হাঙ্গেরির খ্যাতিমান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ লুকাচ বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র।’ এই অসাধারণ উক্তির তাৎপর্য পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রনায়ক উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যেসব রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সংস্কৃতিমনস্ক, সাহিত্যপ্রেমী, চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন; ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল; ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু; দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা; রাশিয়ার লেনিন; চীনের মাও সে-তুং; কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো ব্যক্তিত্ব এর উজ্জ্বল উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ধারারই অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী ছিলেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য ও ইতিহাস নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা অসামান্য তিনটি স্মৃতিকথায় গণমানুষের মুক্তির কান্ডারির পাশাপাশি একজন গভীর পাঠক ও মননশীল লেখকের উজ্জ্বল পরিচয় ফুটে উঠেছে।
শৈশবেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পাঠানুরাগ গড়ে উঠেছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম।’ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শীর্ষক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার বই পড়ার অভ্যাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আব্বার কিছু বইপত্র, বহু পুরোনা (পুরোনো) বই ছিল; বিশেষ করে জেলখানায় বই দিলে সেগুলো সেন্সর করে সিল মেরে দিত। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এ বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ’র কয়েকটি বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।’
বইয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে লেখা একটি চিঠি। ১৯৫০ সালের ২১ ডিসেম্বর ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে প্রেরিত চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় জেলখানার গেটে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন। তবে এখনও কোনো বই পাইনি। ভুলে যাবেন না এখানে আমি একা আর বই-ই আমার একমাত্র সঙ্গী।’ বঙ্গবন্ধুর অসামান্য সাহিত্যপ্রীতির নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভাষ্যে, ‘কোনো কারণে আমি মনঃক্ষুণ্ন হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আজও শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময় একবার একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে আমি রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো এক সেট কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। ওর সামনে যখন উপহার হিসাবে বইগুলো উপস্থিত করলাম, খুশির আবেগে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উজ্জ্বল চোখ দুটো তুলে একবার শুধু তাকালেন। সে চোখে ছিল শিশুর মতো তৃপ্তি আর প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা।’
বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সুধারসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলা বই ও পত্রিকা পড়ার প্রবল আকুতি ব্যক্ত করেছেন ‘কারাগারের রোজনামচায়’, ‘প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু-একখানা বই এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না।’
শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও মনোযোগী পাঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফরাসি লেখক এমিল জোলার উপন্যাস ‘তেরেসা রেকুইন’ পড়ে তাঁর উপলব্ধি, ‘এমিল জোলার লেখা তেরেসা রেকুইন পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র—জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই-তিন ঘণ্টা সময়।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে গণমুক্তির কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গ এসেছে। চীন ভ্রমণ করার সময় এই তুর্কি কবির সান্নিধ্যে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশ ত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি।’ কবি ইকবালের স্মৃতিধন্য জাভেদ মঞ্জিলে ঘোরার স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন, ‘আল্লামা শুধু কবিই ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন।’
ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পর চীন ভ্রমণের সময় পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখক মনোজ বসুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়। সেই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় বক্তৃতা মনোজ বসুকে মুগ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষা বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না।’
বিচিত্র বিষয়ের বইয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছিল। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিশ্বরাজনীতির নিয়মিত পাঠক ছিলেন তিনি। যখনই বই পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তীব্র ক্ষোভ ঝরে পড়েছে তাঁর কণ্ঠ থেকে, ‘আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই।...কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী।’
ইতিহাস ও বিপ্লবী সাহিত্য বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিল। দেশভাগ নিয়ে রচিত অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসনের লেখা ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ বই পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বিখ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কলাম খুব আগ্রহসহকারে পড়তেন। তাঁদের সম্পর্কে উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন তিনি। বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ পড়ে প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীম উদ্দীনের কবিতার অনুরাগী পাঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিল্পীদের মধ্যে জয়নুল আবদিন ও আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তাঁর। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত ও শওকত ওসমানের লেখাও পছন্দ করতেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র অস্তিত্বে যে সাহিত্যিক সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। কারাগারে কাটানো দুঃসময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/ এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ গান থেকে সাহস সঞ্চয় করেছেন।
১৯৬৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অবিস্মরণীয় বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, অ্যারিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে-তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যৌথ মিথস্ক্রিয়ায় ষাটের দশকে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এটি সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্বের কারণে। বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন তলস্তয়ের সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের মহৎ শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশের প্রতিফলন ঘটবেই।’ শিল্প, সাহিত্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুও লেনিনের ধারণাই পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণ বা মুক্তির চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প-সাহিত্য রচিত হতে পারে না। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সাহিত্যিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে।...আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’
হাঙ্গেরির খ্যাতিমান দার্শনিক ও চিন্তাবিদ লুকাচ বলেছিলেন, ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সেই লক্ষ্য সাধনের একটি উপায় মাত্র।’ এই অসাধারণ উক্তির তাৎপর্য পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রনায়ক উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যেসব রাষ্ট্রনায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাই রাজনীতিবিদের পাশাপাশি সংস্কৃতিমনস্ক, সাহিত্যপ্রেমী, চিন্তাবিদ ও লেখক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন; ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল; ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু; দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা; রাশিয়ার লেনিন; চীনের মাও সে-তুং; কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর মতো ব্যক্তিত্ব এর উজ্জ্বল উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ধারারই অন্যতম রাষ্ট্রনায়ক। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির গভীর অনুরাগী ছিলেন তিনি। বিশ্বসাহিত্য ও ইতিহাস নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা অসামান্য তিনটি স্মৃতিকথায় গণমানুষের মুক্তির কান্ডারির পাশাপাশি একজন গভীর পাঠক ও মননশীল লেখকের উজ্জ্বল পরিচয় ফুটে উঠেছে।
শৈশবেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে পাঠানুরাগ গড়ে উঠেছিল। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম।’ ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শীর্ষক গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার বই পড়ার অভ্যাস সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আব্বার কিছু বইপত্র, বহু পুরোনা (পুরোনো) বই ছিল; বিশেষ করে জেলখানায় বই দিলে সেগুলো সেন্সর করে সিল মেরে দিত। ১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এ বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ড শ’র কয়েকটি বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।’
বইয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ভালোবাসার নিদর্শন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে লেখা একটি চিঠি। ১৯৫০ সালের ২১ ডিসেম্বর ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে প্রেরিত চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘গত অক্টোবরে কেন্দ্রীয় জেলখানার গেটে যখন আমাদের দেখা হয়েছিল, আপনি কথা দিয়েছিলেন, আমাকে কিছু বই পাঠিয়ে দেবেন। তবে এখনও কোনো বই পাইনি। ভুলে যাবেন না এখানে আমি একা আর বই-ই আমার একমাত্র সঙ্গী।’ বঙ্গবন্ধুর অসামান্য সাহিত্যপ্রীতির নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভাষ্যে, ‘কোনো কারণে আমি মনঃক্ষুণ্ন হলে অতীতে বঙ্গবন্ধু আমকে কবিগুরুর কবিতা শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। আজও শত কাজের চাপে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও এতটুকু সময় পেলেই সন্তানদের নিয়ে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, আবৃত্তি শোনান পরিবারের লোকদের। রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময় একবার একজন বিশ্বস্ত লোককে দিয়ে আমি রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো এক সেট কলকাতা থেকে আনিয়েছিলাম। ওর সামনে যখন উপহার হিসাবে বইগুলো উপস্থিত করলাম, খুশির আবেগে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়লেন। উজ্জ্বল চোখ দুটো তুলে একবার শুধু তাকালেন। সে চোখে ছিল শিশুর মতো তৃপ্তি আর প্রগাঢ় কৃতজ্ঞতা।’
বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সুধারসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলা বই ও পত্রিকা পড়ার প্রবল আকুতি ব্যক্ত করেছেন ‘কারাগারের রোজনামচায়’, ‘প্রাণটা আমার হাঁপাইয়া উঠছিল, সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপায় নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরি আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরি থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু-একখানা বই এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না।’
শুধু বাংলা সাহিত্যের নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও মনোযোগী পাঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফরাসি লেখক এমিল জোলার উপন্যাস ‘তেরেসা রেকুইন’ পড়ে তাঁর উপলব্ধি, ‘এমিল জোলার লেখা তেরেসা রেকুইন পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র—জোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই-তিন ঘণ্টা সময়।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে গণমুক্তির কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গ এসেছে। চীন ভ্রমণ করার সময় এই তুর্কি কবির সান্নিধ্যে আসেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘রাশিয়ার প্রতিনিধিদেরও আমরা খাবার দাওয়াত করেছিলাম। এখানে রুশ লেখক অ্যাসিমভের সাথে আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এই সম্মেলনেই আমি মোলাকাত করি তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের সাথে। বহুদিন দেশের জেলে ছিলেন। এখন তিনি দেশ ত্যাগ করে রাশিয়ায় আছেন। তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। দেশে তাঁর স্থান নাই, যদিও বিশ্ববিখ্যাত কবি তিনি।’ কবি ইকবালের স্মৃতিধন্য জাভেদ মঞ্জিলে ঘোরার স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন, ‘আল্লামা শুধু কবিই ছিলেন না, একজন দার্শনিকও ছিলেন।’
ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পর চীন ভ্রমণের সময় পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখক মনোজ বসুর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়। সেই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় বক্তৃতা মনোজ বসুকে মুগ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষা বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না।’
বিচিত্র বিষয়ের বইয়ের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ছিল। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিশ্বরাজনীতির নিয়মিত পাঠক ছিলেন তিনি। যখনই বই পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তীব্র ক্ষোভ ঝরে পড়েছে তাঁর কণ্ঠ থেকে, ‘আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই।...কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তারা সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুণী।’
ইতিহাস ও বিপ্লবী সাহিত্য বঙ্গবন্ধুর ভীষণ প্রিয় ছিল। দেশভাগ নিয়ে রচিত অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসনের লেখা ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ বই পাঠের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বিখ্যাত সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কলাম খুব আগ্রহসহকারে পড়তেন। তাঁদের সম্পর্কে উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন তিনি। বন্ধু শহীদুল্লা কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ পড়ে প্রশংসা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীম উদ্দীনের কবিতার অনুরাগী পাঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শিল্পীদের মধ্যে জয়নুল আবদিন ও আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তাঁর। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত ও শওকত ওসমানের লেখাও পছন্দ করতেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর সমগ্র অস্তিত্বে যে সাহিত্যিক সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। কারাগারে কাটানো দুঃসময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/ এ নহে মোর প্রার্থনা/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ গান থেকে সাহস সঞ্চয় করেছেন।
১৯৬৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের পক্ষে অবিস্মরণীয় বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, অ্যারিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে-তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’
সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতির যৌথ মিথস্ক্রিয়ায় ষাটের দশকে তীব্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এটি সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্বের কারণে। বলশেভিক বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন তলস্তয়ের সাহিত্য সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের মহৎ শিল্প-সাহিত্যে বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশের প্রতিফলন ঘটবেই।’ শিল্প, সাহিত্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুও লেনিনের ধারণাই পোষণ করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণ বা মুক্তির চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিল্প-সাহিত্য রচিত হতে পারে না। ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু সাহিত্যিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হাতে হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে।...আমি সাহিত্যিক নই, শিল্পী নই, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণই সব সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো দিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না।’ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরের বেশে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
৩ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২১ দিন আগে