বন্যায় ছিন্নভিন্ন সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০২: ৩৩

ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে ক্ষয়ক্ষতি। এই জেলার বেশির ভাগ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই; বরং প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় অবনতি ঘটছে। এর মধ্যেই প্রাণিসম্পদের ক্ষতি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। 

ক্ষতিগ্রস্ত খামারি, চাষিরা
নোয়াখালীর আটটি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। একদিকে ফেনী থেকে আসা ঢল, অন্যদিকে টানা ভারী বর্ষণে সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল ও সুবর্ণচর উপজেলায় বন্যার পানি বেড়েই চলেছে। এতে আমন ও আউশ ধান, শরৎকালীন শাকসবজির আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাণিসম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

নোয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, বন্যায় প্রাণিসম্পদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সদর উপজেলায়। এখন পর্যন্ত বন্যার পানিতে মারা গেছে প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩১৪টি গৃহপালিত পশুপাখি। এগুলোর সিংহভাগই মুরগি, ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৭০টি। ভেসে গেছে ৪৮ হেক্টর গোচারণভূমি, ১৫৪ টন দানাদার খাদ্য, ৩৪৬ টন খড় ও ৩৬৬ টন কাঁচা ঘাস। জেলার ১০৮টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৯৬টি। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর এলাকার পোলট্রি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ নূর উদ্দিন বলেন, ২২ আগস্ট বন্যার পানি ঢুকে তাঁর খামারের ১৭ দিন বয়সী ৮ হাজার মুরগির বাচ্চা মারা যায়। এ ছাড়া গরুর খামারের ৩টি বাছুর ও ৭টি বড় গরু মারা গেছে। তিনি ছাড়াও আশপাশের অসংখ্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, নোয়াখালীর আটটি উপজেলায় প্রাণিসম্পদে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অপূরণীয়। পুরো জেলায় গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে বন্যায় নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত জেলায় যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে এলাকাভেদে পানি বেড়েছে ৫ ইঞ্চি থেকে প্রায় ১ ফুট করে। মঙ্গলবার রাত ৩টা থেকে বুধবার বেলা ৩টা পর্যন্ত নোয়াখালীতে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৭২ মিলিমিটার। এখনো প্রত্যন্ত এলাকায় পানিবন্দী ১৯ লাখের বেশি মানুষ।

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজিম বলেন, প্রতিদিনই হাসপাতালে ডায়রিয়া ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

লক্ষ্মীপুরেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। দিনে দিনে মৎস্য, কৃষি, পোলট্রি ও গবাদিপশুর ক্ষতি বাড়ছে। দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। অনেক গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

সদর উপজেলার বালাইশপুর আদর্শ খামারের মালিক মো. ফারকুর রহমান বলেন, ‘বন্যায় সব শেষ হয়ে গেছে। গোখাদ্যের চরম সংকট রয়েছে। বাজার থেকে কয়েক কেজি খৈল ও ভুষি কিনে সামান্য কিছু ভেজা খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে গরুকে খেতে দিই। এভাবে বেশি দিন চলা যাবে না। গরুগুলো অর্ধাহারে আর পানির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। প্রাণিসম্পদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছি না। গরুগুলোর কোনো চিকিৎসা করাতেও পারছি না।’

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র বলেছে, জেলার পাঁচটি উপজেলার ১৩ হাজার ৭০০ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে ২২ হাজার ৪১৩টি গরু, ২ হাজার ৮৮৯টি মহিষ, ১৩ হাজার ৪১৯টি ছাগল, ৯৬০টি ভেড়া, ২১ হাজার ৭৮৫টি হাঁস ও প্রায় ৪ কোটি ২০ হাজার মুরগি। ১০৮টি খামারের ৪৪৫টি গরু, ১৯০টি হাঁস-মুরগির খামারের ৩ লাখ ৩৬ হাজার হাঁস-মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কুমুদ রঞ্জন মিত্র বলেন, পানি নামতে দেরি হলে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ দাঁড়াবে। গোখাদ্যের সংকট রয়েছে। 

লন্ডভন্ড সড়ক
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে স্পষ্ট হচ্ছে সড়কের ক্ষতির চিত্র; বিশেষ করে পরশুরাম উপজেলার ৮০ শতাংশ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে এই উপজেলার সড়কগুলো খানাখন্দে ভরে গেছে। কোথাও কোথাও সড়ক ভেঙে পড়েছে। এদিকে গত মঙ্গলবার থেকে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার প্রায় সব কটি এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ ও ইন্টারনেট সংযোগ সচল হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রায় ৩ হাজার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৪০টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

এদিকে পরশুরামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তারই অংশ হিসেবে পরশুরাম-পশ্চিম সাহেবনগর সড়কের পাঁচ কিলোমিটার সড়ক মেরামত করেছেন তাঁরা। ফলে উপজেলা সদরের সঙ্গে মির্জানগর ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। 

পাশে নেই কোনো জনপ্রতিনিধি
কুমিল্লায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে মনোহরগঞ্জে অবনতি ঘটেছে। চরম এই বিপর্যয়ের মুহূর্তে কুমিল্লাসহ বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় কোনো জনপ্রতিনিধিকেই পাশে পাচ্ছে না বন্যার্তরা। এদিকে ব্রাহ্মণপাড়ার শিদলাই গ্রামে গতকাল দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে ওমর নামের দেড় বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

স্থানীয় সূত্র বলেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অন্যান্য এলাকার মতো চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি পৌরসভার মেয়র ও ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও ইউপি সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের জরুরি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন প্রশাসকেরা। যদিও ১৩ ইউপি চেয়ারম্যান এখনো নিজ নিজ পদেই আছেন।

এদিকে চৌদ্দগ্রামে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। আক্রান্তদের অধিকাংশই শিশু। তবে ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গতকাল ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৬ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত নারী ও শিশু ভর্তি রয়েছে। হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসক সামছুল ইসলাম রানা বলেন, ‘বন্যার পানি কমার সাথে সাথে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।’

হবিগঞ্জে বন্যার আরও উন্নতি
হবিগঞ্জে বন্যাকবলিত ছয়টি উপজেলার পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বাড়ি ফিরলেও ভুগছেন সুপেয় পানির সংকটে। সরকারি হিসাবে গত দুদিনে অন্তত ১০ হাজার ঘরবাড়ি থেকে বন্যার পানি নেমেছে। যদিও নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দী রয়েছে অন্তত কয়েক হাজার পরিবার।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত