয় শোষণ ও অত্যাচার রংপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম অনুঘটক।
ইংরেজ তথা দেবী সিংয়ের চাপিয়ে দেওয়া অতিরিক্ত করের বোঝায় বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। এমনকি জমিদারেরাও জমি হারাচ্ছিল আর দেবী সিংহ নামমাত্র মূল্যে কিনে নিচ্ছিল সেসব জমি। কৃষক জমি, অলংকার, হলের বলদ, কাস্তে, কোদাল বিক্রি করে কপর্দকহীন হয়ে দিনাতিপাত করেছিল।
মাত্রাতিরিক্ত খাজনার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বনে-জঙ্গলেও আত্মগোপন করে ছিল। শেষমেশ বিদ্রোহ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ১৭৮৩ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি টানা পাঁচ সপ্তাহ কৃষকেরা এক অপ্রতিরোধ্য লড়াই রচনা করেছিল যা আগে কেউ দেখেনি। বিদ্রোহের মূল নেতৃত্ব দেন নূরলদীন, ধীরাজ নারায়ণ ও কেনা সরকার। এদের মধ্যে নূরলদীন সবচেয়ে আলোচিত এই জন্য যে, সমরশক্তিতে অসম হয়েও প্রবল পরাক্রমে তিনি ঔপনিবেশিক ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধে নূরলদীন পরাজিত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
কিন্তু প্রবল দেশপ্রেম, অমিত তেজ ও সাহসী নেতৃত্বের সম্মিলনে তিনি যে আত্মত্যাগের নজির রেখে গেছেন তা বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে শত শত বছর ধরে শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে আছে। নূরলদীন তাই আমাদের জাতীয় জীবনের এক লড়াকু বীরের নাম। ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্যানভাসে আঠারো শতকের কিংবদন্তি কৃষক যোদ্ধা নূরলদীন ও তাঁদের পরিচালিত রংপুর কৃষক বিদ্রোহের এক কৌতূহলী ও বিস্তৃত পর্যালোচনা হাজির করে মনন রেখা সম্পাদক আমাদের ঋদ্ধ করেছেন।
এই বিদ্রোহ ইংরেজদের পলাশী পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে চাপের মুখে ফেলে এবং বাধ্য করে রাজস্বনীতি পরিবর্তন করতে। নূর উদ্দীন মোহাম্মদ বাকের জং বা নূরলদীন ওই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। রংপুরের ফুলচৌকিতে তাঁর কবর রয়েছে। নূরলদীনের ইতিহাস অল্পবিস্তর পাওয়া যায়; সেই ইতিহাস উদ্ধারের সূত্রে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও সামনে আসে। তবে সেই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক নূরলদীনের আত্মবিসর্জনকারী সংগ্রামের মূল্য অপরিসীম। সৈয়দ হক তাঁর শক্তিশালী কলমে শতাব্দীর অতলে হারিয়ে যাওয়া চরিত্র নূরলদীনকে কাব্যনাটকের মাধ্যমে গেঁথে দিয়েছেন সাধারণের মস্তিষ্কে। মনন রেখা স্মৃতি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাসের টুকরোগুলোকে ঘষে মেজে পরিষ্কার করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
আঠারো শতকের কৃষক আন্দোলনে দিনাজপুরের একটি চিত্র দেখতে পাই অধ্যাপক মোজাম্মেল বিশ্বাসের লেখায়। বৃহত্তর দিনাজপুরে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জাঁতাকলে পিষ্ট কৃষক কূল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এবং ভয়ানক সামাজিক স্খলনের মহামারিতে আক্রান্ত হয় সমাজ ও জনপদ। কোম্পানি সমগ্র বাংলা অঞ্চলে শোষণ আর নিপীড়নের জাল বিস্তার করে। মিঠুন সাহা ফকির বিদ্রোহের মতো বিষয় নিয়ে গোছানো আলোচনা করেছেন।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে বিষদ জানার ও চিন্তার সুযোগ আছে। রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর ও বিহার সংলগ্ন অঞ্চলে সন্ন্যাসী ও ফকিরেরা বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখানে বাংলার কৃষক, মজুর ও প্রান্তিক মানুষজনও সেই কর্মকাণ্ড সমর্থন করেছেন। ১৭৬৩ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে আলোচ্য বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে যা বাংলা জনপদের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী স্বতন্ত্র আন্দোলন।
দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, রংপুর, ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে শ্রীহট্ট, আসাম ও নেপাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের দাবানল বিস্তৃত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জরিপ মতে, এই সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার বা তার বেশি। কোম্পানি প্রশাসনের নথিতে এই ফকিরদের একতরফা ডাকাত বা দস্যু ও লুটেরা বলেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
আদতে এই সন্ন্যাসীরা ছিলেন নবম শতাব্দীর গোঁসাই, গৃহী, নাগা, বকসারিয়া, ভোজপুরি, অঘোরী, কৃষক ও বৈরাগী। ফকির গোষ্ঠীটি ছিল সুফি ধারা থেকে আগত। এরা মুষ্টিভিক্ষা ও বিভিন্ন লোকজ পরিবেশনা করে দক্ষিণা গ্রহণ করতেন। কোম্পানি দমন নীতির আলোকে এদের দানের ওপর অবরোধ আরোপ করে এবং তীর্থ কর আরোপ করে। উদ্দেশ্য ছিল, এই ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণ করা। তবে ফকিরদের থেকে কর আদায় দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।
এই ফকিরদের অনেকেই মুঘল দরবারের ফৌজি থাকার দরুন নিষ্কর ভূমি ভোগদখল করত। অতিরিক্ত করের বোঝায় এরা ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। তাদের ব্যবসা (রেশম, মসলা, তৈজসপত্র) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাষের ভূমি করায়ত্ত করা এবং নতুন শাসকদের চরিত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মূলত এই ভূখণ্ডের আর্য ও অনার্যদের বিভাজিত করেছিল। ঠিক একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বাঙালির, যারা এই ভূমিকে চাষযোগ্য করেছে, শতাব্দীর ভাঁজে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচেছে। ফকিরদের ওপর স্থানীয় রায়ত-প্রজা, জমিদার ও মহাজনের বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল। ১৭৫৭ সালে প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে ফকিরদের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়তে থাকে। তাদের অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞা, তীর্থ কর আদায় আরও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বক্সারের যুদ্ধে সন্ন্যাসীরা অযোধ্যার নবাবের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
১৭৭০ সালের মন্বন্তরে কৃষক, মজুর ও বিপন্ন মানুষদের দলে ভেড়াতে ফকিরদের উৎসাহী করে। এর সঙ্গে মুঘল ও নবাবি জমানার বেকার বুভুক্ষু ফৌজিরাও ফকিরদের দলে ভিড়ে যায়। উল্লেখ্য, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া আরও ছয়টি দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা পেতে হয়েছিল কোম্পানি আমলে বাংলা প্রদেশের মানুষদের। খাদ্য শস্যের মজুত সুবিধা ভোগীদের জন্য এত বেশি করা হয়েছিল যে নিম্ন শ্রেণির মানুষের জন্য খাদ্য ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেওয়ানি শাসনামলে রাজা ও প্রজার পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব সংকটের জায়গায় পৌঁছে। রাজস্ব আদায়ে মরিয়া ইংরেজ বেনিয়ারা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা অনুধাবনে একদমই নারাজি, বিধায় একের পর এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে মানুষ।
১৭৬৫ থেকে ১৭৯১ সাল পর্যন্ত কোম্পানি বিভিন্ন কলা কৌশল উদ্ভাবনে ব্যয় করে কীভাবে কম ঝামেলায় মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করা যায় স্থানীয় ইজারাদার, জমিদার ও সামন্ত শক্তিকে ব্যবহার করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে পিংকি সাহা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত বহুস্তরীয় একটি মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বিলেতে মুদ্রাস্ফীতি অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। আঠারো শতকের সর্বহারা কৃষকেরা খাজনা মওকুফের জন্য করুণা ভিক্ষা করলেও ঔপনিবেশিক শক্তি জবাব দিয়েছিল রক্ত আর বারুদের ভাষায়!
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর চরম সামাজিক স্খলন আর অবক্ষয় ডেকে আনে বাংলায়। খাদ্যের সংস্থানে মানুষ পুত্র কন্যাকে দাসদের মতো বিক্রি করে দিয়েছিল। রংপুরে অত্যাচারী ইংরেজদের বিরুদ্ধে রায়ত প্রজা জমিদারের সম্মিলিত বিদ্রোহ ছিল ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অন্যতম চরিত্র দেবী সিংহ বাংলার মাটিকে যে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছিল তাঁর ধুলোমলিন প্রাসাদ ও খাজাঞ্চিখানার অনাদায়ি ঋণের খেড়খাতা আজও সে বিস্মৃতি বহন করে। এই কৃত্রিম খাদ্যসংকট ঔপনিবেশিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি নির্মাণ করে। বাংলার বিপুল ধনভান্ডার লুটে নিয়ে ইউরোপে নিজেদের যান্ত্রিক শিল্প গড়াই ছিল ইংরেজদের একমাত্র লক্ষ্য।
সমৃদ্ধ কিছু অনুবাদ প্রবন্ধ পাঠের সুযোগ আছে এই সংখ্যাটিতে। প্রখ্যাত গবেষক জন ই. উইলসনের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে বর্গাচাষিদের চিন্তার জগতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের মৌলিক বৈরিতার জায়গাগুলো। কৃষক বিদ্রোহের শক্তিপীঠগুলোর বিস্তৃত বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার একটি পর্যালোচনা আছে এই পাঠে। কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে আমলাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত অগ্রাধিকারের মাঝে দ্বন্দ্ব ও তাৎপর্য জেমস লিসের অনুবাদ প্রবন্ধে বর্ণিত রিচার্ড গুডল্যাড এবং তাঁর ব্যক্তিগত দালিলিক অভিজ্ঞতার আলোকে।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী নাটকগুলো, যেমন ইডিপাস রেক্স, প্রমিথিউস বাউন্ড, ম্যাকবেথের পাশাপাশি ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্যনাটকটির চমৎকার তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন মফিদুল হক। সৈয়দ হকের এই মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি আমাদের বহুকালের মুক্তি আন্দোলনকে উসকে দেয় বারবার অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ কাব্য নাটকটি নিয়ে দুটি সাক্ষাৎকার পাব এই সংখ্যায়। এদের একজন বিশিষ্ট বর্ষীয়ান অভিনেত্রী লাকী ইনাম এবং অন্যজন ভারতের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাট্য নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের। লাকী ইনাম নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের মঞ্চায়নের সূত্র ধরে অভিনেতা আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, আতাউর রহমান প্রমুখের স্মৃতিচারণ করেন। আমরা জেনেছি, সৈয়দ হক লন্ডনে বসে কোন প্রেক্ষাপটে নূরলদীনকে আবিষ্কার করলেন এবং কাব্যনাট্যটি বাংলা সাহিত্যের এক মৌলিক সংযোজনে পরিণত হলো।
‘লুট’ শব্দটি নাটকটিতে অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে শোণিত অস্ত্রের মতো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানিকের বঞ্চিত ব্যক্তিদের জীবনকথার মতো। নাট্যব্যক্তিত্বরা বলেছেন এর নির্মাণ, বলিষ্ঠ শব্দশৈলী, মঞ্চ আলোকসজ্জাসহ প্রতিটি মুহূর্তে রয়েছে মুনশিয়ানার ছাপ। ‘নূরলদীনের সারা জীবন’ বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে এবং স্বৈরতন্ত্র ও একচেটিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ স্বর হিসেবে শক্তি যুগিয়ে চলেছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমে বা উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে কৃষক আন্দোলনের বিস্তারিত ইতিহাস চর্চা নেই বললেই চলে। কৃষক বিদ্রোহের কোনো ইতিহাসই প্রচলিত অর্থে অর্থনৈতিক ইতিহাস নয় বরং এটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসেরই বয়ান। কৃষক বিদ্রোহের মর্ম নিহিত আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। শোষক শোষিতের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ ও আধিপত্যের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে এতে। প্রাক ঔপনিবেশিক সমাজ প্রসঙ্গে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস প্রচলিত তা যতটাই সমৃদ্ধ হোক না কেন, কৃষক বিদ্রোহের সামগ্রিক ইতিহাস তাতে চিত্রিত হয় না। ‘মনন রেখা’র এই সংখ্যা সুযোগ করে দিয়েছে আঠারো শতকের বাংলার এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস পর্বকে তুলনামূলক পাঠের।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে