আনিসুল হক
আমাদের এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিল নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার আগে আগে, ‘এবার সাহিত্যে নোবেল পাওয়া উচিত উৎপল শুভ্রর!’
এ কথাটা রসিকতার ছলে বলেছে, একটু খোঁচা মেরে বলেছে, নাকি আসলেই এটাই ছিল বন্ধুর মনের চাওয়া, তা আর অনুসন্ধান করার প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ক্রিকেট-সাহিত্য বলতে জগতে খুবই শ্রদ্ধেয় একটা জনরা আছে; আর তার লেখকেরা সব ভুবনবিখ্যাত; নোবেল পুরস্কার তাঁদের কেউ যদি পেয়ে যান, তাহলে নোবেল পুরস্কারই হয়তো গৌরবান্বিত হবে। বব ডিলান যদি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন; তাহলে কবির সুমন কেন নন? আর গানের লেখক-সুরকার পারফরমার যদি নোবেল পেতে পারেন, ক্রিকেট-সাহিত্যিকেরাই বা কেন বাদ থাকবেন। আর তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে আমার মনোনয়ন তো উৎপল শুভ্রই।
আমি ক্রিকেটের ক-ও বুঝি না। আমার সবকিছুই ক্ষণিকের আনন্দের জন্য। ‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ। উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তারি আনন্দ॥’ আমি সবকিছু করি আনন্দের জন্য। আইনস্টাইন বলেছেন, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা মূল্যবান, আর আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে আনন্দ মূল্যবান। তবে এই আনন্দও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া আনন্দের ধারণা; এটা আর যা-ই হোক, ইন্দ্রিয় সুখ নয়; ভোগের নয়, উপভোগের। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, দিনরজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে।’ আমার আনন্দ, এই আনন্দ।
আমি ছোটবেলাটা কাটিয়েছি মাঠে-ঘাটে, অবাধ প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি, বর্ষাবিস্ফারিত নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি, জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি নৌকা বেয়েছি, গাছের একটা উঁচু নিঃসঙ্গ মগডালে সরীসৃপের মতো বুকে ঠেলে ঠেলে একা একা উঠে নামতে না পেরে ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছি; জম্বুরা, কচুরিপানার দলা, ন্যাকড়ার পোঁটলা, দেশলাইয়ের বাক্স—নানান কিছুকে ফুটবল বানিয়ে খেলেছি; বৃষ্টিতে জগৎ ভেসে যাওয়া প্রহরগুলো কাটিয়েছি ফুটবল পায়ে মাঠে কিংবা পাড় উপচানো খালে এবং আমি ক্রিকেটও খেলেছি।
আমাদের শৈশব ছিল দারিদ্র্যের শৈশব। আমরা নিজেরা তক্তা কেটে ক্রিকেট ব্যাট বানাতাম। টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে হতো ক্রিকেট বল। বাঁশের কঞ্চি হতো আমাদের উইকেট। পায়ে জুতা স্যান্ডেল কিছুই থাকত না। প্যাড হেলমেটের তো প্রশ্নই থাকত না। আমরা টসে জিতলে ব্যাট নিতাম। নিজেদের ব্যাটিং শেষ হলে পরের টিমকে আর ব্যাটিংয়ের সুযোগ দিতাম না, কোনো ছলে ঝগড়া লাগিয়ে খেলার অবসান ঘটাতাম। আমাদেরও বল পুকুরে পড়লে আউট, দেয়ালে লাগলে চার, গাছে লাগলে দুই হতো।
এলবিডব্লু হতো না। ওয়াইড বলকে আমরা বলতাম হোয়াইট বল। পেনাল্টিকে আমরা বলতাম পেলান্টিক। গোলকিপারকে গোলকি।
এত দারিদ্র্য নিয়ে ক্রিকেট খেলা যায় না। ক্রিকেট রাজার খেলা, ক্রিকেট খেলার রাজা। আমাদের খেলা ছিল প্রজার খেলা—ফুটবল। স্কুলের বারান্দায় এক টুকরা ইট পড়ে থাকলে আমরা সেটা নিয়ে ‘ক্যারি কাটতে’ থাকতাম। ভলিবল খেলেছি, স্কুলে অবশ্য বাস্কেট বলও ছিল। ছোটবেলায় ছেলেমেয়ে মিলে খেলতাম দাঁড়িয়া বাঁধা, গোল্লাছুট। হাডুডু খেলায় আমি বিশেষ রকমের ভালো ছিলাম।
ক্রিকেটের প্রেমে পড়লাম বাংলাদেশ যেদিন থেকে আইসিসি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো, সেদিন থেকে। বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে গিয়েই বাংলাদেশ হারিয়ে দিল পাকিস্তানকে, সে কি ভাই যায়রে ভোলা! শচীন-সৌরভের ভারতকে বাংলাদেশের পুঁচকে সাকিব-তামিম-মুশফিক পিটিয়ে তুলোধুনো করেছিল আরেক বিশ্বকাপে। ভাষ্যকাররা বলছিলেন, ফিয়ারলেস ক্রিকেট। এখানেই আসে রবীন্দ্রনাথের কথা আর গান। বাংলাদেশ যেদিন ভয়হীন ক্রিকেট খেলে ভারত কিংবা ইংল্যান্ডকে হারায়, রবীন্দ্রনাথ তখন বলেন: ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’।
বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে খেলতে যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও...’ সাকিব আল হাসান যখন টি-টোয়েন্টির ক্যাপ্টেন হন এবং একাই লড়তে থাকেন, তখন এ কথা তাঁর মনে পড়েই: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। আর যখন সবাই মিলেই এক টিম হয়ে উঠে দারুণ ছন্দে খেলতে থাকেন, তখন রবিবাবুর গানে তাঁরা কণ্ঠ মেলান: ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সাথে মিলব কী শর্তে’। তারপর সাকিব বা লিটন যখন দেখেন, তাঁদের পার্টনাররা একে একে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা গেয়ে ওঠেন, ‘যেও না, যেও না ফিরে, দাঁড়াও বারেক দাঁড়াও হৃদয়-আসনে।’
কিন্তু ‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ আর মোস্তাফিজ যখন মার খেতে থাকেন, ছক্কা দিতে থাকেন, তার জন্যও রবিবাবু লিখে রেখে যেতে ভোলেননি, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দিব রে, ভীষণ ঝড়ের রাতে।’ কিংবা আশরাফুলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী, আমি সকল দাগে হব দাগী!’ আর এদিকে যখন বাম হাতি ব্যাটসম্যানের বিপরীতে বাম হাতি বোলার না দেওয়ার সিদ্ধান্তে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অটল থাকেন, তখন সাকিব গাইতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের গান: ‘বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোরে শকতি/ সকল হৃদয় লুটায়ে তোমারে করিতে প্রণতি।’ উইকেট পেলে সাকিব স্যালুট দেন, এখানে প্রণতি বলতে সেটাকেই বুঝিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ রসিক ছিলেন, তিনি যদি অ্যান্ড্রুজকে বলে থাকতে পারেন যে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ গানের ইংরেজি হচ্ছে ‘আই অ্যাম সুগার...’ তিনি বলতেই পারতেন, ‘বল দাও মানে, গিভ মি দ্য বোল, আই উল হিট দ্য মিডল স্টাম্প অ্যান্ড দেন টেক আ বাও।’
বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন ক্রিকেট-মাঠের চড়াই-উতরাইয়ের অভিব্যক্তি। ভারতে এখন কোনো বাঙালি খেলোয়াড় নেই, বেচারা পশ্চিমবঙ্গবাসী, বেচারা রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশিরাই আজ বিশ্বদরবারে রবীন্দ্রবার্তাবাহী! ইংরেজদের আছে শেক্সপিয়ার। তাদের দুই ব্যাটসম্যান যখন বলে, টু রান অর নট টু রান, দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন, তখনই ঘটে যায় রানআউট। দুর্বল ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যদি একজন ভালো ব্যাটসম্যানের আগমনের সুযোগ করে দেয়, শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের সংলাপ চলতে পারে: পার্টিং ইজ সাচ সুইট সরো।
রবীন্দ্রনাথ নিজে ক্রিকেট খেলতে নেমেছিলেন। বল এসে তাঁকে আঘাত করেছিল। এরপর তিনি আর ক্রিকেট খেলেননি।
আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার। ব্যাটসম্যানের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে (শর্ট লেগ?) ফিল্ডিং করছিলাম, ব্যাটসম্যানের ব্যাট সোজা এসে পিঠ বরাবর কোপ বসাল। ভাগ্যিস পিঠ ব্যাটের কানায় লাগেনি, লেগেছে ব্যাটের মাঝবরাবর, তাই বেঁচে আছি এবং লিখছি।
পৃথিবীর বড় ক্রিকেটলেখকেরা যেমন বড় সাহিত্যিকের সম্মান পাবেন, তেমনি বড় সাহিত্যিকেরাও ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন। শামসুর রাহমান, শীর্ষেন্দু, নির্মলেন্দু গুণ, এমনকি হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত। ক্রিকেট নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে—
‘তোমাদের গজগামিনীর দিনে;
কবির কল্পনা নেয়নি তো চিনে
কেনেনি ইসটিশনের টিকেট
হৃদয়ক্ষেত্রে খেলেনি ক্রিকেট।’
পাদটীকা: এবারের টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে নিয়ে আমার কোনো উত্তেজনা নেই। শঙ্কা আছে। হারাই হারাই সদা হয় ভয়। তবে আশাও আছে। শ্রীলঙ্কা যদি এশিয়া কাপ জিততে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন এবারের বিশ্বকাপে ভালো করবে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি,
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।
সাকিব, ভয়হীন ক্রিকেট খেলুন। দায়িত্বহীন নয়। মাঠে শতভাগ দিন। দেড় শ ভাগ আদায় করেন সহখেলোয়াড়দের কাছে। নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই (ফর্ম ফিরে পাওয়ার) দ্বার!
আমাদের এক বন্ধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছিল নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার আগে আগে, ‘এবার সাহিত্যে নোবেল পাওয়া উচিত উৎপল শুভ্রর!’
এ কথাটা রসিকতার ছলে বলেছে, একটু খোঁচা মেরে বলেছে, নাকি আসলেই এটাই ছিল বন্ধুর মনের চাওয়া, তা আর অনুসন্ধান করার প্রবৃত্তি হয়নি। কিন্তু ক্রিকেট-সাহিত্য বলতে জগতে খুবই শ্রদ্ধেয় একটা জনরা আছে; আর তার লেখকেরা সব ভুবনবিখ্যাত; নোবেল পুরস্কার তাঁদের কেউ যদি পেয়ে যান, তাহলে নোবেল পুরস্কারই হয়তো গৌরবান্বিত হবে। বব ডিলান যদি নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন; তাহলে কবির সুমন কেন নন? আর গানের লেখক-সুরকার পারফরমার যদি নোবেল পেতে পারেন, ক্রিকেট-সাহিত্যিকেরাই বা কেন বাদ থাকবেন। আর তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে আমার মনোনয়ন তো উৎপল শুভ্রই।
আমি ক্রিকেটের ক-ও বুঝি না। আমার সবকিছুই ক্ষণিকের আনন্দের জন্য। ‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ। উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল সেই তারি আনন্দ॥’ আমি সবকিছু করি আনন্দের জন্য। আইনস্টাইন বলেছেন, জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা মূল্যবান, আর আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে আনন্দ মূল্যবান। তবে এই আনন্দও রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া আনন্দের ধারণা; এটা আর যা-ই হোক, ইন্দ্রিয় সুখ নয়; ভোগের নয়, উপভোগের। ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, দিনরজনী কত অমৃত রস উথলি যায় অনন্ত গগনে।’ আমার আনন্দ, এই আনন্দ।
আমি ছোটবেলাটা কাটিয়েছি মাঠে-ঘাটে, অবাধ প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়েছি, বর্ষাবিস্ফারিত নদীতে ঝাঁপ দিয়েছি, জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি নৌকা বেয়েছি, গাছের একটা উঁচু নিঃসঙ্গ মগডালে সরীসৃপের মতো বুকে ঠেলে ঠেলে একা একা উঠে নামতে না পেরে ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছি; জম্বুরা, কচুরিপানার দলা, ন্যাকড়ার পোঁটলা, দেশলাইয়ের বাক্স—নানান কিছুকে ফুটবল বানিয়ে খেলেছি; বৃষ্টিতে জগৎ ভেসে যাওয়া প্রহরগুলো কাটিয়েছি ফুটবল পায়ে মাঠে কিংবা পাড় উপচানো খালে এবং আমি ক্রিকেটও খেলেছি।
আমাদের শৈশব ছিল দারিদ্র্যের শৈশব। আমরা নিজেরা তক্তা কেটে ক্রিকেট ব্যাট বানাতাম। টেনিস বলে টেপ পেঁচিয়ে হতো ক্রিকেট বল। বাঁশের কঞ্চি হতো আমাদের উইকেট। পায়ে জুতা স্যান্ডেল কিছুই থাকত না। প্যাড হেলমেটের তো প্রশ্নই থাকত না। আমরা টসে জিতলে ব্যাট নিতাম। নিজেদের ব্যাটিং শেষ হলে পরের টিমকে আর ব্যাটিংয়ের সুযোগ দিতাম না, কোনো ছলে ঝগড়া লাগিয়ে খেলার অবসান ঘটাতাম। আমাদেরও বল পুকুরে পড়লে আউট, দেয়ালে লাগলে চার, গাছে লাগলে দুই হতো।
এলবিডব্লু হতো না। ওয়াইড বলকে আমরা বলতাম হোয়াইট বল। পেনাল্টিকে আমরা বলতাম পেলান্টিক। গোলকিপারকে গোলকি।
এত দারিদ্র্য নিয়ে ক্রিকেট খেলা যায় না। ক্রিকেট রাজার খেলা, ক্রিকেট খেলার রাজা। আমাদের খেলা ছিল প্রজার খেলা—ফুটবল। স্কুলের বারান্দায় এক টুকরা ইট পড়ে থাকলে আমরা সেটা নিয়ে ‘ক্যারি কাটতে’ থাকতাম। ভলিবল খেলেছি, স্কুলে অবশ্য বাস্কেট বলও ছিল। ছোটবেলায় ছেলেমেয়ে মিলে খেলতাম দাঁড়িয়া বাঁধা, গোল্লাছুট। হাডুডু খেলায় আমি বিশেষ রকমের ভালো ছিলাম।
ক্রিকেটের প্রেমে পড়লাম বাংলাদেশ যেদিন থেকে আইসিসি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো, সেদিন থেকে। বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে গিয়েই বাংলাদেশ হারিয়ে দিল পাকিস্তানকে, সে কি ভাই যায়রে ভোলা! শচীন-সৌরভের ভারতকে বাংলাদেশের পুঁচকে সাকিব-তামিম-মুশফিক পিটিয়ে তুলোধুনো করেছিল আরেক বিশ্বকাপে। ভাষ্যকাররা বলছিলেন, ফিয়ারলেস ক্রিকেট। এখানেই আসে রবীন্দ্রনাথের কথা আর গান। বাংলাদেশ যেদিন ভয়হীন ক্রিকেট খেলে ভারত কিংবা ইংল্যান্ডকে হারায়, রবীন্দ্রনাথ তখন বলেন: ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’।
বাংলাদেশ যখন বিশ্বকাপে খেলতে যায়, তখন রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও...’ সাকিব আল হাসান যখন টি-টোয়েন্টির ক্যাপ্টেন হন এবং একাই লড়তে থাকেন, তখন এ কথা তাঁর মনে পড়েই: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। আর যখন সবাই মিলেই এক টিম হয়ে উঠে দারুণ ছন্দে খেলতে থাকেন, তখন রবিবাবুর গানে তাঁরা কণ্ঠ মেলান: ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সাথে মিলব কী শর্তে’। তারপর সাকিব বা লিটন যখন দেখেন, তাঁদের পার্টনাররা একে একে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা গেয়ে ওঠেন, ‘যেও না, যেও না ফিরে, দাঁড়াও বারেক দাঁড়াও হৃদয়-আসনে।’
কিন্তু ‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ আর মোস্তাফিজ যখন মার খেতে থাকেন, ছক্কা দিতে থাকেন, তার জন্যও রবিবাবু লিখে রেখে যেতে ভোলেননি, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দিব রে, ভীষণ ঝড়ের রাতে।’ কিংবা আশরাফুলকে যখন নিষিদ্ধ করা হয়, তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী, আমি সকল দাগে হব দাগী!’ আর এদিকে যখন বাম হাতি ব্যাটসম্যানের বিপরীতে বাম হাতি বোলার না দেওয়ার সিদ্ধান্তে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অটল থাকেন, তখন সাকিব গাইতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের গান: ‘বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোরে শকতি/ সকল হৃদয় লুটায়ে তোমারে করিতে প্রণতি।’ উইকেট পেলে সাকিব স্যালুট দেন, এখানে প্রণতি বলতে সেটাকেই বুঝিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ রসিক ছিলেন, তিনি যদি অ্যান্ড্রুজকে বলে থাকতে পারেন যে ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ গানের ইংরেজি হচ্ছে ‘আই অ্যাম সুগার...’ তিনি বলতেই পারতেন, ‘বল দাও মানে, গিভ মি দ্য বোল, আই উল হিট দ্য মিডল স্টাম্প অ্যান্ড দেন টেক আ বাও।’
বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন ক্রিকেট-মাঠের চড়াই-উতরাইয়ের অভিব্যক্তি। ভারতে এখন কোনো বাঙালি খেলোয়াড় নেই, বেচারা পশ্চিমবঙ্গবাসী, বেচারা রবীন্দ্রনাথ, বাংলাদেশিরাই আজ বিশ্বদরবারে রবীন্দ্রবার্তাবাহী! ইংরেজদের আছে শেক্সপিয়ার। তাদের দুই ব্যাটসম্যান যখন বলে, টু রান অর নট টু রান, দ্যাট ইজ দ্য কোশ্চেন, তখনই ঘটে যায় রানআউট। দুর্বল ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যদি একজন ভালো ব্যাটসম্যানের আগমনের সুযোগ করে দেয়, শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের সংলাপ চলতে পারে: পার্টিং ইজ সাচ সুইট সরো।
রবীন্দ্রনাথ নিজে ক্রিকেট খেলতে নেমেছিলেন। বল এসে তাঁকে আঘাত করেছিল। এরপর তিনি আর ক্রিকেট খেলেননি।
আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার। ব্যাটসম্যানের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে (শর্ট লেগ?) ফিল্ডিং করছিলাম, ব্যাটসম্যানের ব্যাট সোজা এসে পিঠ বরাবর কোপ বসাল। ভাগ্যিস পিঠ ব্যাটের কানায় লাগেনি, লেগেছে ব্যাটের মাঝবরাবর, তাই বেঁচে আছি এবং লিখছি।
পৃথিবীর বড় ক্রিকেটলেখকেরা যেমন বড় সাহিত্যিকের সম্মান পাবেন, তেমনি বড় সাহিত্যিকেরাও ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন। শামসুর রাহমান, শীর্ষেন্দু, নির্মলেন্দু গুণ, এমনকি হুমায়ূন আহমেদ পর্যন্ত। ক্রিকেট নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে—
‘তোমাদের গজগামিনীর দিনে;
কবির কল্পনা নেয়নি তো চিনে
কেনেনি ইসটিশনের টিকেট
হৃদয়ক্ষেত্রে খেলেনি ক্রিকেট।’
পাদটীকা: এবারের টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে নিয়ে আমার কোনো উত্তেজনা নেই। শঙ্কা আছে। হারাই হারাই সদা হয় ভয়। তবে আশাও আছে। শ্রীলঙ্কা যদি এশিয়া কাপ জিততে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন এবারের বিশ্বকাপে ভালো করবে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি,
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে,
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনই সে পলাইবে ধেয়ে।
সাকিব, ভয়হীন ক্রিকেট খেলুন। দায়িত্বহীন নয়। মাঠে শতভাগ দিন। দেড় শ ভাগ আদায় করেন সহখেলোয়াড়দের কাছে। নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই (ফর্ম ফিরে পাওয়ার) দ্বার!
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে