রাউজান এলাকা

হালদার ‘বিষফোড়া’ ইটভাটা

  • সাতটি ভেঙে দেওয়ার পরও আরও তিনটিতে ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি।
  • ‘এ আলী’ চিমনি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। আবারও চালু হয়েছে ভাটা।
  • শান্তি ব্রিকসকে করা হয়েছিল জরিমানা। উৎপাদনে যেতে প্রস্তুত তারা।
মো. আরফাত হোসাইন, রাউজান (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২: ০৫
Thumbnail image
ইটভাটায় সরবরাহের জন্য হালদাপাড়ে খননযন্ত্র বসিয়ে কাটা হচ্ছে মাটি। ছবিটি গতকাল দুপুরে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামীপাড়া এলাকা থেকে তোলা। আজকের পত্রিকা

দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর পারে গড়ে উঠেছে একাধিক ইটভাটা। রাউজান অংশে ইটভাটার মাটির জোগান দিতে কাটা হচ্ছে নদীর পাড়। বিভিন্ন স্থান থেকে মাটি আনতে নদীতে ব্যবহার করা হচ্ছে যান্ত্রিক নৌকা। ভাটাগুলোর শ্রমিকেরা হালদায় মাছ শিকার করছেন—এসব কারণে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর জীববৈচিত্র্য।

এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন মাঝেমধ্যে ভাটায় অভিযান চালায়, ভাটার চিমনি গুঁড়িয়ে দেয়, জরিমানা করে। তবে কিছুদিন পর আবারও চালু হয় ইটভাটা। ফলে পরিবেশ ও নদীদূষণ—কোনোটাই থেমে নেই।

কয়েক বছর আগেও হালদা নদীর তীরে রাউজান অংশে কোতোয়ালি ঘোনার পাশে, পশ্চিম বিনাজুরী, পশ্চিম গুজরার কাশেম নগর, উরকিরচরের পশ্চিম আবুরখীল, সার্কদা, নোয়াপাড়ার মোকামীপাড়া ও কচুখাইন এবং হাটহাজারী অংশের মেখল এলাকা—সব মিলিয়ে ১০টি ইটভাটার অস্তিত্ব ছিল। নদী বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে ৭টি ইটভাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক বছর আগে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামীপাড়া গ্রামে ‘এ আলী’ নামের একটি ইটভাটার চিমনি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে সেই ভাটায় আবারও ইট তৈরি শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের (সদর) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সিনিয়র সহকারী সচিব) ফয়জুন্নেছা আকতার মোবাইলে বলেন, ‘সারা দেশে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান চলছে। অবৈধ বা ক্ষতিকর সব ইটভাটায় অভিযান চালানো হবে। সম্প্রতি রাউজানে অভিযান পরিচালনা করে চারটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

তবে ইটভাটায় গিয়ে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। ‘এ আলী’ ইটভাটার পাশে নদীর পাড় ঘেঁষে এক্সকাভেটর দিয়ে বিশাল গর্ত করে মাটি খনন করা হচ্ছে। তার ৫০ ফুট দূরত্বে এসব মাটি মজুত করে কাঁচা ইট তৈরির কাজ চলছে। একইভাবে নদীর পাড়ে ইটভাটা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে উরকিরচরের সার্কদা এলাকায় ‘মেসার্স আজমীর অটো ব্রিকস’ এবং একই ইউনিয়নের পশ্চিম আবুরখীল এলাকায় ‘শান্তি ব্রিকস’।

শান্তি ব্রিকস নামের এই ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরাঞ্চল থেকে মাটি কেটে যান্ত্রিক নৌযানে এনে মজুত করা হচ্ছে। ইটভাটা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইটভাটা পরিষ্কার করছেন। তবে এখনো ইট তৈরির কাজ পুরোপুরি শুরু হয়নি। এ আলী, আজমীর অটো ও শান্তি ব্রিকসে এমন কর্মতৎপরতা চললেও নীরব ভূমিকায় উপজেলা প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তর।

এ আলী ব্রিকস পরিদর্শনকালে ইটভাটায় নিয়োজিত শ্রমিকের মোবাইলে কথা হয় ভাটামালিক রাশেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হালদা নদীর পাড় হলেও এসব আমাদের জায়গা। আমরা নদীর পাড়ে যে মাটি খনন করছি, তা পুনরায় ভরাট করে দেওয়া হবে।’ পরিবেশদূষণের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।

এদিকে শান্তি ব্রিকসের অংশীজন প্রিয়তোষ বড়ুয়া বলেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে বসতে চাই, আপনাদের সঙ্গে দেখা করব।’

কিছুক্ষণ পর ইটভাটায় এসে প্রতিবেদন না করতে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চালান প্রিয়তোষ বড়ুয়া। ইটভাটার কারণে নদীর মা মাছ তথা জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০১০ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী বসতি এলাকা, পাহাড়, বন ও জলাভূমির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণ করা যাবে না; এমনকি কৃষিজমিতেও ইটভাটা নির্মাণ অবৈধ।’ তিনি বলেন, ইটভাটার সৃষ্ট তাপের ফলে আশপাশের অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদিত ছাই পাশের জলাশয়ের পানির সঙ্গে মিশে বিষাক্ত উপাদান সৃষ্টি করে, যা জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র ও জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। ফলে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট, বায়ু ও পানিদূষণ ঘটছে। এ ছাড়া ইটভাটার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যগত জটিলতার বিষয়টিও ভয়ংকর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত