ঝরনা-সৈকতে অসতর্কতা ডেকে আনছে মৃত্যু, সীতাকুণ্ডে দেড় বছরে নিহত ৮ পর্যটক

সবুজ শর্মা শাকিল, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ১৪ মে ২০২৪, ১৫: ০৭
আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ১৬: ০৬

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রাকৃতিক ঝরনা ও নয়নাভিরাম সমুদ্র দর্শনে এসে গত দেড় বছরে প্রাণ হারিয়েছেন আট পর্যটক। মূলত অসতর্কতার কারণেই এটি ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এখনো পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি প্রশাসন। বেশির ভাগ ঝরনা ও সমুদ্রসৈকতের সামনে রাখা হয়নি সচেতনতামূলক নির্দেশনা। সৈকতগুলোতে নেই লাইফ গার্ড কিংবা বিপদ-পরবর্তী উদ্ধারের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। 

নৌ-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সীতাকুণ্ডে সমুদ্র ও প্রাকৃতিক সৃষ্ট ঝরনা দেখতে এসে ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৯ মাসে অসতর্কতায় প্রাণ হারিয়েছেন আট পর্যটক। এর মধ্যে ঝরনা দেখতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন পর্যটক। অন্যদিকে গোসলে নেমে সমুদ্রের পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন পর্যটক। প্রাণ হারানো আট পর্যটকের মধ্যেই সাতজন শিক্ষার্থী ও একজন চাকরিজীবী।
 
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সমুদ্রসৈকত ঘিরে প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব, প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জামের সংকট এবং পর্যটকদের অসতর্কতার কারণে ঘটছে প্রাণহানি। সৈকতে আসা পর্যটকদের মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে বৈরী আবহাওয়া ও ভাটার সময় পানিতে না নামতে সতর্ক চিহ্ন সংবলিত দিকনির্দেশনা সৈকতের প্রবেশদ্বারগুলোতে দেওয়া প্রয়োজন। তা দেখে পর্যটকেরা সতর্ক হলে কমে যেত প্রাণহানির ঘটনা। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নেট বা জাল দেওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিমুক্ত গোসলের স্থান নির্ধারণের দাবি জানান তাঁরা।
 
পর্যটকদের অভিযোগ, সৈকতে সতর্কতামূলক কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা ঘুরতে এসে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। সৈকতে নিরাপত্তাকর্মী দেওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের সঠিক নজরদারি বাড়ানো হলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে বলে অভিমত তাঁদের। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে সাগর প্রতিনিয়ত তার আচরণ পাল্টায়। জোয়ারের সময় সাগরের যেই স্থানে সমতল থাকে, ভাটার সময় সেই স্থানে খাদের সৃষ্টি হয়, যার ফলে ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি হয়ে সেখানে চোরাবালির সৃষ্টি হয়। তাই সৈকতে গোসল করতে নামতে হবে নিরাপদ জায়গায়। নয়তো যেকোনো সময় প্রাণহানি ঘটতে পারে। 

বাঁশবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী জাহাঙ্গীর জানান, তাঁর ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ের ভেতরে একটি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় হওয়ায় সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা যেতেও ভয় পান। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পর্যটকেরা কোনো বাধা না শুনে পিচ্ছিল ঝরনায় ওঠেন। ঝরনার পাশাপাশি বাঁশবাড়িয়ায় যে সমুদ্রসৈকত রয়েছে, সেখানে বালির পরিবর্তে রয়েছে আঠালো কাদামাটি। ফলে জোয়ারের সময় যাঁরা সমুদ্রসৈকতে নামেন, তারা সেই কাদায় আটকা পড়ে মারা যান। এসব বিষয়ে আগত পর্যটকদের স্থানীয়ভাবে সতর্ক করা হলেও তাঁরা তা না মেনে সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে নেমে পড়েন। যার ফলে ঘটে যায় প্রাণহানির মতো ঘটনা। একটু সতর্ক হলেই প্রাণহানির ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো বলে জানিয়েছেন তিনি। 

সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতবারৈয়ারঢালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রেহান উদ্দিন জানান, তাঁর ইউনিয়নে থাকা সহস্রধারা ঝরনা দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্তের অসংখ্য পর্যটক ভিড় করেন। বর্ষা মৌসুমে আগত পর্যটকেরা মৎস্য প্রজেক্টে থাকা নৌকা দিয়ে চলাচল করেন। আর গ্রীষ্মকালেই শুকনো পথে চলাচল করেন তাঁরা। কিন্তু এ দুই মৌসুমে আগত পর্যটকেরাই নিজেদের অসতর্কতার কারণে বিপদে পড়েন। সাঁতার কাটতে না জানার পরেও কৌতূহলবশত মৎস্য প্রজেক্টের পানিতে নেমে বিপদে পড়েন তাঁরা। পর্যটকেরা যদি একটু সচেতন হতেন, তাহলেই অকালমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতেন তাঁরা। 

সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম দুলাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, অতি উৎসাহ ও অসতর্কতার কারণেই সীতাকুণ্ডের প্রাকৃতিক ঝরনা ও সমুদ্রদর্শনে এসে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পর্যটকেরা। গত এক বছরেই নিজেদের ভুলের কারণে ঝরনা দেখতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ পর্যটক। এ ছাড়া তার আগে সমুদ্রে গোসলে নেমে ডুবে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন তিন পর্যটক। ঝরনা ও সমুদ্রে প্রাণ হারানো আট পর্যটকের মধ্যে সাতজনই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সীতাকুণ্ডের ঝরনা ও সমুদ্রসৈকতে প্রতিনিয়ত দূর-দূরান্তের হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। কিন্তু তাদের অসতর্কতার কারণে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ বিষাদে পরিণত হচ্ছে, যেটা আমাদের কারও কাম্য নয়। এখানে আগত পর্যটকদের সতর্কতা অবলম্বনে ঝরনা ও সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতি উৎসাহী পর্যটকেরা সেগুলো উপেক্ষা করে সাঁতার কাটতে ও গোসল করতে নেমে পড়েন। পর্যটকেরা সতর্কতার সঙ্গে বা নিয়ম মেনে গোসলে নামলে সহজেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত