Ajker Patrika

উত্তরায় একখণ্ড উত্তরবঙ্গ

রজত কান্তি রায়
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২১, ১১: ০৫
উত্তরায় একখণ্ড উত্তরবঙ্গ

উত্তরার এই অংশটার পরিচয় দেওয়া একটু জটিল। ১২ নম্বর সেক্টরের শেষ প্রান্তে পাসপোর্ট অফিসের ঠিক পেছনে ১০০ গজের মতো দূরে যে বস্তিটি, সেটি পড়েছে ১৫ নম্বর সেক্টরে। কিন্তু মানুষ সেটাকে ১২ নম্বর সেক্টর হিসেবেই চেনে। পাসপোর্ট অফিসের পেছন থেকে উত্তরা নতুন করে বেড়ে উঠছে। ফলে এদিকটা এখনো দালানকোঠার দঙ্গলে পরিণত হয়নি। বিস্তৃত মাঠ আর পাকা রাস্তার ফাঁকে বেশ কিছু টিনের ঝুপড়িঘর। ওগুলোতে থাকেন উত্তরার ৯৫ শতাংশ রিকশাচালক।

এই বস্তিতে আমিনুল ইসলামের চায়ের দোকান। তাঁকে ঘিরে বসে আছেন আট–দশজন। চা-পান-সিগারেট সবই চলছে। সঙ্গে খুনসুটি। আর মোবাইল ফোনে পরিবার কিংবা এলাকার খোঁজখবর নেওয়া। কথা শুনলেই বোঝা যায়, চায়ের দোকান ঘিরে বসে থাকা প্রায় সবাই উত্তরবঙ্গ থেকে আসা। তাঁদের ভাষা একই রকম, কথা বলার অভিব্যক্তিও একই। আর অদ্ভুত বিষয়, আমিনুল ইসলামের মতো দু-একজন বাদে সবার পেশাও একই—রিকশা চালানো।

বাইক থেকে নেমে আমিনুল ইসলামের চায়ের দোকানে ঢুকতেই একটা সাড়া পড়ে গেল। ভেতরে ঢুকতেই আমিনুল বেঞ্চ দেখিয়ে বসতে বললেন। তারপর চিনি খাব কি না, সেটা জেনে নিয়ে চা বানাতে শুরু করলেন। সময় যত গড়ায়, কৌতূহলী চোখের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বহুদিন পর উত্তরার এক বস্তিতে উত্তরবঙ্গের ভাষা শুনে ভালো লাগল—বলা ভালো, প্রাণ জুড়িয়ে গেল। অঞ্চলভেদে উচ্চারণে ব-এ শূন্য র আর ড-এ শূন্য ড়-এর মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য, সেটা রংপুর আর কুড়িগ্রামের মানুষের কথা না শুনলে বোঝা কঠিন। কিংবা মুরগির আরেক নাম যে চড়াই, উত্তরবঙ্গ হলেও শব্দটি যে কুড়িগ্রামের দখলে, তা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় দেখতে হলে ওই বস্তিতে যেতে হবে।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, সবাই উত্তরবঙ্গের মানুষ? একাধিক কণ্ঠে হ্যাঁ-সূচক উত্তর এল। উত্তরবঙ্গ হলেও এখানে সংখ্যাগুরু ও লঘুর বিষয় আছে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে সংখ্যাগুরু কুড়িগ্রাম। সংখ্যালঘুর দলে নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাট। আমিনুলের চায়ের দোকানে যেমন আছেন মোকছেদ আলী, দেলোয়ার হোসেন, সোহাগ, জামাল হোসেন; তেমনি আছেন প্রভাত চন্দ্র কিংবা গলায় তুলসীর মালা জড়ানো সুরেন রায়। সবার মিলের জায়গা, তাঁরা রিকশাচালক। আরও একটি জায়গায় অবশ্য তাঁদের মিল আছে। আর সেটা হলো, তাঁদের উদ্বাস্তু হওয়ার কারণ। খাবারের থালা ভিন্ন হলেও যে মানুষগুলো একসঙ্গে থাকেন, একই টঙে চা খান, আড্ডা মারেন—নিজেদের ভিটেমাটি থেকে তাঁদের উদ্বাস্তু হওয়ার মূল কারণ নদীভাঙন এবং ক্ষুদ্রঋণের সাপ্তাহিক কিস্তি।

কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের মানুষের মরণ দুই দিক দিয়ে— একদিকে নদীভাঙন, অন্যদিকে সাপ্তাহিক কিস্তি। কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার; চিলমারীতে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের এবং কুড়িগ্রাম সদরে ধরলা নদীর ভাঙনে পর্যুদস্ত মোকছেদ, আমিনুল কিংবা জিয়ারুলের পরিবারের মতো শত শত পরিবার। ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে সরে গেছেন পাশের গ্রামে বা পাশের উপজেলায় অথবা আরও দূরে। 

নতুন করে ঘর বেঁধেছেন। সেই ঘরে থাকেন নারী, শিশু আর বয়স্করা। কর্মক্ষম লোকগুলো জীবিকার তাগিদে ‘দ্যাশান্তরি’। এই ‘দ্যাশান্তরি’ মানুষের একটা বড় অংশ ঢাকায়। বেশির ভাগই মায়া কাটাতে পারেননি ভিটেমাটির, পড়শির। তাই একজনের সূত্র ধরে আরেকজন এসেছেন ঢাকায়, রিকশা চালাতে।

লালমনিরহাটের আদিতমারির সোহাগ তিস্তার ভাঙনে দিশেহারা হয়ে এখন কুড়িগ্রামের জিয়ারুলের প্রতিবেশী। উলিপুরের মোকছেদ আলী আর চিলমারীর আমিনুল ইসলাম এখন একই বস্তিতে থাকেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের প্রভাত চন্দ্রের সঙ্গে। তাঁদের সবার ঠিকানা অভিন্ন। সবার কপাল পুড়েছে নদী আর দুর্ভাগ্য কিস্তিতে।

‘বাপরে বাপ! এক রাইতের মইধ্যে বিঘার পর বিঘা জমি চলি গেল! ধারাম ধারাম করি পড়িল কলার গাছ। ঘরবাড়ি কোন্টে যে উড়ি গেল!’ বলছিলেন মোকছেদ। আজ থেকে ১৫–২০ বছর আগে তিনি যখন ঢাকায় আসেন, তাঁর আগের গল্প এটি। তখন জীবন–জীবিকার ভরসা রিকশা। আর পরিচয় রিকশাচালক। সেই পরিচয় আর মোছা হলো না। এখনো বাড়িতে টাকা পাঠান প্রতি সপ্তাহে, কিস্তির টাকা। মোকছেদের একার উপার্জনে সংসার ঠিক চলে না। তাই না চাইলেও কিছু টাকা ঋণ করতেই হয়। আর বছরভর চলে তা শোধ দেওয়ার পালা। এক সপ্তাহ কিস্তির টাকা বাকি রাখা যায় না। যেভাবেই হোক পাঠাতে হয়।

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার প্রভাত চন্দ্রের বাড়ির পাশে কোনো বড় নদী নেই। তাই ভাঙনের ইতিহাস তিনি জানেন না। কিন্তু কিস্তির টাকা এক সপ্তাহ না দিতে পারলে যে পরিবার নিয়ে সম্মানের সঙ্গে এলাকায় থাকা যাবে না, সেটা ঠিক বুঝেছিলেন তিনি। এলাকায় তেমন কাজ নেই বলে টাকা আয়ের জন্য ঢাকায় আসা। সেই থেকে ঠিকানা এই বস্তি। জাতীয় পরিচয়পত্র এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইটা হামার আসল ঠিকানা সার।’  

আমিনুল ইসলামের চায়ের দোকানে একসঙ্গে গড়গড় করে কথা বলতে চান ১৫–২০ জন। সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই। সবাই বলতে চান নিজের পরিবারের কথা, নিজের গ্রামের কথা। যতটুকু শোনা যায়, শুনি। শুনতে শুনতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ সমতলভূমির ছবি। ভেসে ওঠে তিস্তা, ধরলা বা ব্রহ্মপুত্রের উত্তাল ছবি, ভাঙতে থাকা পাড়। মনে পড়ে বাঘারুর কথা। মনে হয়, তিস্তার চর ধরে সোজা দক্ষিণ দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাঘারুরা চলে এসেছেন উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের বস্তিতে। গায়ে তাঁদের উত্তরের গন্ধ। ১৫ বা ২০ বছর শহর ঢাকার অভিজাত উপকণ্ঠে বসবাস করেও তাঁদের শরীর থেকে সেই গন্ধ যায়নি। সে জন্যই নদীভাঙনের কথা ভাবতে ভাবতে কিস্তির টাকা হয়তো আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে—এই সুখস্বপ্ন দেখতে দেখতে তাঁরা অনায়াসে জীবন নিয়ে উপহাস করতে পারেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান হওয়া ইরানি নারী এখন পানামার জঙ্গলে

বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা হলেই মেয়াদ শেষ নতুন পরিচালনা কমিটির

ঢাবি ছাত্রীকে যৌন হেনস্তাকারীর পক্ষে নামা ‘তৌহিদী জনতার’ আড়ালে এরা কারা

এনসিপিকে চাঁদা দিচ্ছেন ধনীরা, ক্রাউডফান্ডিং করেও অর্থ সংগ্রহ করা হবে: নাহিদ ইসলাম

ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান, সন্তানসহ ছিটকে পড়তেই তরুণীর গালে ছুরিকাঘাত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত