‘থার্টি ফার্স্টের আতশবাজির শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল শিশুটি’

আল-আমিন রাজু, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১৮: ১৭
আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২২, ১৬: ৪০

তানজীম উমায়ের। বয়স মাত্র সাড়ে চার মাস। শত চেষ্টা করেও ছেলেকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন বাবা ইউসুফ রায়হান ও মা তানিয়া। থার্টি ফার্স্টে আতশবাজি শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছিল শিশুটি। থার্টি ফার্স্টের নাইটের পরদিনই বাবা-মার আদর উপেক্ষা করে চিরতরে যায় উমায়ের। 

আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ইউসুফ রায়হানের। বলেন, ‘আমার বাবুটার হার্টে সমস্যা ছিল। অনেক জায়গায় ডাক্তার দেখিয়েছি। সর্বশেষ ডিসেম্বরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ডাক্তার শামসুদ্দিনকে দেখিয়েছি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অপারেশন করার কথা ছিল। অপারেশনটা হলে আমার ছেলে ৯৫ ভাগ সুস্থ হয়ে যেতো। ডাক্তার আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটা যেন কোনোভাবে না কাঁদে। কারণ ও কাঁদলে শ্বাস আটকে যেত। ফলে ছেলেটা অস্বাভাবিক ঘামতো। তাই আমরা কখনো উমায়েরকে কাঁদাতাম না। তবুও কখনো যদি কাঁদত তাহলে নেবুলাইজার দিতে হতো। না হলে ও শ্বাস নিতে পারত না।’ 

বছরের শেষ দিনে ছেলেটি স্বাভাবিকই ছিল। শুয়ে শুয়ে খেলছিল। গত শুক্রবার থার্টি ফার্স্ট নাইটের বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্ষোভ ও আগে নিয়ে ইউসুফ বলেন, ‘শুক্রবার সারা দিন ছেলেটা সুস্থ ছিল। আমি দুপুরের পর থেকে দোকানে ছিলাম। সন্ধ্যার পরে আমার স্ত্রী ভিডিও কল দিয়ে বলেছিল, ছেলেটা আজ খুব আনন্দিত। নিজে নিজে খেলাধুলা করছে। আমাকে দ্রুত বাসায় যেতে বলে ছেলের মা। কারণ ও বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকে। আজ খেলাধুলা করছে দেখার জন্য দ্রুত বাসায় যেতে বলে। আমার স্ত্রী তখনই আমাকে বলেছিল তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে কারণ আতশবাজিতে ছেলে ভয় পেতে পারে। আমিও একটু আগেভাগে দোকান বন্ধ করি। বাসায় ফিরে দেখি উমায়েরের মা তাকে ফিডার খাওয়াচ্ছে। কারণ ও বুকের দুধ পেত না। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আতশবাজি শব্দ বাড়ছিল। একটা পর্যায়ে অনেক শব্দ হচ্ছিল। ছেলেটা তখন রীতিমতো কাঁপছিল। তখন আমি ও আমার স্ত্রী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলাম। বাবুটা ভয়ে কেঁপে উঠতেছিল। যেহেতু ডাক্তার আমাদের অনেক যত্নসহকারে ছেলের খেয়াল রাখতে বলেছিল। ও যাতে কান্না না করে। কারণ ও কাঁদলে শ্বাসকষ্ট হয়। আর পুরো শরীর ঘেমে যায়। আর যদি কখনো কান্না করে তাহলে ডাক্তার বলেছিল নেবুলাইজার দিতে। বাসায় নেবুলাইজার দিতাম।’ 

ইউসুফের দ্বিতীয় সন্তান উমায়েরের হৃদ্‌যন্ত্রে জন্মগতভাবে ছিদ্র ছিলশুক্রবার রাতে অনেকবার নেবুলাইজার দেওয়া হয়। নেবুলাইজার দিলে একটু শান্ত থাকত। কিন্তু ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর আবার কান্নাকাটি করে। এভাবে রাতটা পার হয়। পরের দিন শনিবার সকালে ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান ইউসুফ। ডাক্তার ছেলেকে দেখে ঘাবড়ে যান। বলেন, আরও আগে কেন নিয়ে আসা হয়নি। ইউসুফ বলেন, ‘ছেলে প্রচুর ঘামছিল। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিকেল ৩টার দিকে ছেলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় ডাক্তাররা আইসিইউতে নেন। ৪টার দিকে আমি নামাজ পড়তে মসজিদে যাই। তখন আমার স্ত্রী ফোন করে দ্রুত ওপরে ডাকে। গিয়ে দেখি ডাক্তাররা আইসিইউর ভেতরে ছেলের বেডের কাছে জড়ো হয়ে পালস ফেরানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট কেটে যায়। বিকেল ৫টার দিকে ডাক্তাররা আমাকে বলেন, আপনার ছেলে আর বেঁচে নেই। আমি নিজ চোখে দেখলাম, আইসিইউয়ের পালস ডিসপ্লেতে কোনো পালস নেই। মৃত্যু সনদে ডাক্তাররা লিখে দিয়েছেন, আমার ছেলে হার্ট ফেল করেছে।’ 

এসব বলতে বলতে কান্নার দমকে কণ্ঠ বুঁজে আসছিল ইউসুফের। একটু সামলে নিয়ে বলেন, ‘আমার ছেলেকে মাত্র সাড়ে চার মাস বয়সে হারাতে হলো। কত কষ্ট করেছি ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে! ওর সামান্য কোনো সমস্যা দেখলেই আমরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। সোহরাওয়ার্দী, শিশু হাসপাতালসহ কত হাসপাতালে যে ছেলেকে দেখিয়েছি! আমার ছেলে জন্মের পর থেকে এক মাস ১০ দিন সুস্থ ছিল। এরপর অসুস্থ হয়ে যায়। তখন বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলেকে ডাক্তার দেখাই। হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা শনাক্ত করে হৃদ্‌যন্ত্রে সমস্যা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে হার্টের অপারেশন করার কথা ছিল। আর মাত্র দুইটা মাস গেলেই আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে যেত।’ 

ইউসুফ বলেন, ‘ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে নিউমোনিয়া নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উমায়েরকে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ভর্তি করা হয়। চার দিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় আসে। নিউমোনিয়ার কারণে শ্বাসের সমস্যাটা আরও বেড়ে যায়। বাসায় আসার এক সপ্তাহ পরে গত (৩০ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার তাকে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। ডাক্তারের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে তাকে দেখানো যায়নি। ডাক্তার উমায়েরকে ১ জানুয়ারি নিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেই এক তারিখই নিয়ে গেলাম কিন্তু আর বাসায় ফেরত আনতে পারলাম না!’ 

ইউসুফের দ্বিতীয় সন্তান উমায়েরের হৃদ্‌যন্ত্রে জন্মগতভাবে ছিদ্র ছিল

নবীনগরে মোবাইল ফোনের ব্যালেন্স লোডের ব্যবসা করেন ইউসুফ। ছয় বছরের দাম্পত্য জীবনে জুবায়ের হাসান নামের পাঁচ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। গত আগস্টে জন্ম নেয় দ্বিতীয় সন্তান উমায়ের। দুই সন্তান নিয়ে সুখী দম্পতি ইউসুফ-তানিয়া। ছোট ছেলে উমায়েরকে হারিয়ে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি তানিয়া। ইউসুফ বলেন, ‘ছেলেটার ১ মাস বয়স থেকে ওর অসুস্থতার শুরু। কত দিন-রাত যে হাসপাতালে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে তার হিসাব নাই! ছেলেকে সুস্থ করতে আমার স্ত্রী সব সময় চেষ্টা করতেন। এখন ছেলেকে হারিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছে না। এখন অন্য মানুষের শিশুদের দেখলে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।’ 

উমায়েরের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডাক্তার কী বলেছেন জানতে চাইলে ইউসুফ বলেন, ‘অতিরিক্ত শব্দের কারণেই তার হার্টফেল হয়েছিল কি-না, আমরা তা বলতে পারব না। তবে সেই বিকট শব্দের কারণে বারবার কাঁপতে থাকা ছেলেটির সেই মুহূর্তের চেহারা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। মৃত্যু সনদে ডাক্তার লিখেছে “হার্ট ফেইল করেছে”।’ 

ইউসুফ বলেন, ‘বাসায় সেই সময়ে আমার এক অসুস্থ খালা ছিলেন। তিনিও আতশবাজি শব্দের কারণে করণে কষ্ট পাচ্ছিলেন। তিনি বয়স্ক মানুষ হয়ে যদি এই অবস্থা হয়। তাহলে আমার শিশুটার ভেতরে কী হয়েছে বুঝতেই পারছেন!’ 

আতশবাজি, ফানুস মানুষের উপকারে আসে না বরং ক্ষতি করে উল্লেখ করে ইউসুফ বলেন, ‘ফানুস কিংবা আতশবাজি মানুষের ক্ষতি করে। শিশু ও বয়স্কদের জন্য কত বড় ভয়াবহ তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। এগুলো বন্ধ করা উচিত।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত