লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৩, ১২: ৪৪
Thumbnail image

প্রখর রোদের মধ্যে দেশের ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ১৯৬তম পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের ঈদের জামাতে লাখের বেশি মানুষ অংশ নেন। আজ শনিবার সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত সর্বোচ্চ মানুষের অংশগ্রহণের এই জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। ১৭৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ঈদগাহের ঐতিহ্য অনুসারে মুসল্লিদের প্রস্তুতির জন্য জামাত শুরুর ১৫ মিনিট আগে তিনটি, ১০ মিনিট আগে তিনটি এবং ৫ মিনিট আগে তিনটি শটগানের গুলি ছোড়া হয়। 

মাঠের সুনাম ও জনশ্রুতির কারণে ঈদের বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সারা দেশের বিভিন্ন জেলা তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, শেরপুর, যশোর, খুলনা ও চট্টগ্রামসহ অধিকাংশ জেলা থেকে শোলাকিয়ায় মুসল্লিদের সমাগম ঘটে। এদের অনেকে ওঠেন হোটেলে, কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার অনেকেই কোথাও জায়গা না পেয়ে রাত কাটান জেলা সদরের বিভিন্ন মসজিদে। 

প্রতিবারের মতো এবারও শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাতে অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে আসেন। দেশের সর্ববৃহৎ এই জামাতে অংশগ্রহণ করতে সকাল থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহের মাঠে। মোবাইল ফোন, ছাতা, দাহ্য পদার্থ ও গ্যাসলাইটের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও লাখ লাখ মুসল্লি সমবেত হন শোলাকিয়া ঈদগাহে। জামাত শুরুর অন্তত দেড় ঘণ্টা আগেই সাত একর আয়তনের শোলাকিয়া মাঠ পূর্ণ হয়ে যায়। ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে আসা দেশ-বিদেশের কয়েক লাখ মুসল্লির ভিড়ে জনসমুদ্রে পরিণত হয় শোলাকিয়া ময়দান। আগত মুসল্লিদের অনেকে মাঠে জায়গা না পেয়ে পার্শ্ববতী রাস্তা, তিনপাশের ফাঁকা জায়গা, নদীর পাড় ও শোলাকিয়া সেতুতে জায়গা করে নিয়ে জামাতের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন। 

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, শোলাকিয়ায় ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলা মাথায় রেখে প্রতিবছর বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রশাসন। এবার ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে ১৬১ জন সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যসহ মোট ১ হাজার ২৯৯ জন পুলিশ, র‍্যাবের আটটি টিম (প্রতি টিমে ছয়জন করে) ও ১০০ বিজিবি সদস্য মোতায়েন ছিল। পুরো মাঠ পর্যবেক্ষণের জন্য বসানো হয়েছিল ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। এ ছাড়া এপিবিএন এবং দুই প্লাটুন বিজিবি ও র‍্যাব মোতায়েন ছিল। পুরো মাঠ নজরদারির জন্য ড্রোন ওড়ে শোলাকিয়ায়। মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে বসানো হয়েছিল ১৩টি আর্চওয়ে। বসানো হয়েছিল সিসি ক্যামেরা। ছিল ড্রোন ক্যামেরাও। এ ছাড়া আনসার সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা থেকে এসেছিল বোম ডিসপোজাল টিম। ছিল ছয়টি অ্যাম্বুলেন্সসহ মেডিকেল টিম। দায়িত্ব পালন করছেন ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মুসল্লিদের তল্লাশি করে ঈদগাহে ঢুকতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এবারই প্রথম প্রচণ্ড গরমের কথা চিন্তা করে মুসল্লিদের জন্য ইলহাম অটো রাইস মিল লিমিটেড ২০ হাজার পানির বোতলের ব্যবস্থা করেন। আর মুসল্লিদের মাঝে এসব পানির বোতল ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ করে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। 

 শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ঈদের জামাতের নামাজে অংশ নেওয়া ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরাজামাত শুরুর আগে ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ সমাগত মুসল্লিদের উদ্দেশে শান্তিপূর্ণ ঈদ জামাত আয়োজনে সহযোগিতা করার জন্য ধন্যবাদ জানান। সেই সঙ্গে সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। জেলা প্রশাসক এবার হাওরের ধান যেন কৃষক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘরে তুলতে পারেন, সে জন্য দোয়া চান। জেলা প্রশাসক ছাড়া পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ, পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ মুসল্লিদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাক সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূরে আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আল আমিন হোসাইন, ঈদগাহ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। 

জামাত শেষে ইমাম বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ খুতবায় দেশ ও জাতির উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর সংহতি ও ঐক্য কামনা করেন। বিশ্ব মুসলিম উম্মার শান্তি ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। জীবিত, মৃত সবার নাজাত ও হেদায়েত কামনা করেন। এ ছাড়া দেশ-জাতি ও মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা এবং পাপ থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন তিনি। লাখো মুসল্লির উচ্চকিত হাত আর আবালবৃদ্ধবনিতার আমিন, আমিন ধ্বনিতে এ সময় মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো ঈদগাহ এলাকা। 

জামাত উপলক্ষে ‘শোলাকিয়া স্পেশাল’ নামে দুটি বিশেষ ট্রেন চলাচল করে। ট্রেন দুটির একটি ভৈরব থেকে, অপরটি ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে কিশোরগঞ্জে যায় এবং নামাজ শেষে মুসল্লিদের নিয়ে ভৈরব ও ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। 

 ১৮২৮ সালে ঈদের জামাতের মধ্য দিয়ে শোলাকিয়া ঈদগাহের গোড়াপত্তন হয়। জনশ্রুতি আছে, শাহ সুফি সৈয়দ আহমদের ইমামতিতে প্রথম ঈদের জামাতের ‘সোয়া লাখ’ মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। আবার কারও মতে, এই পরগণায় খাজনা আদায়ের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। সে কারণে এর নামকরণ হয় শোয়ালাখিয়া থেকে শোলাকিয়া। ১৯৫০ সালে শহরের হয়বতনগরের দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ (মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁর ষষ্ঠ বংশধর) ঈদগাহের জন্য ৪ দশমিক ৩৫ একর জমি শোলাকিয়া ঈদগাহে ওয়াক্‌ফ করেন। পরে আরও কিছু জমি এই ঈদগাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বর্তমানে প্রায় সাত একর জমির ওপর এর অবস্থান। ঈদুল ফিতরে মাঠ ছাড়িয়ে পাশের সড়ক, সেতুসহ অলিগলিতেও মুসল্লিরা ঈদের জামাত আদায় করেন। বর্তমান সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত