লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাওয়ায় ডিভোর্স

রায়পুরা (নরসিংদী) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২২: ১৩

লেখাপড়া করতে চাওয়ায় পাঁচ মাসের শিশু সন্তানসহ এক গৃহবধূকে ডিভোর্স দিয়েছেন তাঁর স্বামী শাহজালাল আহম্মেদ রাসেল। আগে ওই গৃহবধূকে নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে তাঁর বাবার বাড়িতে ডিভোর্সের চিঠি পাঠানো হয়েছে। 

এ বিষয়ে গত ১০ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তিনজনকে আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ। প্রথমে যৌতুক নিরোধ আইন এবং দুই দিন পর নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে আরও একটি মামলা করেন। এ মামলার আসামিরা হলেন, গৃহবধূর স্বামী শাহজালাল আহাম্মেদ রাসেল, শ্বশুর ফরিদ মিয়া ও শাশুড়ি রিনা বেগম। 

ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূর নাম নাজিয়া ইসলাম সেতু (১৯)। উপজেলার সররাবাদ গ্রামের গোলাম মোস্তাফার বড় মেয়ে সেতু। তিন সন্তানের মধ্যে সেতু পরিবারের বড়। তিনি এসএসসি ও এইচএসসি দুটি পরীক্ষাতেই জিপিএ ৫ পেয়েছেন। অন্যদিকে শাহজালাল আহম্মেদ রাসেল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের মাহমুদাবাদ গ্রামের মো. ফরিদ মিয়ার ছেলে। 

জানা যায়, মো. ফরিদ মিয়া তাঁর একমাত্র ছেলে শাহজালাল আহম্মেদ রাসেলের জন্য সেতুকে নিজে পছন্দ করেন। ২০২১ সালের ১৫ জানুয়ারি পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়। 

ভুক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, নারায়ণপুর সরাফত উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ার পর নরসিংদী মডেল কলেজ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ ৫ পায় সেতু। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করার সময় বিয়ের প্রস্তাব আসে। লেখাপড়া বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতিতে সেতুর পরিবার বিয়ে দিতে রাজি হয়। 

ভুক্তভোগী সেতু জানান, বিয়ে পর ভালোই চলছিল তাঁদের। কিন্তু সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই শ্বশুর-শাশুড়ি গর্ভ নষ্ট করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। স্বামী রাসেল প্রথমে বাবা হওয়ার খবর শুনে খুশি হলেও পরে তিনিও বাবা-মায়ের পক্ষ নেন। একটি ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠের পর থেকে লেখাপড়া বন্ধ করতে চাপ দিতে থাকেন তাঁরা। রাজি না হওয়ায় শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। 

সেতু বলেন, ‘পরিবারের আদরের সন্তান ছিলাম। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি তাই সাংসারিক কাজকর্ম জানি। কিন্তু আমার শ্বশুর চায় সব কাজ যেন আমি একা করি। আমার সিজারের মাধ্যমে সন্তান হয়। সিজারের চতুর্থ দিন স্বামী থাপ্পড় দিলে মাটিতে পড়ে যাই। ফলে সেলাইয়ের জায়গায় ইনফেকশন হয়ে শরীরে জ্বর আসে। তবুও ২০ তম দিন জোর করে আমাকে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সংসারের সব কাজ করতে দেয়। একদিন ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য আধঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলাম বলে আমার শ্বশুর বুকের দুধ খাওয়াতে দিত না। বলে এত সময় দুধ খাওয়ালে কাজ করব কখন? তারপর বাজারের প্যাকেট দুধ খাওয়ানো শুরু করি। ফিডার বানিয়ে দিলে শ্বশুর দুধ খাওয়ায় আর আমাকে কাজ করতে দেয়। বাচ্চা কান্না করলে শ্বশুরের কোল থেকে আনতে গেলে ধমক দিয়ে বলে আমি নাকি বেয়াদব। সারা দিন ছেলেকে আমার কোলে দিত না। শুধু রাতে ছেলেকে কাছে পেতাম। শত কাজ করেও কোথাও একটু ভুল হলে শ্বশুর-শাশুড়ি গালাগালি করে। দুই দিন রাত ৮টার সময় আমাকে দিয়ে কাজ হয় না, ডিভোর্স দিয়ে দিবে বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চেয়েছে। সন্তানের দিকে তাকিয়ে তাদের অত্যাচার সহ্য করে এসেছি। সর্বশেষ আমার স্বামী ব্যবসা করবে বলে ১০ লাখ টাকা চায় আমার কাছে। না দিতে পারায় আমাকে শ্বশুরের আদেশে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু আমি ভাবিনি গোপনে সে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তিন দিন আগে জানতে পারি নোটারির মাধ্যমে গত ৯ ফেব্রুয়ারি আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।’ 

সেতু আরও বলেন, ‘৫ মাসের সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে কষ্টে জীবন যাপন করে যাচ্ছি। সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় দিন যাচ্ছে আমার।’ 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সেতুর শ্বশুর ফরিদ মিয়া বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে সেতুর বনিবনা হতো না। প্রায়ই নাকি আমার ছেলের গায়ে হাত তুলত সেতু। তা ছাড়া সে কিছু বিষয়ে আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। আমার ছেলের ইচ্ছাতেই ডিভোর্স দেওয়া হয়েছে।’ পুত্রবধূকে ফিরিয়ে আনবেন কি না জানতে চাইলে ফরিদ মিয়া বলেন, ‘সেটা ছেলে বলতে পারবে।’ এ সময় তাঁর ছেলে রাসেল বাড়িতে ছিলেন না। 

লেখাপড়া বন্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদ আরও বলেন, ‘লেখাপড়া করে সংসারে সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। ছেলেও চাইছিল না সেতু লেখাপড়া করুক। তাই আমি সেতুকে লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বুঝিয়ে বলেছিলাম।’ 

এ বিষয়ে থানায় এখনো কোনো অভিযোগ আসেনি বলে জানান রায়পুরা থানার ওসি আজিজুর রহমান। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত