সৈকত দে
১
উপেন্দ্রকিশোরের মানসবিশ্ব গড়ে ওঠার পশ্চাৎপট মনে রাখতে হবে আমাদের সুকুমার রায়ের কথা ভাবতে গেলে। তাঁর ঠাকুরদা লোকনাথ রায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। রীতিমতো মানুষের মাথার খুলির মালা সহযোগে তিনি তন্ত্র সাধনা করতেন। লোকনাথের বাবা রামকান্ত খোল বাজিয়ে খোলা গলায় কীর্তন গাইতেন আর এত জোরে খোলে চাঁটি মারতেন যে ভালোভাবে আচ্ছাদিত খোলও অনেক সময় ফেটে যেত। তিনি পুত্রের এসব সাধনা পছন্দ করতেন না। একদিন সব সাধনার জিনিস ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেন। সেই শোকে পুত্র লোকনাথ মাত্র ৩২ বছরে ইহধাম ত্যাগ করেন আর তখন বউ কৃষ্ণমণি সন্তানসম্ভবা। কৃষ্ণমণির পুত্র কালীনাথ রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোরের বাবা।
কালীনাথ তিন ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন—আরবি, ফারসি আর সংস্কৃত। সুকণ্ঠ স্তবের জন্য ভক্ত শ্রোতামণ্ডলীতে তিনি ‘শ্যামসুন্দর’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। জন্মের সময় উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন এবং দূরসম্পর্কের এক কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে নিয়ে আসেন ও নাম পাল্টে দেন। উপেন্দ্রকিশোর আর রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় ১৮৮৫ সালের ১৫ জুন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর সুকুমার জন্মালেন ৷ ১৮৯২ সালের দিকে সুকুমার মসূয়া গ্রাম আর মধুপুরে হাওয়াবদলে এসেছিলেন সপরিবার। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারি দেখা দিলে রায়চৌধুরী পরিবার মসূয়ায় চলে আসেন কিছুদিনের জন্য। উপেন্দ্রপুত্র সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহের ‘যুবক বন্ধু’। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর চলে গেলেন। সেদিন ভোরবেলা জানালার পাশে একটা পাখি গান গেয়েছিল আর চারপাশে দণ্ডায়মান বিপন্ন আত্মীয়দের তিনি বললেন, ‘পাখি কী বলে গেল জানো? সে বললে, যাও চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।’ স্ত্রী বললেন, ‘চোখ বুঝলেই কী সুন্দর আলো দেখি, ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন।’
সুকুমার রায় বিদেশ থেকে ফেরার পর তাঁর বাবা-মায়ের পাত্রী খোঁজার সময় তিনি যে মন্তব্যটি করেন, তাতে তাঁর ধাতটা বোঝা যায়, ‘সুন্দরটুন্দর বুঝি না, দেখতে খারাপ না হলেই হলো। গান গাইতে পারলে ভালো হয়। আর ঠাট্টাতামাশা করলে যেন বুঝিয়ে বলতে না হয়।’ অর্থাৎ আজকালকার ভাষায় উইট আর সেন্স অব হিউমারসমৃদ্ধ জীবনসঙ্গীর অনুসন্ধানে ছিলেন সুকুমার রায়। সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায়, সাধক কালীনারায়ণ গুপ্তের নাতনি। কালীনারায়ণ অসংখ্য সাধনসংগীতের প্রণেতা। সুপ্রভা সুন্দর কণ্ঠের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেয়েছেনও একাধিকবার। ১৯১৩ সালে সুকুমার সুপ্রভার বিয়ে হয়।
বাংলা ১৩২৭ সালের মাঘ মাসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সুকুমার এবং ১৩২৮ সালের বৈশাখের ঊনবিংশ দিবসে জন্মালেন সত্যজিৎ। ১৯২১ সালে যে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সে কালান্তক ব্যাধি আর তাঁকে বাঁচতে দিল না। ১৯২৩ সালের ২৯ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ সুকুমারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আনন্দের, স্বস্তির, সুখের, পূর্ণতার গান শুনতে চেয়েছিলেন সুকুমার। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর অনুরোধে একাধিক গান গেয়েছিলেন ৷ একটা গান হচ্ছে–‘দুঃখ এ নহে সুখ নহে গো, গভীর শান্তি এ যে।’ ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া আটে চলে গেলেন সুকুমার। কলকাতায় সেদিন ভূমিকম্প ঘটার তথ্য নথিবদ্ধ আছে। মাধুরীলতা রায়ের স্মৃতিকথায় জানা যাচ্ছে, তাঁর শেষ কথা, ‘এইবার বেরিয়ে পড়ি।’ ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন সুকুমার রায় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। এই ছোট নিবন্ধে তাঁর সম্পর্কেই দু-একটা কথা বলা হবে।
২
৯ বছর বয়সে, ১৮৯৬ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৩০৩ সালের ২ জ্যৈষ্ঠ বালকদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ‘মুকুল’-এ প্রকাশ পেল সুকুমার রায়ের প্রথম রচনা। এটি ‘নদী’ নামে একটি কবিতা। অল্প বয়সে মুকুল পত্রিকাতে তাঁর একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালের নভেম্বর সংখ্যা ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অল এইজেস ডিভিশনের ‘পেটস’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পান। পরের বছর ‘রামধনবধ’ রচনা করেন বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যদিও পরবর্তীকালে পাণ্ডুলিপি লুপ্ত হয়ে গেছে ৷ ১৯০৬ সালে তিনি ফিজিকস আর কেমিস্ট্রিতে অনার্সসহ বিএসএসি পাস করেন। এবং তাঁর তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি পরের সময়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ তরুণ সুকুমারকে স্নেহ করতেন। ১৩১৮ সালে, ২৪-২৬ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৫০তম জন্মদিন উদ্যাপনের জন্য সুকুমার শান্তিনিকেতনে যান ৷ সেখানে তাঁর রচিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ?’ গান হয়। সেখানে ছিল—‘ওরে ভাই তোরে তাই কানে কানে কই রে, ঐ আসে, ঐ আসে, ঐ ঐ ঐ রে’। এই লাইন শুনে আশ্রমিকরা তাঁর নাম দেয়, ‘ঐ আসে?’ এই বছরের অক্টোবরে বোম্বে থেকে ‘এস এস অ্যারাবিয়া’ জাহাজে বিদেশ পাড়ি দেন ৷ প্যারিস, ক্যালে, ডোভার হয়ে লন্ডনে এলেন ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৫ নাগাদ। একদিন বিশ্রাম নিয়ে ২৫ তারিখ ‘লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব ফটোগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’-তে ভর্তি হলেন। পড়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ থেমে থাকছিল না। বন্ধ ছিল না অগ্রজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি স্ব-আরোপিত দায়িত্ব। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন এলেন ১৬ জুন। ১৯ জুন উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সনের বাড়ি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে নিবন্ধ পড়েন ৷ ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন সুকুমার। শ্রোতা হিসেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, রথেনস্টাইন সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদ পাঠ করেন এই সময়ে। উপস্থিত প্রকাশক, সম্পাদকেরা খুশি হন এই অনুবাদে। বলা যেতে পারে, উইজডম অব দ্য ইস্ট সিরিজের সম্পাদকের কথা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বছর তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। প্রতি রোববার উপাসনা হতো এখানে। অর্থাৎ সুকুমার রায় প্রবাসে থাকাকালেও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে বিচ্যুত হন নাই। ১৯১৩ সালের ১৫ জুন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণে গেলে সন্দেশ প্রথম সংখ্যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দ পাওয়ার কথা জানান। এই বছরের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ সুপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন। পান্তীর মাঠের কাছে ‘রাজমন্দির’-এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আসেন। ১৯১৮ সালের রবীন্দ্র জন্মদিনে গান গেয়ে শোনান সুপ্রভা।
বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিশীলতা সুকুমার রায়ের সকল লেখার অভিনিবেশের কেন্দ্র। খেয়ালখুশি বা ননসেন্স লেখাতেও তিনি কখনো কুসংস্কার প্রশ্রয় দেন নাই। সন্দেশ সম্পাদক হিসেবে লেখা শিক্ষাপ্রচারমূলক নিবন্ধ থেকে বিজ্ঞানী সুকুমারকে আমরা চিনে উঠতে পারি। বিজ্ঞান দুনিয়া, যন্ত্রসভ্যতার নিত্যনতুন আবিষ্কারের ইতিহাস কিশোরদের উপযোগী ভাষায় পরিবেশন করেছেন তিনি। পরিবেশনের গুণে কেবল গবেষক নয়, সাধারণ কিশোর পাঠকদের কাছেও লেখাগুলি অমূল্য। বাবা উপেন্দ্রকিশোর বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি, শিশুসাহিত্যের নিরলস ধারার কথা যদি উহ্য থাকে তবু। পুত্র সুকুমার, জানিয়েছি একটু মাত্র, মুদ্রণের নানা স্তরের অনুপুঙ্খ পাঠ নিতে গেলেন লন্ডনে। এবং, সে দেশেও নিজের প্রজ্ঞায় ও শ্রমে যথেষ্ট মনোযোগ ও সম্মান পেলেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত না হলে, আমরা আরও কত-কী যে পেতাম, বাংলা সাহিত্য আরও কত রং পেত, এসব আলাপ অনুশোচনাই বাড়াবে। তাই বলি, যা পেয়েছি, তা পাঠ ও চর্চায় যদি আমরা এই অসময়ে নিজের মন রঙিন সার্থক করতে পারি, তবেই সুকুমার রায়ের জীবনসাধনা নতুন মাত্রা পাবে।
সূত্র: এই রচনা সিদ্ধার্থ ঘোষের সুকুমার রায়সংক্রান্ত একাধিক রচনার কাছে ঋণী।
১
উপেন্দ্রকিশোরের মানসবিশ্ব গড়ে ওঠার পশ্চাৎপট মনে রাখতে হবে আমাদের সুকুমার রায়ের কথা ভাবতে গেলে। তাঁর ঠাকুরদা লোকনাথ রায় ছিলেন তন্ত্রসাধক। রীতিমতো মানুষের মাথার খুলির মালা সহযোগে তিনি তন্ত্র সাধনা করতেন। লোকনাথের বাবা রামকান্ত খোল বাজিয়ে খোলা গলায় কীর্তন গাইতেন আর এত জোরে খোলে চাঁটি মারতেন যে ভালোভাবে আচ্ছাদিত খোলও অনেক সময় ফেটে যেত। তিনি পুত্রের এসব সাধনা পছন্দ করতেন না। একদিন সব সাধনার জিনিস ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেন। সেই শোকে পুত্র লোকনাথ মাত্র ৩২ বছরে ইহধাম ত্যাগ করেন আর তখন বউ কৃষ্ণমণি সন্তানসম্ভবা। কৃষ্ণমণির পুত্র কালীনাথ রায় হলেন উপেন্দ্রকিশোরের বাবা।
কালীনাথ তিন ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন—আরবি, ফারসি আর সংস্কৃত। সুকণ্ঠ স্তবের জন্য ভক্ত শ্রোতামণ্ডলীতে তিনি ‘শ্যামসুন্দর’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। জন্মের সময় উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন এবং দূরসম্পর্কের এক কাকা হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে নিয়ে আসেন ও নাম পাল্টে দেন। উপেন্দ্রকিশোর আর রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। উপেন্দ্রকিশোরের বিয়ে হয় ১৮৮৫ সালের ১৫ জুন। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর সুকুমার জন্মালেন ৷ ১৮৯২ সালের দিকে সুকুমার মসূয়া গ্রাম আর মধুপুরে হাওয়াবদলে এসেছিলেন সপরিবার। ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগ মহামারি দেখা দিলে রায়চৌধুরী পরিবার মসূয়ায় চলে আসেন কিছুদিনের জন্য। উপেন্দ্রপুত্র সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহের ‘যুবক বন্ধু’। ১৯১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর উপেন্দ্রকিশোর চলে গেলেন। সেদিন ভোরবেলা জানালার পাশে একটা পাখি গান গেয়েছিল আর চারপাশে দণ্ডায়মান বিপন্ন আত্মীয়দের তিনি বললেন, ‘পাখি কী বলে গেল জানো? সে বললে, যাও চিরদিনের পথে এবার শান্তিতে যাও।’ স্ত্রী বললেন, ‘চোখ বুঝলেই কী সুন্দর আলো দেখি, ভগবান কত দয়া করে আমাকে পরকালের পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন।’
সুকুমার রায় বিদেশ থেকে ফেরার পর তাঁর বাবা-মায়ের পাত্রী খোঁজার সময় তিনি যে মন্তব্যটি করেন, তাতে তাঁর ধাতটা বোঝা যায়, ‘সুন্দরটুন্দর বুঝি না, দেখতে খারাপ না হলেই হলো। গান গাইতে পারলে ভালো হয়। আর ঠাট্টাতামাশা করলে যেন বুঝিয়ে বলতে না হয়।’ অর্থাৎ আজকালকার ভাষায় উইট আর সেন্স অব হিউমারসমৃদ্ধ জীবনসঙ্গীর অনুসন্ধানে ছিলেন সুকুমার রায়। সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা রায়, সাধক কালীনারায়ণ গুপ্তের নাতনি। কালীনারায়ণ অসংখ্য সাধনসংগীতের প্রণেতা। সুপ্রভা সুন্দর কণ্ঠের জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গেয়েছেনও একাধিকবার। ১৯১৩ সালে সুকুমার সুপ্রভার বিয়ে হয়।
বাংলা ১৩২৭ সালের মাঘ মাসে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সুকুমার এবং ১৩২৮ সালের বৈশাখের ঊনবিংশ দিবসে জন্মালেন সত্যজিৎ। ১৯২১ সালে যে কালাজ্বরে আক্রান্ত হলেন সে কালান্তক ব্যাধি আর তাঁকে বাঁচতে দিল না। ১৯২৩ সালের ২৯ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ সুকুমারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আনন্দের, স্বস্তির, সুখের, পূর্ণতার গান শুনতে চেয়েছিলেন সুকুমার। রবীন্দ্রনাথ বন্ধুর অনুরোধে একাধিক গান গেয়েছিলেন ৷ একটা গান হচ্ছে–‘দুঃখ এ নহে সুখ নহে গো, গভীর শান্তি এ যে।’ ১০ সেপ্টেম্বর সকাল সোয়া আটে চলে গেলেন সুকুমার। কলকাতায় সেদিন ভূমিকম্প ঘটার তথ্য নথিবদ্ধ আছে। মাধুরীলতা রায়ের স্মৃতিকথায় জানা যাচ্ছে, তাঁর শেষ কথা, ‘এইবার বেরিয়ে পড়ি।’ ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৩ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন সুকুমার রায় মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। এই ছোট নিবন্ধে তাঁর সম্পর্কেই দু-একটা কথা বলা হবে।
২
৯ বছর বয়সে, ১৮৯৬ সালে অর্থাৎ বাংলা ১৩০৩ সালের ২ জ্যৈষ্ঠ বালকদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ‘মুকুল’-এ প্রকাশ পেল সুকুমার রায়ের প্রথম রচনা। এটি ‘নদী’ নামে একটি কবিতা। অল্প বয়সে মুকুল পত্রিকাতে তাঁর একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯০৪ সালের নভেম্বর সংখ্যা ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অল এইজেস ডিভিশনের ‘পেটস’ বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার পান। পরের বছর ‘রামধনবধ’ রচনা করেন বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যদিও পরবর্তীকালে পাণ্ডুলিপি লুপ্ত হয়ে গেছে ৷ ১৯০৬ সালে তিনি ফিজিকস আর কেমিস্ট্রিতে অনার্সসহ বিএসএসি পাস করেন। এবং তাঁর তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি পরের সময়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ তরুণ সুকুমারকে স্নেহ করতেন। ১৩১৮ সালে, ২৪-২৬ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ৫০তম জন্মদিন উদ্যাপনের জন্য সুকুমার শান্তিনিকেতনে যান ৷ সেখানে তাঁর রচিত ‘অদ্ভুত রামায়ণ?’ গান হয়। সেখানে ছিল—‘ওরে ভাই তোরে তাই কানে কানে কই রে, ঐ আসে, ঐ আসে, ঐ ঐ ঐ রে’। এই লাইন শুনে আশ্রমিকরা তাঁর নাম দেয়, ‘ঐ আসে?’ এই বছরের অক্টোবরে বোম্বে থেকে ‘এস এস অ্যারাবিয়া’ জাহাজে বিদেশ পাড়ি দেন ৷ প্যারিস, ক্যালে, ডোভার হয়ে লন্ডনে এলেন ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৫ নাগাদ। একদিন বিশ্রাম নিয়ে ২৫ তারিখ ‘লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল স্কুল অব ফটোগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি’-তে ভর্তি হলেন। পড়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ থেমে থাকছিল না। বন্ধ ছিল না অগ্রজ বন্ধু রবীন্দ্রনাথের প্রতি স্ব-আরোপিত দায়িত্ব। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন এলেন ১৬ জুন। ১৯ জুন উইলিয়াম উইনস্ট্যানলি পিয়ার্সনের বাড়ি বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে নিবন্ধ পড়েন ৷ ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেন সুকুমার। শ্রোতা হিসেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, রথেনস্টাইন সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদ পাঠ করেন এই সময়ে। উপস্থিত প্রকাশক, সম্পাদকেরা খুশি হন এই অনুবাদে। বলা যেতে পারে, উইজডম অব দ্য ইস্ট সিরিজের সম্পাদকের কথা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বছর তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়। প্রতি রোববার উপাসনা হতো এখানে। অর্থাৎ সুকুমার রায় প্রবাসে থাকাকালেও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে বিচ্যুত হন নাই। ১৯১৩ সালের ১৫ জুন রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণে গেলে সন্দেশ প্রথম সংখ্যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দ পাওয়ার কথা জানান। এই বছরের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ সুপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন। পান্তীর মাঠের কাছে ‘রাজমন্দির’-এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আসেন। ১৯১৮ সালের রবীন্দ্র জন্মদিনে গান গেয়ে শোনান সুপ্রভা।
বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিশীলতা সুকুমার রায়ের সকল লেখার অভিনিবেশের কেন্দ্র। খেয়ালখুশি বা ননসেন্স লেখাতেও তিনি কখনো কুসংস্কার প্রশ্রয় দেন নাই। সন্দেশ সম্পাদক হিসেবে লেখা শিক্ষাপ্রচারমূলক নিবন্ধ থেকে বিজ্ঞানী সুকুমারকে আমরা চিনে উঠতে পারি। বিজ্ঞান দুনিয়া, যন্ত্রসভ্যতার নিত্যনতুন আবিষ্কারের ইতিহাস কিশোরদের উপযোগী ভাষায় পরিবেশন করেছেন তিনি। পরিবেশনের গুণে কেবল গবেষক নয়, সাধারণ কিশোর পাঠকদের কাছেও লেখাগুলি অমূল্য। বাবা উপেন্দ্রকিশোর বাংলা মুদ্রণ ইতিহাসে একজন কিংবদন্তি, শিশুসাহিত্যের নিরলস ধারার কথা যদি উহ্য থাকে তবু। পুত্র সুকুমার, জানিয়েছি একটু মাত্র, মুদ্রণের নানা স্তরের অনুপুঙ্খ পাঠ নিতে গেলেন লন্ডনে। এবং, সে দেশেও নিজের প্রজ্ঞায় ও শ্রমে যথেষ্ট মনোযোগ ও সম্মান পেলেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে প্রয়াত না হলে, আমরা আরও কত-কী যে পেতাম, বাংলা সাহিত্য আরও কত রং পেত, এসব আলাপ অনুশোচনাই বাড়াবে। তাই বলি, যা পেয়েছি, তা পাঠ ও চর্চায় যদি আমরা এই অসময়ে নিজের মন রঙিন সার্থক করতে পারি, তবেই সুকুমার রায়ের জীবনসাধনা নতুন মাত্রা পাবে।
সূত্র: এই রচনা সিদ্ধার্থ ঘোষের সুকুমার রায়সংক্রান্ত একাধিক রচনার কাছে ঋণী।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে