শব্দের বাগানে এক নির্ভেজাল চাষি–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অরিন চক্রবর্তী
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮: ৩৫

কথাসাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪-২৩ অক্টোবর ২০১২) জন্মদিন আজ। প্রথিতযশা এই সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস দুই বাংলার পাঠকদের ছুঁয়েছে বহতা নদীর মতো। তাঁর জন্মদিনে আজকের পত্রিকার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

বাংলা সাহিত্যের বাগানে হঠাৎ করে এসে যিনি লাল ও মিষ্টি আপেল ফলিয়েছেন, তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পাঠক তাঁর রচনায় একের পর এক সুখের কামড় দিয়ে চলেছে। আজও বিরাম নেই। তিনি যেন বাংলা সাহিত্যের একটি রিজার্ভ ফরেস্ট। যেখানে অনায়াসে ঘুরে বেড়ানো যায়, নদীর ধারে বসে জিরিয়ে নেওয়া যায় এবং স্নিগ্ধ হওয়া যায়।

তাঁর রচনার এই রিজার্ভ ফরেস্টেই খুঁজে পাওয়া যায় বৃষ্টির অমোঘ ধারার মতন দুঃখ। নিয়মিত লেখালেখি শুরু হওয়ার দিন থেকেই প্রতিদিন লেখার টেবিলের সামনে বসার অভ্যাস তাঁর রক্তে মিশেছে, অথচ শুরুটা হয়েছিল নিতান্তই শখ ও অনুবাদের বশে। মেট্রিক পাস করার পর অবসর সময়ে তাঁর বাবা টেনিসনের ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস’ থেকে কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে দিতেন, অনুবাদ করার ফাঁকে ও পড়াশোনার সূত্রে বাংলা কবিতায় শূন্যতা তিনি বুঝতে পারেন।

এই উপলব্ধি তাঁকে লিখতে বাধ্য করে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে সাহিত্যের তপোবনে দীক্ষা নেওয়া এক শিক্ষানবিশ, পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন সাধক ও দীক্ষাগুরু। সাহিত্যে তাঁর অবাধ বিচরণ তাঁকে কালজয়ী করে তুলেছে। যদিও তার পেছনে রয়েছে শব্দের লালন ও পরিচর্যা।

বর্তমানে যেমন বাংলা কবিতা সিরিয়াসভাবে লিখতে হলে এবং নিজেদের লেখা টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রচুর পড়তে হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই পড়াশোনায় জোর দিয়েছিলেন, লেখালেখি করার আগেই। তাঁর লেখা থেকেই উঠে আসে যেভাবে তিনি জীবনানন্দকে খুঁজে পেয়েছিলেন চিন্তা ও চেতনায়...

‘পড়তে হবে। কিন্তু বই কেনার পয়সা পাব কোথায়? হাত খরচ পাই দৈনিক মাত্র চার পয়সা, জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’-এর দাম দু’টাকা।

মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল। রেশন থেকে চুরি করলে কেমন হয়? চাল আর চিনি যদি কিছু কিছু কম নিই, বাড়িতে ধরতে পারবে না। ধরলেও বলব, আমাকে ওজনে ঠকিয়েছে। সেরকম তো অহরহ ঠকায়। একটা যুক্তিও খাড়া করলাম। ম্যান ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন। শুধু ভাত রুটি খেয়ে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না। কবিতাও পড়তে হবে। একটু কম ভাত খেয়ে, চায়ে একটু কম চিনি দিয়ে, সেই পয়সা বাঁচিয়ে একটা কবিতার বই অবশ্যই কেনা যেতে পারে।

সেইদিনই সন্ধেবেলা কবিতার বইটি কিনে বাড়ি ফিরে, পাগলের মতন কতবার যে পড়তে লাগলাম তা কে জানে!’ 
তাঁর পূর্বজদের শিকড় বাংলাদেশে লেগে থাকলেও মাত্র চার বছর বয়সে কলকাতায় আসেন। যদিও আপামর বাঙালি তাঁকে আপন করে নিয়েছে। কাঁটাতার তাঁর সাহিত্যকে বিঁধতে পারেনি। সংসারে জীবনের লড়াই শুরু হয়।

সায়েন্সের ছাত্র হয়েও অধ্যাপনা অথবা গবেষণাকে বেছে নেননি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সিটি কলেজে পড়াকালীন কমলকুমার মজুমদারের নেতৃত্বে হরবোলা ক্লাবে নাট্যচর্চাও করতেন। স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকা পড়তে যান, ফিরে এসে উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজও করেন।

এরপর বেশ কিছুদিন প্রাইভেট অফিসে চাকরি করেন, ছেড়ে দিয়ে পড়ানো শুরু করেন। সত্তর দশকে সাংবাদিক হিসেবে কাজ নেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। শেষ জীবন পর্যন্ত সেখানকার বিভিন্ন দায়িত্ব সামলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। যদিও শুধু শব্দের অনন্ত নক্ষত্রবীথি এসে ভিড় করেছে জীবনের মহাকাশে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সব থেকে বড় অস্ত্র ছিল, তিনি কোনো সাহিত্য গোষ্ঠীর ভিড়ে পা মেলাননি। তিনি মনে করতেন কোনো গোষ্ঠী কখনোই লেখার মান বাড়াতে পারে না। তাই নিজেকেই ভেঙেছেন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন এবং লিখে গিয়েছেন। আদ্যোপান্ত দস্তয়েভস্কি-পাগল ছিলেন, এমনকি বন্ধুদের বলেও বেড়াতেন; সাহিত্যচর্চা করতে গেলে দস্তয়েভস্কি পড়তে হবে। ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’ তাঁর কাছে ছিল সাহিত্যের অণু-পরমাণু।

আসলে তিনি পড়তেন, লেখায় প্রভাব ফেলতে দেবেন না বলেই। নিজের লেখাকেও বহুবার অস্বীকার করেই এগিয়ে গিয়েছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীন। তাঁর মধ্যে ছিল শব্দের প্রতি নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতা। প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা শুধু লেখা নিয়েই কাটিয়ে দিতেন। কোনো অনুষ্ঠান অথবা কাজের সূত্রে বাইরে গেলেও এই ধারাবাহিকতার অভাব ঘটেনি। ১৯৫২ সালে ‘একটি চিঠি’ কবিতাটি তিনি লেখেন প্রেমিকাকে ভালোবাসা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে।

এই লেখাটি তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠালে চার মাস পর প্রথম প্রকাশিত কবিতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তীক্ষ্ণ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর লেখা প্রথম গল্পও ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। তত দিনে অবশ্য কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।

এই ধারাবাহিকতার ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি অসামান্য সৃষ্টি। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ থাকলেও নিজেকে আদ্যোপান্ত কবি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। গভীর নার্সিসিজম উঠে আসে তাঁর কবিতার প্রতি বাঁকে, যদিও দু-একটি কাব্যগ্রন্থ বাদ দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই আমিত্ববোধের ভাঙা-গড়া নিয়ে চড়তে থাকে কবিতার পারদ। প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘একা এবং কয়েকজন’। যেখানে ‘দুপুর’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
‘এর চেয়ে রাত্রি ভালো, যুবকটি মনে মনে বললো বারবার
রোদ্দুর মহৎ করে মন, আমি চাই শুধু ক্লান্ত অন্ধকার।’ 
কাব্যগ্রন্থটির পর্দার আড়ালে উঠে এসেছে কলকাতার যুবকদের অন্ধকার দিকটি। তাদের বেকারত্ব, প্রেমিক সত্তা উঠে আসে কবিতার মোড়কে। ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’ তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থটির মধ্যে একটি। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ কবিতার একটি অংশ-
 ‘এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্ন দেখে কপালের ঘাম
ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয়
বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা
নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি
এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে
বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীরে ভ্রমণে
পুণ্যবান হবো।’ 

এখানেই ধরা দেয় প্রেমিক সুনীল। তরুণ ও প্রেমিক মন নীরার শরীরকে বাহান্ন তীর্থ ভেবে ভ্রমণ করে এবং পুণ্যবান হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। যেন সব প্রেমিকের মুখের ভাষা হয়ে উঠেছে। অথবা ‘কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে’ এই একটি কথাতেই শারীরিক মাহাত্ম্য বোধ প্রাধান্য পেয়েছে।

যৌনমুখর হয়ে উঠলেও তা কখনোই ছাপিয়ে যায়নি গভীর শৈল্পিক চেতনাকে। এখানেই ‘হিমযুগ’ কবিতাটি হয়ে উঠেছে মহৎ। নিজস্ব ভাষায় ও গদ্যরীতিতে প্রেমের অব্যয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যুক্ত করেছেন জ্যামিতিক টান। স্বাভাবিক মুখের ভাষাও কখনো কখনো মাত্রা পেয়ে রূপকের আঙ্গিকে মিশে, কবিতা হয়ে ওঠে সার্থক মাধ্যম।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় উঠে আসে এক দিকশূন্যপুর, যেখানে পা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়। যেখানে মিলেমিশে যায় নীরার নূপুর ও বাউলের একতারার সুর। নীরা এমন একটি চরিত্র, যেখানে ফুটে ওঠে প্রেমের মানব দিকটি। যেখানে বিপরীত দিক হিসেবে উঠে আসে বরুণার কথাও।

অনায়াসে তাঁর কবিতায় স্বাচ্ছন্দ্য হওয়া যায়, দুঃখবিলাসিতায় ডুবে তুলে নিয়ে আসা যায় সামগ্রিক নিজস্বতা। এক আশ্চর্য অনুভব-বোধের জন্ম দেয়। জীবনের কিছু রক্ত-মাংস খুঁড়ে তুললেও, তা ছুঁয়ে ফুটে ওঠে চেতনার পরিধি। এক উন্মাদ বালক মাউথ-অর্গ্যান হাতে যেন ঘুরে বেরাচ্ছে কবিতার বৃত্তজুড়ে, আর তার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে শব্দের মাত্রায়।

‘নীললোহিত’ ছদ্মনামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায় ‘নীললোহিত’কে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তুলে এক আত্মমগ্ন ন্যারেটিভ আমরা খুঁজে পাই। বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রকে তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মূল ভিত্তি করে তুললেও তা কখনো ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে ওঠেনি। বরং হয়ে উঠেছে ভীষণ রকম জ্যান্ত ও জীবনের পরিপূরক।

‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে রামকৃষ্ণদেব ও তাঁর শিষ্যদের ভূমিকা পাই আমরা। এ ছাড়া, কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নটী বিনোদিনী, গিরিশচন্দ্র এক আলাদা মাত্রায় যুক্ত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা জীবন্ত দলিল আকারে আশ্রয় পেয়েছে ‘সেই সময়’ উপন্যাসে। বাঙালির নবজাগরণ পর্ব ও সেই সময়ের প্রধান ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে আখ্যানমূলক করে তুলেছে।

তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।

‘মন ভালো নেই’, ‘রাত্রির রঁদেভু’, ‘সেই মুহূর্তে নীরা’ ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘বন্দি জেগে আছো’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসহ প্রায় ২৫০-এর ওপর বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে, যে বইটির কথা না বললেই নয় সেটি হলো ‘মনের মানুষ’। বাংলা ভাষায় লালনকে মুখ্য ভূমিকায় রেখে দর্শনমূলক প্রেক্ষাপট অন্য উপন্যাসে কম পাওয়া যায়।

গ্রামবাংলার দলিল ও চরিত্রের বিশ্লেষণ এখানে থাবা বসায় আমাদের মানবিক অন্তরে, তৎকালীন সময়ের সামাজিক অবক্ষয় ধরা দেয় আমাদের চোখের সামনে। এই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন, যা পরবর্তীকালে বেশ কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কার এনে দেয় এবং বাংলা চলচ্চিত্রে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

প্রসঙ্গক্রমে ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বলেছিলেন, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে বলার ধরনে ইতিহাসকে তুলে ধরছেন, একটা সময়ের পর আমাদের ঐতিহাসিকদের কথা কেউ শুনবে না এবং লেখা কেউ পড়বে না। ইতিহাস বলার এই দৃষ্টিকোণ অনন্য ও গ্রহণযোগ্য।’ এমনকি তাঁর কবিতাতেও আমরা চে গুয়েভারা, ইন্দিরা গান্ধী ও হাসন রাজার উল্লেখ পাই, যা এক নতুন সুনীলকে আবিষ্কার করে।

তাঁর কাকাবাবু-সন্তু সিরিজ ভায়োলেন্সবিহীন অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি হওয়ায় শিশু ও কিশোর বয়সী পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনা অনেক বেশি পাঠকের হৃদয়ের কাছাকাছি। মানুষের গভীর ও মানসিক দুঃখবোধ তাঁর লেখার মাধ্যমে সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। যে কারণে তাঁর অনেক লেখাই থেকে যাবে কালের নিয়মে।

তবুও, দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্র ও মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা তাঁর লেখায় কম পাওয়া যায়। মরুভূমিতে কোনো পথিক জল পেলো, তবুও যেন তার তৃষ্ণা মিটলো না। জীবনকে এক প্রকার ব্যালেন্স করেই লিখেছেন প্রচুর কবিতা।

ভাষা এখানে অনেক ক্ষেত্রে হয়েছে ঘরোয়া। সত্তর দশকের উত্তাল পরিবেশ তাঁর লেখায় প্রভাব বিস্তার করেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি পরিধি বিস্তৃত যাপনে লিখে গেছেন। সুখপাঠ্য হলেও তাঁর গদ্যশৈলী কিছুটা হলেও সিরিয়াস সাহিত্য থেকে দূরে অবস্থান করেছে। 
 ‘কবিতা আমার ওষ্ঠ কামড়ে আদর করে
ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে যায়
         ছাদের ঘরে
কবিতা আমার জামার বোতাম ছিঁড়েছে অনেক
হঠাৎ জুতোর পেরেক তোলে!’

‘প্রেমিকা’ কবিতায় এই আত্মচেতনা কবিতার প্রতি দায়বদ্ধ এক কবিকে বিশ্লেষণ করেছে। শব্দের বোধ এখানে অনেক বেশি নিজস্ব পরিধিতে সাবলীল। নিজস্ব অনুভূতি প্রাধান্য পেয়েছে। জীবনের দৃঢ় বিষয় এখানে লেন্সের মাধ্যমে ফুটে ওঠে। তাঁর কবিতা স্বাভাবিক অর্থেই জীবনের অবতল ও উত্তল লেন্স।

শব্দকে যেখানে পরিমাপ করা যায় জীবন ও মনের এককে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন—‘শরীর ছেলে মানুষ, তার কত টুকিটাকি লোভ...’ টেক্সট এখানে আত্মনির্ভর। সচেতন ভাষা প্রয়োগ রক্তাক্ত করলেও তা মুছিয়েও দেয়। কিছু ক্ষেত্রে গ্লানিবোধের জন্ম দিলেও আক্ষেপের অবকাশ থাকে না। মসৃণ পথে হেঁটে চলে মর্মর মিছিল।

শারীরিক তীক্ষ্ণতাবোধ থাকলেও তা দূষিত করে না, বরং ভীষণ প্রাসঙ্গিক, যেন আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি ও রোমান্টিসিজমের মেলবন্ধন। আমাদের মনে ছত্রাক জন্মায়, কবিতার ক্ষমতা থাকে তা জমতে না দেওয়ার। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা সেই রশ্মি, যার ভেতরে মনে ছত্রাক জমতে না দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া মনস্তাত্ত্বিক স্তর ও আবেগের সন্ধানও আমরা পাই।

বাংলা কবিতার ও পত্রিকার ইতিহাসে ‘কৃত্তিবাস’ কোনো লিটল ম্যাগাজিন নয়, এটি একটি যুগ বলে চিহ্নিত হয়। প্রায় ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। আভঁ-গার্দ মুখপত্র হিসেবেও এই পত্রিকা প্রাধান্য পায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তরুণদের লেখার মতন পত্র-পত্রিকার অভাব বোধ থেকেই মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে ‘কৃত্তিবাস’ পা রাখে সাহিত্যের স্বীকারোক্তিমূলক ভাবার্থ অন্বেষণের পথে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বপ্নের পীঠস্থান এই ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ব্যবসায়িক দিক থেকেও বড় হয়ে দেখা দেয় তরুণদের সাহিত্যচর্চায় নিষ্ঠা ও মেধাসম্পন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই আত্মপ্রকাশের আগেই এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়, ১৯৫৩ সালে এর প্রথম সংখ্যা ছেপে বেরোলে তরুণ সাহিত্যিকদের স্বপ্নবিন্দু হয়ে জীবনের বৃত্তে মিলে যায়।

 এই সংখ্যাটি সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী এবং দীপক মজুমদার। সিগনেট প্রেসের তৎকালীন কর্ণধার দিলীপ কুমার গুপ্ত সহযোগিতা করেছিলেন পত্রিকা প্রকাশ এবং বিক্রির বিষয়ে, পরবর্তীকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রধান সম্পাদক হয়ে ওঠেন।

প্রথম দিকে শুধু কবিতা ও কবিতাবিষয়ক গদ্য স্থান পেলেও পরবর্তীকালে দীপক মজুমদারের নাটিকা ‘বেদনার কুকুর ও অমল’, কমলকুমার মজুমদারের ‘সুহাসিনীর পমেটম’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সচিত্র গল্প’, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘চাঁইবাসা চাঁইবাসা’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বহুদিন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কলকাতার কফি হাউসে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের, যার সূত্র ধরে পরবর্তী সময়ে বেলাল চৌধুরী ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদনার কাজও সামলেছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার জন্ম আকস্মিক হিসেবে মনে করলেও ও সম্পাদকীয়তে বিভিন্ন সময় তা উল্লেখ করলেও এই পত্রিকার জন্ম বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগতেও রেনেসাঁ নিয়ে আসে। উৎপলকুমার বসু, আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিদের গুরুত্বপূর্ণ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

তবে, এই পত্রিকার অন্য দিকটি হলো; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রতিটি তরুণের লেখা পড়তেন এবং প্রকাশিত হলে তাঁদের চিঠি পাঠাতেন। এমনকি তাঁরা দপ্তরে আসলে তাঁদের লেখা সম্পর্কে মতামত জানাতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও নতুন লিখতে আসা তরুণদের মাঝখানে একটি মর্মস্পর্শী ব্রিজ হয়ে ওঠে ‘কৃত্তিবাস’। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দিব্যেন্দু পালিত, পিনাকী ঠাকুর, অংশুমান কর ও শ্রীজাত প্রমুখ সাহিত্যিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন।

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছেন, ‘সুনীল স্মরণ সংখ্যার সম্পাদনা আমি করে উঠতে পারিনি। নভেম্বরের মাঝামাঝি আমি ছেলের সঙ্গে তার কর্মক্ষেত্রে চলে যাই। এবং কিছুদিন বাদে অসুখে পড়ি। কলকাতায় ফিরতে অনেক দেরি হল।

সেই সময়ে ‘কৃত্তিবাস’-এর দপ্তরের সবাই নিজেরাই ভার নিয়ে সব কাজ চালিয়ে দেয় এবং দিব্যেন্দু পালিত তাঁদের অনেক সাহায্য করেন। সম্পাদকীয়টি অনুলিখনের ভার নেয় পিনাকী। সে কাজ খুবই ভালোভাবে করেছে সে।

পুজোর আগে কৃত্তিবাসের দপ্তরে বেশ কিছু কবিতা এসেছে, এবং প্রবন্ধও। ফাইল খুলে দেখা গেলো সুনীল অনেক লেখা পড়ে, মনোনীত করে নিজের সই দিয়ে গেছেন। আর বাকি লেখাগুলো আমরা সবাই মিলে বেছে নিয়েছি, দেখে দিয়েছি। সামান্য কিছু লেখা থেকে গেলো, সেগুলি পরের সংখ্যায় যাবে।’

এই সম্পাদকীয় থেকে বোঝা যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ‘কৃত্তিবাস’ কতটা কাছের ছিল। মৃত্যুর আগেও তিনি তাঁর কাজ নির্দিষ্ট সময়ের আগে করে রেখেছেন। মৃত্যুর পরেও ‘কৃত্তিবাস’ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়ানোর সময়ে রামকিঙ্কর বেইজের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। শান্তিনিকেতন নিয়ে বহু কথাও তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। তিনি এখানে বাড়িও করেন, ‘একা এবং কয়েকজন’ নামের সেই বাড়িতে থেকে লেখা বহু উল্লেখযোগ্য রচনার স্বাদ পাঠক গ্রহণ করে। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বইয়ের দোকান ‘সুবর্ণরেখা’ ছিল তাঁর আড্ডার জায়গা।

১৯৬২ সালে অ্যালেন গিনসবার্গ কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার কিছুদিন পরেই ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে কর্মশালায় যোগ দিলে সেখানে সখ্য গড়ে ওঠে টি এস এলিয়ট ও স্টিফেন স্পেন্ডারের সঙ্গে। নিউ ইয়র্কে স্যুররিয়ালিস্টিক চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। বিদেশে বহুদিন কাটালেও এবং বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদেশে প্রায়ই যাতায়াত করলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আদ্যোপান্ত বাঙালি, তাঁর লেখাতেও ছিল বাঙালিয়ানা। যদিও ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে কীভাবে আলাপ হয়েছিল এবং তাঁর কথা আমরা বহু লেখা থেকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।

সাহিত্যের জগতের নানা পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনন্য কীর্তি হলো, সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি থাকাকালীন ‘সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার’ প্রচলন।

তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন সর্বভারতীয় স্তরে একজন লেখককে প্রাধান্য পেতে গেলে সত্তর-আশি বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো, তরুণদের পরিসর এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর হয়ে উঠবে। তাঁর দূরদর্শিতার ফসল হিসেবে আজ বহু তরুণের লেখালেখির পথ প্রশস্ত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত