নওশাদ জামিল
বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় ‘হিজিবিজি’র আছে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, আছে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লেখার ভেতর আনন্দ পাচ্ছিলেন না, ভিন্নধারার কোনো সৃষ্টিসুখের জন্য পিয়াসি, তখন লেখার খাতায় হিজিবিজি নানা কিছু কাটাকুটি করতেন মনের খেয়ালে। একদিন হঠাৎ তাঁর ওই খাতা চোখে পড়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। খাতা দেখেই বিস্মিত হন তিনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন খাতার দিকে। ওকাম্পো খেয়াল করেন, কবিগুরুর লেখার খাতায় কাটাকুটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘সব রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল’। তারপরের ইতিহাস জানেন সবাই। হুমায়ূন আহমেদের শেষজীবনের লেখা বেশ কয়েকটি বই পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল এ কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাটাকুটি আর হুমায়ূন আহমেদের রচনার সঙ্গে দৃশ্যত কোনো মিল নেই। তবে কেন এ কথা মনে পড়ল? বইয়ের নাম যখন ‘হিজিবিজি’, ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’, ফাউন্টেন পেন’ ও ‘রংপেন্সিল’ হয়, তখন চলে আসে আঁকিবুঁকির প্রসঙ্গ। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সে রংতুলির কাছে সঁপে দিয়েছিলেন, চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেকে। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক তেমন নন, যদিও আমরা তাঁর ছবি আঁকার কথা জানি। এ কারণেই প্রসঙ্গের অবতারণা।
দুই লেখকের এ সাদৃশ্য তলিয়ে ভাবলে আমরা কিছু মিল-অমিল খুঁজে পাব। যেমন, একজন জীবনসায়াহ্নে এঁকেছেন চিত্রকর্ম, অন্যজন শেষজীবনে রচনা করেছেন যেন ‘লেখচিত্র’! হুমায়ূন আহমেদের মনোরাজ্যের যত এলোমেলো বিষয় ও ভাবনা ছিল, লেখার সময় তা যেন লেখচিত্র হয়েই উঠে এসেছে তাঁর খাতায়। হুমায়ূন আহমেদ লেখচিত্র আঁকতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন নানা ‘চাবি-বিষয়’। এ ছাড়াও তাঁর শেষজীবনের লেখায় আমরা পাব দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা। প্রথমটি ‘লেখচিত্র’, অন্যটি ‘কলম ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গি’। মূলত এই বিষয়গুলো নিয়েই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
চাবি-বিষয় হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনাকৌশল। তাঁর এ প্রকৌশল কিংবা নির্মাণকলা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিষয় নির্বাচন করে এগিয়ে যাওয়া; যেখানে থেমে যাবে, সেখানে থামিয়ে দেওয়া। এ জন্য দরকার একটি ‘চাবি-বিষয়’। কবিতায় আমরা ‘চাবি-শব্দ’-এর কথা জানি। যেমন ধরা যাক, গ্রামকেন্দ্রিক একটি কবিতা লেখা হবে। কবিতার জন্য কবি একটা ‘চাবি-শব্দ’ নির্বাচন করেন। হতে পারে তা ‘মেলা’ কিংবা ‘হাট’ অথবা ‘নদী’ নয়তো অন্য কিছু। তারপর ওই শব্দ ঘিরে অন্যান্য অনুষঙ্গ আসবে। ফরাসি দেশের কবি মালার্মে যখন শব্দকে কবিতার প্রধান শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন, কাব্যসমালোচক অনেকে বলেন, তখন থেকেই আধুনিক কবিতায় শব্দভিত্তিক নির্মাণ খেলা শুরু হয়। যদিও প্রকৃত কবিতা এগিয়ে যায় তার স্বতঃস্ফূর্ততার জোরেই; তারপরও অনেকে চাবি-শব্দের কথা উল্লেখ করেন কবিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। যেমন, কবি রফিক আজাদের অনেক কবিতায় সমালোচকেরা দেখেছেন চাবি-শব্দের ব্যবহার। কিন্তু গদ্যসাহিত্যে চাবি-বিষয়ের তেমন আলোচনা নেই, বলা যায় মুক্তগদ্যে এর তেমন ব্যবহারও নেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ শেষজীবনের বিভিন্ন স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী বা তাঁর মুক্তগদ্যে এটি ব্যবহার করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গেই। তাঁর ‘হিজিবিজি’, ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’, ‘ফাউন্টেন পেন’ ও ‘রংপেন্সিল’ বইয়ে চাবি-বিষয় নির্বাচন করে লেখা শুরু করেছেন। তারপর ওই বিষয় ঘিরে আবর্তিত হয়েছে অন্যান্য প্রসঙ্গ। যেমন ‘বলপয়েন্ট’ গ্রন্থের ‘৫’ নম্বর শীর্ষক রচনার কথা বলব। এতে ‘চাবি-বিষয়’ আহমদ ছফা। এ লেখকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, তাঁর লেখালেখিতে আহমদ ছফার অবদান স্বীকার করতে গিয়ে নানা প্রসঙ্গ এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। যেমন শুরুতেই এনেছেন রাজধানীর প্রয়াত হন্টন পীরের কথা, বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের চিত্র। পাঠক, লক্ষ করবেন এসব বিষয় আবর্তিত হয়েছে আহমদ ছফাকে কেন্দ্র করে। ঠিক এমনভাবে অন্যান্য রচনাতেও নির্দিষ্ট বিষয় কিংবা চাবি-বিষয় নির্বাচন করে সাদা কাগজে কলম ছেড়ে দিয়েছেন, যখন থেমেছে কলমের গতি; রচনার গতিও থামিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ এসব একেকটি রচনা ২-৩ থেকে ৮-১০ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমা টেনেছেন। অর্থাৎ, হুমায়ূন আহমেদ নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন করেই ছোট ছোট রচনা লিখেছেন স্মৃতিকথা লেখার ভঙ্গিতে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘কাঠপেন্সিল’ বইয়ের একটি রচনার শিরোনাম ‘উৎসর্গপত্র’। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে চাবি-বিষয় লেখকদের উৎসর্গবিষয়ক লেখা। লেখক এ রচনার মূল বিষয় ধরে এগিয়ে গেছেন তরতর গতিতে, তুলে ধরেছেন উৎসর্গবিষয়ক তাঁর ও অন্যান্য লেখকের মজাদার এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি। মূল বিষয় ‘উৎসর্গ’, এরপর বিষয় ঘিরে অন্যান্য বিষয়ের আবির্ভাব। একই বইয়ের পরবর্তী রচনা ‘উন্মাদ-কথা’। এখানে চাবি-বিষয় হচ্ছে ‘উন্মাদ’, একটি জনপ্রিয় কার্টুন পত্রিকা এটি। লেখকের ছোট ভাই এর সম্পাদক। উন্মাদ পত্রিকার কথা বলতে গিয়ে একে একে এসেছে নানা প্রসঙ্গ। মূলত তা আহসান হাবীব ও তাঁর পত্রিকা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদের এমন প্রবণতার একটি গ্রন্থ ‘হিজিবিজি’। বইয়ের নাম হিসেবে তা খুব চমকপ্রদ বটে, কিন্তু গুরুত্বহীন নয়। কেননা, লেখকের রচনার সঙ্গে এ নাম সাযুজ্যপূর্ণ এবং অর্থবহ। ‘হিজিবিজি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আঁকাবাঁকা রেখাযুক্ত অর্থহীন অস্পষ্ট লেখা। অর্থাৎ নানা রেখার সঙ্গে নানা ভাবনার সাঁকোবন্ধন। তবে ভাবনাগুলো হবে শিশুমনের মতো আনন্দময়। বড়রা যেমন কোনো কিছু পরিকল্পনা করে, মনের ভেতর একটা অবয়ব এঁকে, নকশা কেটে লেখাটা দাঁড় করান, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের রচনা হিজিবিজি সে রকম নয়। তবে কোন রকমের? যদি এক কথায় বলতে হয় তবে বলব, সাদা কাগজে কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা। বিচিত্র বিষয়ে শিশুদের মতো একটানা লিখে গেছেন এই কলম-জাদুকর।
‘হিজিবিজি’ গল্প নয়, উপন্যাসও নয়। ভ্রমণকাহিনি, সায়েন্স ফিকশনও নয়। তবে একে কি জার্নাল বলা যেতে পারে? ঠিক তা-ও হয়তো পুরোপুরি নয়। কেননা, সঠিক কোনো জ্যামিতিক অবয়ব, ফর্ম বা প্রকরণগত কোনো নিয়ম নেই এতে। লেখক গল্প করতে করতে চলে যাচ্ছেন গল্পের ভেতরে, উপন্যাসের অন্তরে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে লেখক চলে যাচ্ছেন ওই বিষয়ের ইতিহাসে, বিষয়ের সঙ্গে তাঁর অতীত স্মৃতিতে। কখনো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে, কখনো মজাদার কিংবা চমকপ্রদ ডেটা দিয়ে স্মৃতি-বিস্মৃতি থেকে তুলে আনছেন নানা কাহন। ফলে এতে পাওয়া যাচ্ছে নানা ফলের, নানা ফুলের ছোঁয়া।
বইটিতে স্থান পেয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এমন কিছু রচনা, যাতে পাওয়া যায় তাঁর বহুমাত্রিক পরিচয়। আত্মজৈবনিক কিছু রচনা আছে, সেখানে স্থান পেয়েছে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও নিজস্ব অনুভূতি। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি বিষয়েও আছে একাধিক রচনা। এতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মিলবে। টেলিভিশন নাটক ও রিয়্যালিটি শো নিয়েও আছে দুটি রচনা। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং দেশের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে দুটি লেখায়। অন্য কিছু লেখাতেও বাংলাদেশ আর বাঙালি স্মৃতির প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অসামান্য দরদ, অনুরাগে। বইটির সর্বশেষ লেখা ‘মাইন্ড গেইম’। এতে ফুটে উঠেছে জীবনের এক মহৎ এবং গভীর বেদনাবোধ।
হুমায়ূন আহমেদ আমৃত্যু লিখেছেন তাঁর সহজিয়া ভাষায়। সহজ-সরল ভাষায় স্নিগ্ধ ও অনাবিল হাস্যরস এবং জীবনের আপাত-উপরিতলের কথা বলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তিনি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গভীর সংকেত লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর রচনায়। তাঁর গদ্যরীতিতে যে সাবলীল গতি এবং বর্ণনার পরিবর্তে কথোপকথন ও সংলাপের প্রাধান্য দেখা যায়, তা সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সহজবোধ্য। এই বইটিতেও তা লক্ষ করা যায়। বইটি বিচিত্র বিষয়ে লেখা হলেও সব রচনাই রসবোধ ও অসাধারণ রচনাশৈলীতে সমৃদ্ধ। আশ্চর্য সারল্য আর মনকাড়া উপস্থাপনার যে বৈশিষ্ট্য একান্তই হুমায়ূন আহমেদের, এর পরিচয় পাওয়া যাবে বইটির প্রতিটি রচনায়।
সূচনা কথায় বইটির প্রকাশক অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রেক্ষাপট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়। ধ্রুব এষ গ্রন্থটির জন্য প্রচ্ছদও তৈরি করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রচ্ছদ দেখে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, বইটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার আগেই অন্তহীন এক ভ্রমণে রওনা হয়ে গেছেন তিনি, একাকী, নিঃসঙ্গ। ছাপার আগে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতেন, মতামত জানাতেন। হিজিবিজি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ, যেটির প্রচ্ছদ তিনি দেখেছেন, অনুমোদন দিয়েছেন ছাপানোর। তাই গ্রন্থটির স্মারক-তাৎপর্যও কম নয়।’
বইটিতে স্থান পেয়েছে লেখকের নানা সময়ে লেখা মোট ২৬টি রচনা। এসব রচনা লেখকের ‘চাবি-বিষয়’ ও ‘লেখচিত্র’, ‘কলম ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গি’ প্রবণতাগুলো লক্ষণীয়। প্রথম রচনা ‘মা’, এতে আশ্চর্য কুশলতায় জননী আয়েশা ফয়েজ এবং তাঁদের পারিবারিক নানা টুকরো গল্প বলেছেন তিনি। পড়তে পড়তে পাঠকও হয়ে পড়েন আপ্লুত, অভিভূত। ‘কবি সাহেব’ রচনাটি অসাধারণ। সংসার উদাসী, অন্যমনস্ক ও বেখেয়ালি এক কবির নানা দিক উঠে এসেছে এ রচনায়। অত্যন্ত ঝরঝরে ভাষা, নির্ভার ও সতেজ হাস্যরসে তা বর্ণনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এ ছাড়াও ‘লাউ মন্ত্র’, ‘মাসাউকি খাতাঁওরা’, ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’, ‘বর্ষাযাপন’, ‘অয়োময়’, ‘বহুত দিন হোয়ে’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘একজন আমেরিকানের চোখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব’ ইত্যাদি রচনায় লেখক তাঁর প্রাণবন্ত সুর ও মেজাজকে ধরে রেখেছেন, পাঠককে নিয়ে গেছেন রচনার মর্মস্থলে। ফলে পাঠকও একটি বিষয় ধরে জানতে পারছেন নানা বিষয়, পরিচিত হতে পারছেন নানা ঘটনার সঙ্গে। বইটিতে আরও রয়েছে সমসাময়িক সমাজ আর রাজনৈতিক ভাবনামূলক কয়েকটি লেখা, সেগুলো মূলত সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা দূরদর্শিতা কিংবা রাজনৈতিক দর্শন উঠে এসেছে সুন্দর ও সুচারুভাবে। ‘অধ্যাপক ইউনূস’ কিংবা ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ’ শীর্ষক রচনায় উঠে এসেছে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর দর্শন ও চিন্তাভাবনা। হাস্যচ্ছলে, কিছুটাবা খোঁচা মেরে তিনি বলেছেন আমাদের নীচতা ও শঠতার কথা। বলেছেন সমাজের লোভ ও লালসার কথা। অতীতেও আমরা জানি, হুমায়ূন আহমেদ দেশ ও জাতির সংকটে কলম ধরেছেন। নিজের মতামত দিয়েছেন। সজাগ করেছেন আমাদের বিবেক, বিবেচনাবোধকে। বইটির অন্যান্য রচনা ‘নিষিদ্ধ গাছ’, ‘জ্বিনের বাদশাহ্’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’, ‘জ্বিন এবং পক্ষীকথা’ ইত্যাদি অংশও চমৎকার ও অসাধারণ। গল্প বলবার ভঙ্গিতে, কিছুটা আড্ডার ছলে বলেছেন নিজের অনুভূতি, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্মৃতি ও মজাদার কোনো ঘটনার সারসংক্ষেপ।
বলা যায়, এসব লেখকের খেয়ালি মনের আরেকটি সৃজনব্যঞ্জনা। ডায়েরি লেখার মতো করে নয়, আবার দিনলিপিও নয়, মনের খেয়ালে যখন খুশি তখন লিখেছেন এ রচনাগুলো। এতে বিচিত্র বিষয়ে একটানা লিখে যাওয়া হলেও তা অর্থহীন অস্পষ্ট লেখা নয়। বরং তা অনেক বেশি স্পষ্ট ও সরাসরি কথা বলার রীতি। যখন যা মনে এসেছে, তিনি লিখেছেন। কার্পণ্য করেননি লেখার সঙ্গে, বিশ্বাসঘাতকতা করেননি স্মৃতির সঙ্গে। যখন লেখা থেমে গেছে, তিনি কলম থামিয়ে দিয়েছেন। পাঠক এ ধরনের লেখা পাঠে একটা অদ্ভুত মজা পাবেন। মজা পাবেন দুটি কারণে। প্রথমত, বিচিত্র সব তথ্য জানার জন্য ও দ্বিতীয়ত, তাঁর রসবোধের জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের এই প্রবণতা তাঁর বেশ কয়েকটি বইয়ে লক্ষণীয়। মূলত প্রথাগত আত্মকথা না লিখে, বলা যায় এ প্রবণতায়, এ প্রকৌশলে, ঠিক যখন যে স্মৃতি মনে উঁকি দিয়েছে মনে, একটানা তা লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের তিনটি বই ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’ ও ‘ফাউন্টেন পেন’ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এক মলাটে। এই তিনটি বই মিলেই তাঁর সংকলিত গ্রন্থ ‘আমি’। বইয়ের নাম ‘আমি’ কেন, লেখক এর একটি গূঢ় রহস্যও উন্মোচন করেছেন। সূচনা কথায় বলেছেন, ‘আমার কিছু অপছন্দের শব্দের একটি হলো “আমি”। আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি, তখন আমির সঙ্গে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং পরে আমি বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে, জীবিত অবস্থায় আমি বলে কিছু নেই। “আমি” সংকলনটিতে আমার সঙ্গে সবাই আছেন। আমি নিজেকে কল্পনা করেছি দিঘির জলের সঙ্গে, যেখানে সবার ছায়া পড়েছে। “আমি” হলো ছায়ার গল্প।’
যাপিত জীবনে নানা ঘটনার প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছে তাঁর এ জাতীয় রচনায়। ‘বলপয়েন্ট’ বইটির কথা বলা যাক। একজন লেখকের লেখার কৌশল, বলার ভঙ্গিমা, তাঁর পঠন-পাঠন, বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ, লেখালেখির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে বইটিতে। মূলত তা লেখকজীবনেরই একটা খণ্ডচিত্র; লেখকজীবনেরই ইতিহাস। মোট ২১টি রচনা মিলে এ গ্রন্থ। তাতে তাঁর কলাকৌশল, লেখার অভিজ্ঞতা যেমন তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমন করে মেলে ধরেছেন অতীত দিনের স্মৃতিকথাও। ফলে এ ধরনের অন্যান্য রচনার মতো এখানে তাঁর আত্মকথা উঠে এসেছে অবলীলায়।
হুমায়ূন আহমেদের এসব রচনা আত্মকথা হলেও সময় ও ঘটনার ধারাবাহিকতা নেই। যখন যা মনে এসেছে, তখন তা-ই লিখেছেন। কালক্রমিক ধারাপ্রবাহ রক্ষা হয়নি, কিন্তু লেখার গতিও থামেনি। আশ্চর্য কৌশল এটি। অধিকাংশ লেখক যখন স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন; যেমন ছেলেবেলা, শৈশব-কৈশোর, কর্মময় জীবনসহ নানা বয়সের ছোপ উল্লেখ করেন, হুমায়ূন আহমেদ ওই পথ মাড়াননি। নিজের মতো করে, নিজস্ব স্টাইলে তা বর্ণনা করেছেন। এখানেই তাঁর মুনশিয়ানা প্রতিফলিত হয়।
হুমায়ূন আহমেদের এসব রচনায় এ প্রবণতা লক্ষ করা যাবে। ‘কাঠপেন্সিল’ বইটিতে চাবি-বিষয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। বিষয় নির্বাচন করে এ বইটিতেও তিনি কলম ছেড়ে দিয়েছেন সাদা খাতায়। তাতে উঠে এসেছে স্মৃতিচারণ, উঠে এসেছে তাঁর বিচিত্র বিষয়ের প্রতি আগ্রহ। কৌতূহল। যেমন ‘কাঠপেন্সিল’-এর কিছু চাবি-বিষয় বলা যাক। ‘আড্ডা’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘উৎসর্গপত্র’, ‘লেখক-বন্ধ’, ‘উন্মাদ-কথা’ ইত্যাদি। বিষয় ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর রচনা। প্রতিটি রচনা পরিকল্পিত, কিন্তু বলবার ভঙ্গি মজলিশি। ফলে পাঠক পড়তে গিয়ে স্বাদ পান আড্ডার, গল্পকথার।
হুমায়ূন আহমেদের একই কৌশলের গ্রন্থ ‘ফাউন্টেন পেন’। লেখক এ বইটিতেও চাবি-বিষয় নির্বাচন করে লিখেছেন স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরাল। বিষয় নির্বাচন করে লেখা এগিয়েছে, সঠিক কথাটি বলা হয়ে গেলে লেখাও থেমে গেছে। মূলত এসব বিষয়ের ভেতর দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, বিচিত্র বিষয়ে পঠন-পাঠন, তাঁর যাপিত জীবনে লেখক হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন। কত বিচিত্র বিষয়ে যে তাঁর আগ্রহ! মূলত এ আগ্রহের কারণেই ওই বিষয় নিয়ে বিস্তর পরিশ্রম করেছেন, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের শেষজীবনের লেখা এসব রচনা পড়তে গিয়ে মনে হয়, লেখক হওয়ার জন্য প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা যেমন দরকার, তেমনই দরকার সাধনা, পরিশ্রম এবং উপযুক্ত নির্মাণকৌশল। প্রতিভার সঙ্গে জানতে হয় কারিগরি নানা দিকও। মূলত এসবের চমৎকার সংমিশ্রণেই একজন বড় লেখক। প্রকৃত লেখক। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে এসব গুণ ছিল প্রবলভাবেই। তাঁকে জানতে, বুঝতে; তাঁর রচনা অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর শেষ বয়সের এসব বই। শুধু ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যবিত্তের বিকাশ জানতে হলেও অবশ্যপাঠ্য এসব বই।
বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় ‘হিজিবিজি’র আছে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, আছে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন লেখার ভেতর আনন্দ পাচ্ছিলেন না, ভিন্নধারার কোনো সৃষ্টিসুখের জন্য পিয়াসি, তখন লেখার খাতায় হিজিবিজি নানা কিছু কাটাকুটি করতেন মনের খেয়ালে। একদিন হঠাৎ তাঁর ওই খাতা চোখে পড়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর। খাতা দেখেই বিস্মিত হন তিনি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন খাতার দিকে। ওকাম্পো খেয়াল করেন, কবিগুরুর লেখার খাতায় কাটাকুটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘সব রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল’। তারপরের ইতিহাস জানেন সবাই। হুমায়ূন আহমেদের শেষজীবনের লেখা বেশ কয়েকটি বই পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল এ কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাটাকুটি আর হুমায়ূন আহমেদের রচনার সঙ্গে দৃশ্যত কোনো মিল নেই। তবে কেন এ কথা মনে পড়ল? বইয়ের নাম যখন ‘হিজিবিজি’, ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’, ফাউন্টেন পেন’ ও ‘রংপেন্সিল’ হয়, তখন চলে আসে আঁকিবুঁকির প্রসঙ্গ। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ বয়সে রংতুলির কাছে সঁপে দিয়েছিলেন, চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেকে। হুমায়ূন আহমেদ ঠিক তেমন নন, যদিও আমরা তাঁর ছবি আঁকার কথা জানি। এ কারণেই প্রসঙ্গের অবতারণা।
দুই লেখকের এ সাদৃশ্য তলিয়ে ভাবলে আমরা কিছু মিল-অমিল খুঁজে পাব। যেমন, একজন জীবনসায়াহ্নে এঁকেছেন চিত্রকর্ম, অন্যজন শেষজীবনে রচনা করেছেন যেন ‘লেখচিত্র’! হুমায়ূন আহমেদের মনোরাজ্যের যত এলোমেলো বিষয় ও ভাবনা ছিল, লেখার সময় তা যেন লেখচিত্র হয়েই উঠে এসেছে তাঁর খাতায়। হুমায়ূন আহমেদ লেখচিত্র আঁকতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন নানা ‘চাবি-বিষয়’। এ ছাড়াও তাঁর শেষজীবনের লেখায় আমরা পাব দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা। প্রথমটি ‘লেখচিত্র’, অন্যটি ‘কলম ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গি’। মূলত এই বিষয়গুলো নিয়েই এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
চাবি-বিষয় হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনাকৌশল। তাঁর এ প্রকৌশল কিংবা নির্মাণকলা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিষয় নির্বাচন করে এগিয়ে যাওয়া; যেখানে থেমে যাবে, সেখানে থামিয়ে দেওয়া। এ জন্য দরকার একটি ‘চাবি-বিষয়’। কবিতায় আমরা ‘চাবি-শব্দ’-এর কথা জানি। যেমন ধরা যাক, গ্রামকেন্দ্রিক একটি কবিতা লেখা হবে। কবিতার জন্য কবি একটা ‘চাবি-শব্দ’ নির্বাচন করেন। হতে পারে তা ‘মেলা’ কিংবা ‘হাট’ অথবা ‘নদী’ নয়তো অন্য কিছু। তারপর ওই শব্দ ঘিরে অন্যান্য অনুষঙ্গ আসবে। ফরাসি দেশের কবি মালার্মে যখন শব্দকে কবিতার প্রধান শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন, কাব্যসমালোচক অনেকে বলেন, তখন থেকেই আধুনিক কবিতায় শব্দভিত্তিক নির্মাণ খেলা শুরু হয়। যদিও প্রকৃত কবিতা এগিয়ে যায় তার স্বতঃস্ফূর্ততার জোরেই; তারপরও অনেকে চাবি-শব্দের কথা উল্লেখ করেন কবিতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। যেমন, কবি রফিক আজাদের অনেক কবিতায় সমালোচকেরা দেখেছেন চাবি-শব্দের ব্যবহার। কিন্তু গদ্যসাহিত্যে চাবি-বিষয়ের তেমন আলোচনা নেই, বলা যায় মুক্তগদ্যে এর তেমন ব্যবহারও নেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ শেষজীবনের বিভিন্ন স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী বা তাঁর মুক্তগদ্যে এটি ব্যবহার করেছেন বেশ দক্ষতার সঙ্গেই। তাঁর ‘হিজিবিজি’, ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’, ‘ফাউন্টেন পেন’ ও ‘রংপেন্সিল’ বইয়ে চাবি-বিষয় নির্বাচন করে লেখা শুরু করেছেন। তারপর ওই বিষয় ঘিরে আবর্তিত হয়েছে অন্যান্য প্রসঙ্গ। যেমন ‘বলপয়েন্ট’ গ্রন্থের ‘৫’ নম্বর শীর্ষক রচনার কথা বলব। এতে ‘চাবি-বিষয়’ আহমদ ছফা। এ লেখকের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, তাঁর লেখালেখিতে আহমদ ছফার অবদান স্বীকার করতে গিয়ে নানা প্রসঙ্গ এনেছেন হুমায়ূন আহমেদ। যেমন শুরুতেই এনেছেন রাজধানীর প্রয়াত হন্টন পীরের কথা, বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের চিত্র। পাঠক, লক্ষ করবেন এসব বিষয় আবর্তিত হয়েছে আহমদ ছফাকে কেন্দ্র করে। ঠিক এমনভাবে অন্যান্য রচনাতেও নির্দিষ্ট বিষয় কিংবা চাবি-বিষয় নির্বাচন করে সাদা কাগজে কলম ছেড়ে দিয়েছেন, যখন থেমেছে কলমের গতি; রচনার গতিও থামিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ এসব একেকটি রচনা ২-৩ থেকে ৮-১০ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমা টেনেছেন। অর্থাৎ, হুমায়ূন আহমেদ নির্দিষ্ট বিষয় নির্বাচন করেই ছোট ছোট রচনা লিখেছেন স্মৃতিকথা লেখার ভঙ্গিতে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘কাঠপেন্সিল’ বইয়ের একটি রচনার শিরোনাম ‘উৎসর্গপত্র’। বলার অপেক্ষা রাখে না, এখানে চাবি-বিষয় লেখকদের উৎসর্গবিষয়ক লেখা। লেখক এ রচনার মূল বিষয় ধরে এগিয়ে গেছেন তরতর গতিতে, তুলে ধরেছেন উৎসর্গবিষয়ক তাঁর ও অন্যান্য লেখকের মজাদার এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি। মূল বিষয় ‘উৎসর্গ’, এরপর বিষয় ঘিরে অন্যান্য বিষয়ের আবির্ভাব। একই বইয়ের পরবর্তী রচনা ‘উন্মাদ-কথা’। এখানে চাবি-বিষয় হচ্ছে ‘উন্মাদ’, একটি জনপ্রিয় কার্টুন পত্রিকা এটি। লেখকের ছোট ভাই এর সম্পাদক। উন্মাদ পত্রিকার কথা বলতে গিয়ে একে একে এসেছে নানা প্রসঙ্গ। মূলত তা আহসান হাবীব ও তাঁর পত্রিকা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদের এমন প্রবণতার একটি গ্রন্থ ‘হিজিবিজি’। বইয়ের নাম হিসেবে তা খুব চমকপ্রদ বটে, কিন্তু গুরুত্বহীন নয়। কেননা, লেখকের রচনার সঙ্গে এ নাম সাযুজ্যপূর্ণ এবং অর্থবহ। ‘হিজিবিজি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আঁকাবাঁকা রেখাযুক্ত অর্থহীন অস্পষ্ট লেখা। অর্থাৎ নানা রেখার সঙ্গে নানা ভাবনার সাঁকোবন্ধন। তবে ভাবনাগুলো হবে শিশুমনের মতো আনন্দময়। বড়রা যেমন কোনো কিছু পরিকল্পনা করে, মনের ভেতর একটা অবয়ব এঁকে, নকশা কেটে লেখাটা দাঁড় করান, জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের রচনা হিজিবিজি সে রকম নয়। তবে কোন রকমের? যদি এক কথায় বলতে হয় তবে বলব, সাদা কাগজে কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা। বিচিত্র বিষয়ে শিশুদের মতো একটানা লিখে গেছেন এই কলম-জাদুকর।
‘হিজিবিজি’ গল্প নয়, উপন্যাসও নয়। ভ্রমণকাহিনি, সায়েন্স ফিকশনও নয়। তবে একে কি জার্নাল বলা যেতে পারে? ঠিক তা-ও হয়তো পুরোপুরি নয়। কেননা, সঠিক কোনো জ্যামিতিক অবয়ব, ফর্ম বা প্রকরণগত কোনো নিয়ম নেই এতে। লেখক গল্প করতে করতে চলে যাচ্ছেন গল্পের ভেতরে, উপন্যাসের অন্তরে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে লেখক চলে যাচ্ছেন ওই বিষয়ের ইতিহাসে, বিষয়ের সঙ্গে তাঁর অতীত স্মৃতিতে। কখনো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে, কখনো মজাদার কিংবা চমকপ্রদ ডেটা দিয়ে স্মৃতি-বিস্মৃতি থেকে তুলে আনছেন নানা কাহন। ফলে এতে পাওয়া যাচ্ছে নানা ফলের, নানা ফুলের ছোঁয়া।
বইটিতে স্থান পেয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের এমন কিছু রচনা, যাতে পাওয়া যায় তাঁর বহুমাত্রিক পরিচয়। আত্মজৈবনিক কিছু রচনা আছে, সেখানে স্থান পেয়েছে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও নিজস্ব অনুভূতি। সমকালীন সমাজ ও রাজনীতি বিষয়েও আছে একাধিক রচনা। এতে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মিলবে। টেলিভিশন নাটক ও রিয়্যালিটি শো নিয়েও আছে দুটি রচনা। ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং দেশের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে দুটি লেখায়। অন্য কিছু লেখাতেও বাংলাদেশ আর বাঙালি স্মৃতির প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অসামান্য দরদ, অনুরাগে। বইটির সর্বশেষ লেখা ‘মাইন্ড গেইম’। এতে ফুটে উঠেছে জীবনের এক মহৎ এবং গভীর বেদনাবোধ।
হুমায়ূন আহমেদ আমৃত্যু লিখেছেন তাঁর সহজিয়া ভাষায়। সহজ-সরল ভাষায় স্নিগ্ধ ও অনাবিল হাস্যরস এবং জীবনের আপাত-উপরিতলের কথা বলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তিনি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গভীর সংকেত লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর রচনায়। তাঁর গদ্যরীতিতে যে সাবলীল গতি এবং বর্ণনার পরিবর্তে কথোপকথন ও সংলাপের প্রাধান্য দেখা যায়, তা সব শ্রেণির পাঠকের কাছে সহজবোধ্য। এই বইটিতেও তা লক্ষ করা যায়। বইটি বিচিত্র বিষয়ে লেখা হলেও সব রচনাই রসবোধ ও অসাধারণ রচনাশৈলীতে সমৃদ্ধ। আশ্চর্য সারল্য আর মনকাড়া উপস্থাপনার যে বৈশিষ্ট্য একান্তই হুমায়ূন আহমেদের, এর পরিচয় পাওয়া যাবে বইটির প্রতিটি রচনায়।
সূচনা কথায় বইটির প্রকাশক অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রেক্ষাপট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থের পরিকল্পনা করা হয়। ধ্রুব এষ গ্রন্থটির জন্য প্রচ্ছদও তৈরি করেছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রচ্ছদ দেখে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, বইটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার আগেই অন্তহীন এক ভ্রমণে রওনা হয়ে গেছেন তিনি, একাকী, নিঃসঙ্গ। ছাপার আগে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতেন, মতামত জানাতেন। হিজিবিজি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ, যেটির প্রচ্ছদ তিনি দেখেছেন, অনুমোদন দিয়েছেন ছাপানোর। তাই গ্রন্থটির স্মারক-তাৎপর্যও কম নয়।’
বইটিতে স্থান পেয়েছে লেখকের নানা সময়ে লেখা মোট ২৬টি রচনা। এসব রচনা লেখকের ‘চাবি-বিষয়’ ও ‘লেখচিত্র’, ‘কলম ছেড়ে দেওয়া ভঙ্গি’ প্রবণতাগুলো লক্ষণীয়। প্রথম রচনা ‘মা’, এতে আশ্চর্য কুশলতায় জননী আয়েশা ফয়েজ এবং তাঁদের পারিবারিক নানা টুকরো গল্প বলেছেন তিনি। পড়তে পড়তে পাঠকও হয়ে পড়েন আপ্লুত, অভিভূত। ‘কবি সাহেব’ রচনাটি অসাধারণ। সংসার উদাসী, অন্যমনস্ক ও বেখেয়ালি এক কবির নানা দিক উঠে এসেছে এ রচনায়। অত্যন্ত ঝরঝরে ভাষা, নির্ভার ও সতেজ হাস্যরসে তা বর্ণনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এ ছাড়াও ‘লাউ মন্ত্র’, ‘মাসাউকি খাতাঁওরা’, ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’, ‘বর্ষাযাপন’, ‘অয়োময়’, ‘বহুত দিন হোয়ে’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘একজন আমেরিকানের চোখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব’ ইত্যাদি রচনায় লেখক তাঁর প্রাণবন্ত সুর ও মেজাজকে ধরে রেখেছেন, পাঠককে নিয়ে গেছেন রচনার মর্মস্থলে। ফলে পাঠকও একটি বিষয় ধরে জানতে পারছেন নানা বিষয়, পরিচিত হতে পারছেন নানা ঘটনার সঙ্গে। বইটিতে আরও রয়েছে সমসাময়িক সমাজ আর রাজনৈতিক ভাবনামূলক কয়েকটি লেখা, সেগুলো মূলত সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা দূরদর্শিতা কিংবা রাজনৈতিক দর্শন উঠে এসেছে সুন্দর ও সুচারুভাবে। ‘অধ্যাপক ইউনূস’ কিংবা ‘যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগ’ শীর্ষক রচনায় উঠে এসেছে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তাঁর দর্শন ও চিন্তাভাবনা। হাস্যচ্ছলে, কিছুটাবা খোঁচা মেরে তিনি বলেছেন আমাদের নীচতা ও শঠতার কথা। বলেছেন সমাজের লোভ ও লালসার কথা। অতীতেও আমরা জানি, হুমায়ূন আহমেদ দেশ ও জাতির সংকটে কলম ধরেছেন। নিজের মতামত দিয়েছেন। সজাগ করেছেন আমাদের বিবেক, বিবেচনাবোধকে। বইটির অন্যান্য রচনা ‘নিষিদ্ধ গাছ’, ‘জ্বিনের বাদশাহ্’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’, ‘জ্বিন এবং পক্ষীকথা’ ইত্যাদি অংশও চমৎকার ও অসাধারণ। গল্প বলবার ভঙ্গিতে, কিছুটা আড্ডার ছলে বলেছেন নিজের অনুভূতি, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, স্মৃতি ও মজাদার কোনো ঘটনার সারসংক্ষেপ।
বলা যায়, এসব লেখকের খেয়ালি মনের আরেকটি সৃজনব্যঞ্জনা। ডায়েরি লেখার মতো করে নয়, আবার দিনলিপিও নয়, মনের খেয়ালে যখন খুশি তখন লিখেছেন এ রচনাগুলো। এতে বিচিত্র বিষয়ে একটানা লিখে যাওয়া হলেও তা অর্থহীন অস্পষ্ট লেখা নয়। বরং তা অনেক বেশি স্পষ্ট ও সরাসরি কথা বলার রীতি। যখন যা মনে এসেছে, তিনি লিখেছেন। কার্পণ্য করেননি লেখার সঙ্গে, বিশ্বাসঘাতকতা করেননি স্মৃতির সঙ্গে। যখন লেখা থেমে গেছে, তিনি কলম থামিয়ে দিয়েছেন। পাঠক এ ধরনের লেখা পাঠে একটা অদ্ভুত মজা পাবেন। মজা পাবেন দুটি কারণে। প্রথমত, বিচিত্র সব তথ্য জানার জন্য ও দ্বিতীয়ত, তাঁর রসবোধের জন্য।
হুমায়ূন আহমেদের এই প্রবণতা তাঁর বেশ কয়েকটি বইয়ে লক্ষণীয়। মূলত প্রথাগত আত্মকথা না লিখে, বলা যায় এ প্রবণতায়, এ প্রকৌশলে, ঠিক যখন যে স্মৃতি মনে উঁকি দিয়েছে মনে, একটানা তা লিখেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের তিনটি বই ‘বলপয়েন্ট’, ‘কাঠপেন্সিল’ ও ‘ফাউন্টেন পেন’ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এক মলাটে। এই তিনটি বই মিলেই তাঁর সংকলিত গ্রন্থ ‘আমি’। বইয়ের নাম ‘আমি’ কেন, লেখক এর একটি গূঢ় রহস্যও উন্মোচন করেছেন। সূচনা কথায় বলেছেন, ‘আমার কিছু অপছন্দের শব্দের একটি হলো “আমি”। আমরা পৃথিবীতে যখন বাস করতে আসি, তখন আমির সঙ্গে যুক্ত হয় সন্তান, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, স্বজন। জন্মের আগে এবং পরে আমি বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে, জীবিত অবস্থায় আমি বলে কিছু নেই। “আমি” সংকলনটিতে আমার সঙ্গে সবাই আছেন। আমি নিজেকে কল্পনা করেছি দিঘির জলের সঙ্গে, যেখানে সবার ছায়া পড়েছে। “আমি” হলো ছায়ার গল্প।’
যাপিত জীবনে নানা ঘটনার প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছে তাঁর এ জাতীয় রচনায়। ‘বলপয়েন্ট’ বইটির কথা বলা যাক। একজন লেখকের লেখার কৌশল, বলার ভঙ্গিমা, তাঁর পঠন-পাঠন, বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ, লেখালেখির অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে বইটিতে। মূলত তা লেখকজীবনেরই একটা খণ্ডচিত্র; লেখকজীবনেরই ইতিহাস। মোট ২১টি রচনা মিলে এ গ্রন্থ। তাতে তাঁর কলাকৌশল, লেখার অভিজ্ঞতা যেমন তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমন করে মেলে ধরেছেন অতীত দিনের স্মৃতিকথাও। ফলে এ ধরনের অন্যান্য রচনার মতো এখানে তাঁর আত্মকথা উঠে এসেছে অবলীলায়।
হুমায়ূন আহমেদের এসব রচনা আত্মকথা হলেও সময় ও ঘটনার ধারাবাহিকতা নেই। যখন যা মনে এসেছে, তখন তা-ই লিখেছেন। কালক্রমিক ধারাপ্রবাহ রক্ষা হয়নি, কিন্তু লেখার গতিও থামেনি। আশ্চর্য কৌশল এটি। অধিকাংশ লেখক যখন স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন; যেমন ছেলেবেলা, শৈশব-কৈশোর, কর্মময় জীবনসহ নানা বয়সের ছোপ উল্লেখ করেন, হুমায়ূন আহমেদ ওই পথ মাড়াননি। নিজের মতো করে, নিজস্ব স্টাইলে তা বর্ণনা করেছেন। এখানেই তাঁর মুনশিয়ানা প্রতিফলিত হয়।
হুমায়ূন আহমেদের এসব রচনায় এ প্রবণতা লক্ষ করা যাবে। ‘কাঠপেন্সিল’ বইটিতে চাবি-বিষয়ের ব্যবহার লক্ষণীয়। বিষয় নির্বাচন করে এ বইটিতেও তিনি কলম ছেড়ে দিয়েছেন সাদা খাতায়। তাতে উঠে এসেছে স্মৃতিচারণ, উঠে এসেছে তাঁর বিচিত্র বিষয়ের প্রতি আগ্রহ। কৌতূহল। যেমন ‘কাঠপেন্সিল’-এর কিছু চাবি-বিষয় বলা যাক। ‘আড্ডা’, ‘যদ্যপি আমার গুরু’, ‘উৎসর্গপত্র’, ‘লেখক-বন্ধ’, ‘উন্মাদ-কথা’ ইত্যাদি। বিষয় ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর রচনা। প্রতিটি রচনা পরিকল্পিত, কিন্তু বলবার ভঙ্গি মজলিশি। ফলে পাঠক পড়তে গিয়ে স্বাদ পান আড্ডার, গল্পকথার।
হুমায়ূন আহমেদের একই কৌশলের গ্রন্থ ‘ফাউন্টেন পেন’। লেখক এ বইটিতেও চাবি-বিষয় নির্বাচন করে লিখেছেন স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরাল। বিষয় নির্বাচন করে লেখা এগিয়েছে, সঠিক কথাটি বলা হয়ে গেলে লেখাও থেমে গেছে। মূলত এসব বিষয়ের ভেতর দিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, বিচিত্র বিষয়ে পঠন-পাঠন, তাঁর যাপিত জীবনে লেখক হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন। কত বিচিত্র বিষয়ে যে তাঁর আগ্রহ! মূলত এ আগ্রহের কারণেই ওই বিষয় নিয়ে বিস্তর পরিশ্রম করেছেন, প্রচুর পড়াশোনা করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের শেষজীবনের লেখা এসব রচনা পড়তে গিয়ে মনে হয়, লেখক হওয়ার জন্য প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভা যেমন দরকার, তেমনই দরকার সাধনা, পরিশ্রম এবং উপযুক্ত নির্মাণকৌশল। প্রতিভার সঙ্গে জানতে হয় কারিগরি নানা দিকও। মূলত এসবের চমৎকার সংমিশ্রণেই একজন বড় লেখক। প্রকৃত লেখক। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে এসব গুণ ছিল প্রবলভাবেই। তাঁকে জানতে, বুঝতে; তাঁর রচনা অনুধাবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাঁর শেষ বয়সের এসব বই। শুধু ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যবিত্তের বিকাশ জানতে হলেও অবশ্যপাঠ্য এসব বই।
আকাশি রঙের বাড়ি। দোতলায় দুটি কক্ষে আলো জ্বলছে। সন্ধ্যার আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে বাড়িটির চারদিকের গাছগুলো। সন্ধ্যার নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় জলাশয়ে প্রকৃতির এই মোহনীয় ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
২ দিন আগেচারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
১৩ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
২০ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
২০ দিন আগে