‘যে চোখে স্বপ্ন দেখত পুলিশ-সেনাবাহিনীতে চাকরির, সেই চোখই খোয়া গেল’

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
Thumbnail image
আহত মো. রাকিব। ছবি: সংগৃহীত

৪ আগস্ট দিনভর ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলন রোধ করতে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেডসহ শটগান দিয়ে গুলি ছেড়ে। এ ঘটনায় আহতদের কয়েকজন কিশোরগঞ্জ জেলা স্টেশন রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে খড়মপট্টি এলাকায় রাস্তায় পড়েছিলেন। তাদের একজনকে টেনে তুলতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয় কলেজছাত্র রাকিব (১৭)।

চশমা ভেঙে চোখের ভেতর গুলি ঢুকে যায়। পাশাপাশি বুকে-গলায়ও ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। শরীর থেকে সবগুলো গুলি বের করতে পারলেও বাম চোখ থেকে এখনো গুলি বের করতে পারেননি চিকিৎসক।

আন্দোলনে আহত মো. রাকিব জেলা শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কানিকাটা বন্দের বাড়ির মো. রাজিবের ছেলে। সে করিমগঞ্জ সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী। পরিবারের নিষেধ উপেক্ষা করেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সে।

চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিব সবার বড়। অন্য দুই ভাই রাফসান ও রিয়ান শহরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। সবার ছোট বোন মরিয়মের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। রাকিবের বাবা পেশায় একজন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক।

ছয় সদস্যের অভাব অনটনের পরিবার তাদের। এর মধ্যেও চিকিৎসায় খরচ হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে একবার আর্থিক সহায়তা ও সিএমএইচ হাসপাতালে সরকারিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য আরও অর্থ প্রয়োজন। চিকিৎসা না চালিয়ে গেলে অন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে।

গুলি ভেদ করা ভাঙা চশমা। ছবি: সংগৃহীত
গুলি ভেদ করা ভাঙা চশমা। ছবি: সংগৃহীত

রাকিবের পরিবার জানায়, চোখের ছররা গুলি তিনবার অস্ত্রোপচারের পরও চিকিৎসক বের করতে পারেনি। প্রায় ২০ দিনের মতো প্রথমে ঢাকার আগারগাঁও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা চলে রাকিবের। এরপর সিএমএইচ হাসপাতালে রেফার করা হয় তাকে। তিন মাসে তিনবার অস্ত্রোপচার করা হলেও বাম চোখ দিয়ে এখন কিছুই দেখে না রাকিব।

রাকিবের মা রাবেয়া বলেন, ‘আমার তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে রাকিব সবার বড়। অনেক কষ্ট করে ছেলেগুলো পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। আমার স্বামী ১৮ বছর ধরে সিএনজি চালায়। আগে ঢাকায় চালাত। বাচ্চাগুলো হওয়ার পর আমরা দুজন সন্তানদের পড়াশোনার কথা ভেবে কিশোরগঞ্জ চলে আসি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বারবার নিষেধ করার পরও লুকিয়ে আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়েছে। আমার ছেলের চোখের অবস্থা ভালো না। উন্নত চিকিৎসা পেলে অন্তত অন্ধত্ব থেকে বাঁচবে। বড় ছেলেটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল আমাদের। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে নিমেষেই। যে চোখে স্বপ্ন দেখত পুলিশে, সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে সেই চোখই খোয়া গেল। আমি সরকারের কাছে একটাই দাবি জানাই, ছেলের চোখের গুলি যেন বের করে দেওয়া হয়।’

রাকিবের চাচা মো. ইমরান বলেন, ‘আমার ভাতিজার চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে গেছি। পড়াশোনা শেষ করে ইচ্ছে ছিল ভালো চাকরি করবে। বাবার দুঃখ দূর করবে ছেলে, সেই সুযোগ আর পাবে না। এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার যাতে আমার ভাতিজার চোখের গুলি বের করার ব্যবস্থা করে।’

ছাত্র আন্দোলনে আহত রাকিব বলে, ‘গত ৪ আগস্ট পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের সময় অন্য একজনকে রাস্তা থেকে তুলতে গিয়ে বাম চোখের ভেতর গুলি লাগে। প্রথমে বুঝতে না পারলেও চোখ দিয়ে রক্ত বের হওয়ার পর বুঝতে পারি চোখের ভেতরে কিছু একটা গিয়েছে। বর্তমানে বাম চোখে কিছুই দেখতে পারি না। তিনবার অপারেশনের পরও চোখের গুলি বের করা সম্ভব হয়নি।’

রাকিব আরও বলে, ‘ভবিষ্যতে পড়াশোনা করে ইচ্ছে ছিল সেনাবাহিনী অথবা পুলিশে চাকরি করার। কিন্তু চোখ নষ্ট হয়ে গেছে এখন চাকরির শখ আর পূরণ হবে না। আমার বাম চোখের গুলিতে ডান চোখও ব্যথা করে। বাকি জীবন যত দিন বাঁচব তত দিন চোখের ড্রপার ব্যবহার করতে হবে।’

জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান বলেন, ‘যারা জুলাই-আগস্টে আহত হয়েছে এবং বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে তাদের তালিকা এসেছে। চোখের গুলি কী কারণে বের করা যাচ্ছে না, তা একমাত্র চিকিৎসক বলতে পারবে। এখন আন্দোলনে আহতদের বিষয়ে যাচাই বাছাই চলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত