দল ছিল বাবা-ছেলের চাঁদাবাজি আর মনোনয়ন বাণিজ্যের চাবিকাঠি

খান রফিক, বরিশাল
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২: ১০
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২: ৫১

২০১২ সাল থেকে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় এই নেতার নিয়ন্ত্রণেই ছিল এই অঞ্চলের আওয়ামী লীগ। তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক।

সরকার পতনের পর স্থানীয়রা, এমনকি আওয়ামী লীগের বঞ্চিত নেতা-কর্মীরাই বলছেন, এই বাবা-ছেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল এলাকার চাঁদাবাজি, দলের পদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্য। আর দলে পরিবারতন্ত্র কায়েম করে আওয়ামী লীগকেই পঙ্গু বানিয়েছেন। তাঁরা আত্মগোপনে গিয়ে আরাম-আয়েশে থাকতে পারলেও তৃণমূলের কর্মীরা ঝুঁকিতে পড়েছেন।

মনোনয়ন ও পদ-বাণিজ্য
বরিশাল অঞ্চলে আ.লীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর হাতেই ছিল দলীয় পদ এবং মনোনয়নের চাবিকাঠি। তিনি জেলার সব ইউপি চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাণিজ্য করতেন বলে অভিযোগ দলের নেতা-কর্মীদের। মনোনয়নপ্রতি নেওয়া হতো ১০ থেকে ৫০ লাখ টাকা।

তা ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের পদ পেতেও হাসানাতকে উৎকোচ দিতে হতো বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক নেতা। তাঁদের মতে, হাসানাতের বড় সহযোগী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউনুস তালুকদার, বানারীপাড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক এবং গৌরনদী পৌরসভার সাবেক মেয়র হারিছুর রহমান হারিছ।

নেতারা জানান, কেউ হাসানাতের বিরুদ্ধাচরণ করলেই বহিষ্কার করা হতো। উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদ-বাণিজ্যও চলত একই পন্থায়।

২০২১ সালের নির্বাচনে বাবুগঞ্জের কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হন নুরে আলম ব্যাপারী। বর্তমানে তিনি পলাতক। নির্বাচনে তাঁর প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মাসুম মৃধা। তিনি বলেন, ‘দলের কাছে দুবার মনোনয়ন চাইলেও পাননি। অথচ অলৌকিক যোগ্যতার কারণে নুরে আলম ব্যাপারী মনোনয়ন পান। আসলে শতভাগ সত্য যে এখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। এটা যদি না হতো, তাহলে চাঁদপাশার বিএনপি-সমর্থিত দেলোয়ার রাঢ়ীও মনোনয়ন পেতেন না।’

ছাত্রলীগের একসময়ের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনে জেল খেটেছি, ১৯৭৫ সালে বরিশালে মিছিল করেছি। আশির দশকে জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলাম। কিন্তু দুঃখ হলো হাসানাত সাহেব ৩৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যেও আমাকে থাকতে দেননি।’

আলতাফ হোসেন ভুলু বলেন, ‘কৃষক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি থাকাকালীন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন পেলেও আমার মনোনয়ন কেড়ে নিয়ে জাতীয় পার্টির মইদুলকে দেন হাসানাত।’

এ বিষয়ে জানতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে ফোনে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউনুস তালুকদারের ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মনসুর আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, বরিশালে কর্মীরা দুরবস্থায় আছেন। এখন তাঁদের অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘পদ-বাণিজ্য এবং মনোনয়ন-বাণিজ্য হয়েছে—এমন কী প্রমাণ আছে? সভাপতি-সম্পাদকের অনুমতি ছাড়া এসব বিষয় মন্তব্য করব না।’

সাদিকের চাঁদাবাজি
বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ছয়জন ‘খলিফা’ দিয়ে গোটা নগরী পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরের সব হাটবাজার, লঞ্চঘাট, খেয়াঘাট নিয়ন্ত্রণ করতেন সাদিকের অন্যতম খলিফা নগর আওয়ামী লীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল। তিনি ক্যাশিয়ার হিসেবে সাদিকের চাঁদাবাজির টাকা তুলতেন। টুটুল বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়।
এ ছাড়া শ্রমিক লীগ নেতা রঈজ আহমেদ মান্না বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি, ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত সিটি করপোরেশনের প্ল্যান পাস করানোর বিনিময়ে ঘুষ, কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে দলের কর্মীরাই বলছেন। সাদিকের এই খলিফারা এখন ভারতে পালিয়ে আছেন বলে জানা যায়। 
নগরের নথুল্লাবাদের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শ্রমিক লীগ নেতা রঈজ আহমেদ মান্না সেখানকার “বাঙলা হোটেল” দখল করে বাণিজ্য করেছেন। বাস টার্মিনাল থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন করতেন। চাঁদা না দিলে কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়া হতো।’ 

ব্যক্তিস্বার্থে দলকে ব্যবহার
২০০২ সালে বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন মঈন তুষার। এরপর আর দলে ঠাঁই হয়নি। তিনি বলেন, দুই যুগ ধরে যুবলীগের নেতৃত্ব নেই। স্বেচ্ছাসেবক লীগও দুই যুগ ধরে অচল। মহানগর আওয়ামী লীগ একতরফা গঠিত হয়েছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিক নিজস্ব বলয় দিয়ে একতরফা দল চালাতেন। এই বরিশালে নেতারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চাননি, ব্যক্তিকে শক্তিশালী করে টাকা কামিয়েছেন।’

বরিশাল শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হক হারুন বলেন, এখানে ব্যক্তি রাজনীতি হয়েছে। এটাকে শো করে ব্যবসা করেছে হাসানাত পরিবার। 
এ ব্যাপারে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘নেতারা দল করেনি, ক্যাডার দিয়ে লুটপাট করছে। আসলে বেসরকারি নাইট কলেজের নেতা দিয়ে কি দল চালানো যায়?’

আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তিন বছর হয়েছে ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়নি। কমিটিতে পদ পেয়ে কয়েকজন লুটপাট করছে। ভারতে আরামে থেকে মাঝে মাঝে ছবিও দেয় ফেসবুকে। অথচ এই নেতাদের জন্যই কর্মীরা আজ নির্যাতিত হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত