বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন: পঙ্গু হাসপাতালে এখনো ভর্তি আহত ৮৩ জন

  • পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সহস্রাধিক আহত ব্যক্তি
  • ভর্তি হন ৪২৫ জন, ১৭ জনের পা ও চারজনের হাত কাটতে হয়েছে
  • চিকিৎসকেরা বলছেন, চিকিৎসাধীন রোগীদের সুস্থ হতে এক বছরের বেশি লাগবে
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮: ৪৫
Thumbnail image
পঙ্গু হাসপাতাল পরির্দশে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম । ছবি: পিআইডি

গোলাম মোস্তফা। বয়স ৩৫ বছর। পঙ্গু হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) চিকিৎসাধীন। গুলিতে তাঁর ডান হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত হাড় ভেঙে কয়েক টুকরা হয়েছিল। গত ২৩ জুলাই ভর্তি হওয়ার পর থেকে হাতে ১০ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। পেশায় নিরাপত্তাকর্মী মোস্তফা গুলিবিদ্ধ হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায়। অ্যালুমিনিয়ামের খাঁচা পরানো হাত দেখিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা বলেছেন হাড় জোড়া লাগতে কমপক্ষে এক বছর লাগবে। এরপরও না লাগলে শরীরের অন্য জায়গা থেকে হাড় এনে লাগানো হবে।

শুধু মোস্তফা নন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত আরও ৮২ জন এখনো শেরেবাংলা নগরের বিশেষায়িত এ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ওপর এসব রোগীর সুস্থ হওয়া নির্ভর করছে। কাউকে কাউকে আরও কয়েক মাস হাসপাতালে থাকতে হবে।

বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সারা দেশে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকে এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত সহস্রাধিক মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান বলেছে, ১৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আহত ৭৬৯ জন এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে ৪০৯ জন ছিল‍েন গুলিবিদ্ধ। ভর্তি হয়েছেন মোট ৪২৫ জন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জনের পা ও চারজনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। আন্দোলনে আহতদের ৮৩ জন এখনো চিকিৎসাধীন। তাঁদের প্রায় সবারই হাত বা পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকিরা চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন বা পরবর্তী চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে গেছেন। তবে সবাইকে নিয়মিতভাবে হাসপাতালে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ওপর নির্ভর করছে তাঁদের সুস্থতা।

চিকিৎসকেরা জানান, এখনো ভর্তি থাকা ব্যক্তিদের সুস্থ হতে আরও এক বছরের বেশি লাগবে। কারও কারও লেগে যাবে দুই বছর।

চিকিৎসার খোঁজখবর না নেওয়া, আর্থিক সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ এনে গত বুধবার দুপুরে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টাকে ঘেরাওয়ের পর হুইলচেয়ারসহ এসে সড়ক অবরোধ করেন। তাঁদের দাবি অনুযায়ী তিন উপদেষ্টা সেখানে যাওয়ার পর রাত ৩টার দিকে তাঁরা অবরোধ তুলে নেন।

গতকাল সরেজমিনে ওই হাসপাতালে দেখা যায়, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ‘এ’ ও ‘বি’ ওয়ার্ডে। তাঁরা জুলাইয়ের শেষার্ধ থেকে আগস্টের শুরুতে ভর্তি হয়েছেন। গোলাম মোস্তফা হাতে অ্যালুমিনিয়ামের খাঁচা নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে শুয়ে আছেন ‘বি’ ওয়ার্ডে। তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে, বাড্ডায় ভাড়া বাসায় থাকেন সপরিবারে। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১৯ জুলাই রামপুরায় পুলিশ তাঁর ডান হাতে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। ২৩ জুলাই তাঁকে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুলিতে তাঁর ওই হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত ৫ ইঞ্চি হাড় ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেছে। চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, খাঁচা আরও এক বছর রাখতে হবে। এর মধ্যে হাড় জোড়া না লাগলে শরীরের অন্য স্থান থেকে হাড় এনে এখানে লাগানো হবে।

মোস্তফা বলেন, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড্ডায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আহত হওয়ার পর থেকে আয় বন্ধ। বকেয়া পড়েছে বাড়িভাড়া। বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া অনুদানে চলছে চিকিৎসাখরচ। সেই টাকাও ফুরিয়ে এসেছে। বড় চিন্তা, পরিবারের খরচ জোগাবেন কীভাবে। শরীরের যে অবস্থা তাতে কাজে ফিরতে কত বছর লাগবে, তা জানেন না তিনি। গ্রামেও কোনো সম্পদ নেই।

একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আহমদ। ৪ আগস্ট আন্দোলনকালে পুলিশের পিকআপের চাপায় তাঁর কোমর থেকে ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভেঙে গেছে। চারবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। কোমরের হাড়ের কিছু অংশ এনে পায়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত অ্যালুমিনিয়ামের খাঁচা দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি জানান, ধাওয়া খেয়ে পুলিশ পিছু হটার সময় পিকআপ ভ্যান দ্রুতগতিতে পিছিয়ে এলে তিনি চাকার নিচে পড়ে যান। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন উন্নতি হচ্ছে। তবে সুস্থ হতে সময় লাগবে। পায়ে খাঁচা রাখতে হবে দেড় বছরের মতো।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের উপপরিচালক বদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত যেসব রোগী আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছিলেন বা এখনো ভর্তি রয়েছেন, তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য আমাদের চিকিৎসকেরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বাবদ ৮৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছে নিটোর হাসপাতালের সমাজসেবা কার্যালয়। নিটোরের সমাজসেবা কর্মকর্তা মোসা. রওশনারা খাতুন বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার সব ব্যয় সরকার ও বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়ার পর হাসপাতালের সমাজসেবা কার্যালয় থেকে খরচ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত