Ajker Patrika

বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ছেলের মৃত্যু টাকার লোভে আন্দোলনে হত্যার মামলা বাবার

নুরুল আমিন হাসান, উত্তরা(ঢাকা)
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গাজীপুরের টঙ্গীর শরীফ হোসেন (২০) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নয়, মারা গেছেন টঙ্গীতে নির্মাণকাজের সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে। এ ঘটনায় তাঁর বাবা জয়নাল আবেদিন ওরফে জয়নাল বাবুর্চি অর্থ নিয়ে আপসও করেছিলেন। পরে এক ব্যক্তি সরকার থেকে অনেক টাকা পাওয়ার লোভ দেখালে তিনি জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর উত্তরায় গুলিতে ছেলেকে হত্যার অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করেন।

অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পুলিশের তদন্তেও মামলাটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ বলেছে, মানুষকে আসামি করে টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে একটি কুচক্রী মহল মামলাটি করেছে।

টাকা পাওয়ার আশা দিয়ে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে মামলা করানোর কথা জানিয়ে জয়নাল আবেদিন বলেছেন, অন্যরা মামলা লিখেছে, তিনি শুধু স্বাক্ষর করেছেন। মামলার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না।

জয়নাল আবেদিনের গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার উত্তর শ্রীপুরে। তাঁর ছেলে শরীফ হোসেন ছিলেন রাজমিস্ত্রি, স্ত্রীকে নিয়ে টঙ্গীতে থাকতেন। তিনি মারা যান গত বছরের ২৪ জুলাই।

শরীফের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বাবা জয়নাল আবেদিন ১০ নভেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা (নং-সিআর-৩৬/২০২৪) করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনসহ ২৫৭ জনকে আসামি করা হয়।

মামলার আরজিতে অভিযোগ করা হয়, ২৪ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানার আবদুল্লাহপুর পুলিশ বক্সের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছোড়া গুলি শরীফের বুকে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া শরীফকে কয়েকজন ছাত্র উদ্ধার করে টঙ্গীর ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

ওই মামলার সূত্র ধরে টঙ্গীর সাতাশ এলাকার ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২৪ জুলাই শরীফকে ওই হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে নয়, বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টঙ্গীর খাঁপাড়ার ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলায় নির্মাণকাজ করার সময় বিদ্যুতায়িত হন দুই শ্রমিক শরীফ হোসেন ও আব্দুস সালাম সীমান্ত। পরে তাঁদের গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

জানতে চাইলে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) মসজিদের ইমাম ইকবাল হোসেন মাসুদও বিদ্যুতায়িত হয়ে শরীফের মৃত্যুর কথা জানান। জানা যায়, দুজনের মৃত্যুর ঘটনায় ওই মসজিদ মাদ্রাসা কমপ্লেক্স কমিটির সঙ্গে শরীফের বাবা জয়নাল আবেদিন ও সীমান্তের বাবা আবু তালেব আপস-মীমাংসা করেন। কমিটির লোকজন তাঁদের দাফন ও দোয়া অনুষ্ঠানের জন্য টাকা দেন। মৃত দুজনের বাবা তাঁদের মৃত্যুর ঘটনায় পরিবারের কোনো অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত দেন। ওই মুচলেকার কপি আজকের পত্রিকার কাছে আছে।

শরীফ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক ফরিদুজ্জামান বলেন, মেডিকেল প্রতিবেদনসহ বাদীকে ডাকা হলে তাঁর মুখের বর্ণনার সঙ্গে এজাহারের বর্ণনার মিল পাওয়া যায়নি। এজাহারে উল্লেখিত ঘটনাস্থলে গিয়েও কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। পরে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদেও অমিল পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘কাকতালীয়ভাবে জানতে পারি, উল্লেখিত সময়ে (২৪ জুলাই সকাল) টঙ্গীতে একটি মসজিদ মাদ্রাসায় কাজ করার সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে একসঙ্গে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তারপর হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওই দুজনের একজন হলেন এই মামলার ভিকটিম শরীফ।’

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, একটি কুচক্রী মহল মানুষকে হয়রানি এবং আসামি করে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে মামলাটি করেছিল। তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নেওয়ার জন্য প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

বিদ্যুতায়িত হলেও আন্দোলনে নিহত দাবি করে মামলার বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় শরীফের বাবা জয়নাল আবেদিন ওরফে জয়নাল বাবুর্চির সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি ঢাকা গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ গ্রামে এনে দাফন করেন। ৫ আগস্টের পর উত্তরার আবদুল্লাহপুরের শামীম নামের এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যার মামলা করলে সরকার থেকে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। তাঁদের কথায় লোভে পড়ে মামলা করেন। তাঁরা বিনা টাকায় মামলা করার সব ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলে ঢাকায় গিয়ে আবাসিক হোটেলে উঠেছিলেন। ওই ব্যক্তিরাই মাইক্রোবাসে করে তাঁকে আদালতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা কোনো টাকা দেননি। উল্টো ঢাকায় গিয়ে থাকা-খাওয়া ও মামলা করতে তাঁর ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘মামলা করে গ্রামে এসে শুনি ফেনীর অনেককে ওই মামলায় আসামি করেছি। মামলাটি শামীম ও তাঁর লোকজন করিয়েছেন। তাঁরাই মামলা লিখে দিয়েছেন। আমি শুধু সই করেছি। এ ছাড়া মামলার কিছু জানি না। মামলা করার কারণে আমি অনুতপ্ত।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডিএনসিসির পদ ছাড়লেন এস্তোনিয়ার নাগরিক আমিনুল ইসলাম

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা, চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ

এনআইডির নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনের দায়িত্বে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা

পদত্যাগ করব না, আলোচনা করে সমাধান করব: কুয়েট উপাচার্য

কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর অতর্কিত গুলি, নিহত ২৬

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত