ছয় বছর আগে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার মূল সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় ভারতে পলাতক অবস্থায় মাদক চোরাচালান করত। নাম বদলে সেখানে তিনি নিয়েছিলেন রেশন কার্ড, বাগিয়েছেন নাগরিকত্বও। গাঁজা ও ফেনসিডিলের মতো মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে তাকে মাঝে মাঝেই দেশের ভেতরে আসতে হতো ৷ আর এটাই কাল হলো তাঁর, ধরা পড়লেন র‍্যাবের হাতে।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরার ভোমরা এলাকা থেকে র‍্যাবের হাতে ধরা পড়েন লিটন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া এই আসামি।

সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডের পর চন্দন ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে শাওন রায় নামে ভুয়া নাগরিকত্ব, আঁধার/রেশন কার্ড করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। এই সময় ভারত-বাংলাদেশের রংপুর ও গাইবান্ধা সীমান্ত নিকটবর্তী হওয়ায় সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকের চালান বাংলাদেশে পাঠাতেন। সম্প্রতি মাদক সংক্রান্ত কাজে তিনি কিছুদিন যাবৎ সাতক্ষীরায় সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এমন তথ্যের ভিত্তিতে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তবর্তী ভোমরা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। মাদকের অর্থ সংগ্রহ, মাদকের ব্যবসা তদারকি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে সে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মাদক চোরাচালান সংক্রান্ত কাজ শেষে আবার ভারতে চলে যেতেন চন্দন। 

মূলত গাইবান্ধা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল কাদের খানের পরিকল্পনায় এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। আর হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের সম্পূর্ণ কাজ তদারকি করেন চন্দন। পুরোনো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে না পেরে ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ডটি সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে বলে র‍্যাবের কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন চন্দন। 

মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও চন্দনকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৬ সালে প্রথম দিকে এমপি লিটনকে হত্যার পরিকল্পনার বিষয়ে গ্রেপ্তারকৃত চন্দন কুমার রায়কে জানান আবদুল কাদের খান। চন্দন ও আবদুল কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ৩১ ডিসেম্বর এমপি লিটনকে তাঁর নিজ বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। 

এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এমপি লিটনের ছোট বোন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। একজন সংসদ সদস্যে খুনের ঘটনা তখন দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা পরের বছর ৩০ এপ্রিল মূল পরিকল্পনাকারী আবদুল কাদের খানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। যার মধ্যে হত্যাকাণ্ডের প্রধান সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় ছাড়া অন্য সাতজন গ্রেপ্তার হয়। তারপর দুই বছরের মাথায় ২৮ নভেম্বর বিচার কার্যক্রম শেষে গ্রেপ্তার ৬ জন এবং পলাতক আসামি চন্দনসহ সাতজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। অপর একজন আসামি সুবল চন্দ্র কারাগারে বিচার চলকালীন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। 

চন্দন দীর্ঘ সময় সুন্দরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহদপ্তর বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় এমপি লিটনের সমর্থিত লোকজনের সঙ্গে তাঁর মারামারির ঘটনা ঘটে এবং তিনি গুরুতর আহত হন। চন্দনের বরাত দিয়ে র‍্যাব বলেছে, এমপি লিটনের প্ররোচনায় একই সময়ে একটি মামলার আসামি দেখিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করানো হয় এবং ১৯ দিন কারাগারে থাকতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ অন্যান্য মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে সে এমপি লিটনের সহযোগিতা চান; কিন্তু এমপি লিটন তাকে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে বলায় তিনি এমপি লিটনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। পরবর্তীতে বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতি, চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৬ সালের প্রথমদিকে এমপি লিটন তাকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করেন। পরবর্তীতে আবদুল কাদের খানের পিএস ও এমপি লিটন হত্যাকাণ্ড-এর অন্যতম সহযোগী শামসুজ্জোহার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আবদুল কাদের খানের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়। চন্দনের ভগ্নিপতি সুবল রায় এমপি লিটনের বাড়ির দারোয়ান হিসেবে কাজ করার সুবাদে এমপি লিটনের গমনাগমনের বিষয়ে তথ্য জানা সহজ ছিল চন্দনের। এমপি লিটনকে হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় আবদুল কাদের খান গ্রেপ্তারকৃত চন্দনের সহযোগিতায় হত্যাকাণ্ডের নতুন পরিকল্পনা করেন বলে জানায়। 

জানা যায় যে, গ্রেপ্তারকৃত চন্দন কুমার রায় ২০১০ সালের দিকে রাজধানীর একটি অনলাইন পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। দুই বছর সাংবাদিকতা করার পর গাইবান্ধা ফিরে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া চন্দনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।