অস্ত্রবাজ-দখলদারদের প্রশ্রয় দিয়ে কক্সবাজারে জাফরের রাজত্বের অবসান

বাপ্পী শাহরিয়ার, চকরিয়া (কক্সবাজার)
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯: ১৩
আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১৯: ২৯

কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য জাফর আলম দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। প্রভাবশালী জাফর আলম এবার বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কাছে ধরাশয়ী হয়েছেন। দলীয় পদ ও নির্বাচনে হেরে এখন তিনি অকূল পাথারে। 

জাফর আলম সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও চকরিয়া পৌরসভার মেয়র হিসেবে টানা ১৫ বছর জনপ্রতিনিধি ছিলেন। চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। এমন তুখড় রাজনীতিবিদের পরাজয়ের কারণ নিয়ে আলাপচারিতা ও গুঞ্জন চলছে এলাকার ভোটারদের মাঝে। 

স্থানীয়রা মনে করছেন, জমি ও চিংড়ি ঘের দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি, দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়ন এবং নিজস্ব বলয় তৈরির কারণে জাফর আলম এবার পরাজিত হয়েছেন। আর এসব অপকর্ম পুঁজি করে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে কূটকৌশলে চমক দেখিয়েছেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। 

জাফর আলম ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও আসনটি জোটগতভাবে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি ২০০৫ সালে প্রথম চকরিয়া পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইবরাহিমের কাছে ২৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন জাফর আলম। ইবরাহিম হাতঘড়ি প্রতীক নিয়ে ৮১ হাজার ৯৫৫ ভোট পান। অন্যদিকে জাফর আলম ৫২ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়েছেন। বাকি পাঁচজন প্রার্থী পেয়েছেন ২ হাজার ৪২৫ ভোট। 

সৈয়দ ইবরাহিমের জয় ও জাফর আলমের পরাজয়ের কারণ জানতে ১৫ জন ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার এ প্রতিনিধি। তাঁদের মতে, জাফর আলম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর চকরিয়া-পেকুয়ার দখলবাজ শ্রেণির লোকজন তাঁর কাছে আশ্রয় পান। 

এরপর চিংড়িঘের দখল, জমি দখল ও মালিককে জিম্মি করে জমি কিনে নিয়ে নানাভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি। এবার নির্বাচনে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে এসে কল্যাণ পার্টির প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নেন। পরে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রচারণা চালান। 

ইবরাহিমকে ‘বহিরাগত’ প্রার্থী হিসেবে আখ্যায়িত করলেও জাফর আলমের নির্যাতনের শিকার সাধারণ ভোটাররাও তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ইবরাহিমের পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়াও সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ ভোটারদের সমর্থন পান। জাফর আলম, তাঁর নিকটাত্মীয় ও নিজস্ব বলয়ের লোকজন দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, অস্ত্রবাজি ও বিতর্কিত লোকজন সঙ্গে রাখা তাঁর হারের মূল কারণ বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও সাধারণ ভোটাররা। 

সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ‘জাফর আলম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁর বাহিনীর হাতে দলীয় নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। জমি ও চিংড়ি ঘের দখল, অস্ত্রবাজিসহ নানা অভিযোগ থাকায় দল তাঁকে মনোনয়ন দেননি। দলীয়ভাবে কল্যাণ পার্টির প্রার্থী সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে সমর্থন দেওয়ার পর আমরা কাজ করে বিপুল ভোটে তাঁকে নির্বাচিত করেছি।’ 

চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ‘জাফর আলম এমপি হওয়ার পর থেকে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নিয়ে শত শত মানুষের জমি দখল করেছেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের অবমুল্যায়ন, দমন-পীড়ন করে ‘জাফর লীগ’ সৃষ্টি করেছেন। নানা কারণে দলীয় নেতা ও ভোটাররাও ক্ষুদ্ধ ছিলেন। এসব অপকর্মের ভোটাররা কাছে পৌঁছে দিয়ে কাজে লাগিয়েছেন সৈয়দ ইবরাহিম। তাই দল মনোনয়ন দেয়নি, স্বতন্ত্র ভোট করে লজ্জাজনকভাবে হেরেছে।’ 

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘গত পৌরসভা নির্বাচনে আমাকে দল মনোনয়ন দেন। জাফর আলম তাঁর আপন ভাতিজাকে আমার বিরুদ্ধে ভোটে নামান। জনগণ আমাকে বিপুল ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। আমরা দীর্ঘদিন তাঁর পক্ষে ছিলাম। এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি মানুষকে জুলুম করেছেন। চিংড়িঘের ও মানুষের জমি দখল করে কোটি কোটি মালিক হলেও এলাকায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী না থাকায়, হাত ঘড়ির প্রার্থীকে জেলা আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল। সৈয়দ ইবরাহিমকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জাফরকে পরাজিত করে তাঁর অপকর্মের জবাব দিয়েছেন।’ 

এ আসনে ভোটার রয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৫২ জন ভোটার। ভোটারের বিপরীতে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৭৬ টি। মোট ভোটারের ২৮.৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইবরাহিমের কাছে ২৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন জাফর আলম। ইবরাহিম হাত ঘড়ি প্রতীক নিয়ে ৮১ হাজার ৯৫৫ ভোট পান। জাফর আলম ৫২ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়েছেন। 

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী হোসনে আরা পেয়েছেন ৭৭৩ ভোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির আবু মোহাম্মদ বশিরুল আলম পান ৫৩৭ ভোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মুহাম্মদ বেলাল উদ্দীন পেয়েছেন ৬৯১ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের ছেলে তানভীর আহমদ সিদ্দিকী তুহিন ২৪৪ ভোট পেয়েছেন ও কমর উদ্দীন ১৮০ ভোট পান। 

কক্সবাজার-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের বক্তব্য নিতে তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিক কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। 

এ বিষয়ে জাফর আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ও চকরিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম লিটু বলেন, ‘কল্যাণ পার্টিকে আসনটি অনেকটা উপহার দেওয়া হয়েছে বলা যায়। সৈয়দ ইবরাহিমের জয় ও জাফর আলম পরাজয় এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ। দলীয় নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন ও দখলের বিষয়টি পুঁজি করে ভোটের রাজনীতি হয়েছে।’

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ও কক্সবাজার-১ আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘সকল ষড়যন্ত্র ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জনগণ আমাকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের কাছে দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে; এ নির্বাচনে তাঁরা প্রতিশোধ নিয়েছেন। চকরিয়া-পেকুয়া উপজেলায় পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন করা হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত