সিনহা হত্যা এবং তারপর...

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ২৩: ১০
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২২, ১৩: ০২

মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার শুনানি শেষ হয়েছে গত ১২ জানুয়ারি। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল ৩১ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন। সিনহা হত্যা মামলায় টেকনাফের ত্রাস ওসি প্রদীপসহ ১৫ আসামির সাজা শোনার অপেক্ষায় দেশবাসী।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে সিনহা হত্যার ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাঁকে গুলি করেন বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে।

হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। প্রদীপকে পরে বরখাস্ত করা হয়। বর্তমান তিনি কারাগারে।

মামলায় প্রধান আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলী। প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত। মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় কক্সবাজারের র‍্যাব-১৫।

২০২০ সালের ৭ আগস্ট এজাহারভুক্ত আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তদন্তে নেমে স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে মামলার ১৫ আসামির সবাই গ্রেপ্তার হন।

চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এতে ৮৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। তিনি ১৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলেন—বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, বরখাস্ত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান, বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ। এ ছাড়া রয়েছেন টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

সিনহা নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি। তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে দেড় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করে তদন্তস্থলে নতুন পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়।

এক নজরে ঘটনাক্রম


২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সোয়া ৯টা

কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। 

২০২০ সালের ১ আগস্ট

পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে মামলা দুটি করে পুলিশ। টেকনাফ থানায় করা দুই মামলায় সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। রামু থানায় মাদক আইনে করা মামলাটিতে আসামি করা হয় সিনহার অন্য সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে। 

২০২০ সালের ৫ আগস্ট

সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন—টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র‍্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র‍্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত। 

২০২০ সালের ৬ আগস্ট

সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র‍্যাবে হস্তান্তর করা হয়। ওই দিন বিকেলে মামলায় আসামি সাতজনের মধ্যে সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন না। ওই দিনই আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। 

২০২০ সালের ১১ আগস্ট

পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরে তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। ওই দিনই তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। 

২০২০ সালের ১৮ আগস্ট

এপিবিএনের তিন সদস্য সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর তাঁদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। ওই দিনই তাঁদের রিমান্ড আবেদন করে র‍্যাব। 

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর

কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে র‍্যাব। ওই দিনই তাঁর বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। 

পরে কারাগারে থাকা ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। 

 ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর

র‍্যাব-১৫-এর কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিলেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। 

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর

আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। একই সঙ্গে পুলিশের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে স্থানান্তর করা হয়। 

২০২১ সালের ২৪ জুন

পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত ওই দিনই তাঁকে কারাগারে পাঠান। 

২০২১ সালের ২৭ জুন

আদালত ১৫ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দেন। একই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ সম্ভব হয়নি। 

২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর

আট দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। প্রথম দফায় ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে দুজনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় চারজনের। তৃতীয় দফায় ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে সম্পন্ন হয় আটজনের সাক্ষ্যগ্রহণ। চতুর্থ দফায় ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয় ছয়জনের। পঞ্চম দফায় ১০ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। 

ষষ্ঠ দফায় ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৪ জনের। সপ্তম দফায় ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ছয়জন সাক্ষ্য দেন। এদের মধ্যে পাঁচজনের জেরা সম্পন্ন হলেও তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা অসম্পন্ন ছিল। সর্বশেষ অষ্টম দফায় ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। 

২০২১ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর

আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। 

২০২২ সালের ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি

মামলায় উভয় পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। 

২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি

যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিন আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। 

মেজর সিনহা মামলা সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত