দুই নতুন মুখের কাছে ধরাশায়ী প্রতিমন্ত্রী স্বপন ও শাহীন চাকলাদার 

জাহিদ হাসান, যশোর
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ২৩: ৪৩

যশোরে দুটি আসনে চমক দেখিয়ে নৌকা প্রতীকের দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন নতুন মুখের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে চমক দেখিয়ে সাড়ে ৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলাম। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শাহীন চাকলাদার এমপি পেয়েছেন ৩৯ হাজার ২৬৯ ভোট। 

অন্যদিকে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী ও স্থানীয় সরকার, সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য পরাজিত হয়েছেন জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ইয়াকুব আলীর কাছে। সাড়ে চার হাজার ভোটে টানা দুইবারের সংসদ সদস্যকে পরাজিত করেছেন প্রথমবারের মতো যেকোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া ইয়াকুব আলীর কাছে। 

আজ রোববার ভোটগ্রহণের পর রাত পৌনে ৯টায় জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে ফলাফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার। 

তথ্যমতে, যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার নৌকা প্রতীক নিয়ে ৩৯ হাজার ২৬৯ ভোট পেয়েছেন। বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলাম ঈগল প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৯৪৭ ভোট। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা এইচ এম আমিন হোসেন ‘কাঁচি’ প্রতীকে পেয়েছেন ১৭ হাজার ২০৯ ভোট। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিএম হাসান ‘লাঙ্গল’ প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৬৪০ ভোট। 

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে হাতুড়ি বাহিনীর কাছে কেশবপুর উপজেলা জিম্মি হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যদের হাতে সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। তাদের বেপরোয়া আচরণের হাত থেকে দলের ত্যাগী নেতা–কর্মীরাও রেহাই পাননি। তবে যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের শাহীন চাকলাদার নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় কেশবপুরের চিত্র পাল্টে যায়। হাতুড়ি বাহিনীর সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যায়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বর্তমানে আওয়ামী লীগে হাতুড়ি বাহিনী না থাকলেও শাহীন চাকলাদারের অনুসারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। 

স্বজনপ্রীতি, বিভিন্ন স্থানে নিয়োগের নামে বিএনপি নেতা-কর্মীদের পুনর্বাসন, অনিয়ম ও দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার বর্তমানে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে এক সময়ের ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ এখন গ্রুপ; উপ গ্রুপে বিভক্ত। যার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এইচ এম আমির হোসেন ও আজিজুল ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন। তাতে জমে ওঠে যশোর-৬ আসনের নির্বাচন। 

শাহীনের বিরোধী শক্তিরা তাকে হটাতে নির্বাচনী মাঠে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজুল ইসলামের পক্ষে। এ ছাড়া শাহীন চাকলাদার কেশবপুরের সংসদ সদস্য হলেও তাঁর বাসা যশোর সদরে। প্রায় ২৮ বছর কেশবপুরবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি পায়নি। ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না পাওয়াতে উপজেলাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের। 

স্থানীয় এমপি চাই—এমন স্লোগান নিয়ে এবার শাহীন বিরোধীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী আজিজের পক্ষে কাজ করেছেন বলেই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও তিনি বিজয়ী হতে পারেনি। 

স্থানীয় সরকার, সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য ও শাহীন চাকলাদার। ছবি: সংগৃহীত অন্যদিকে যশোর-৫ (মনিরামপুর) আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী স্থানীয় সরকার, সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য পরাজিত হয়েছেন জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি ইয়াকুব আলীর কাছে। যশোর-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলী ৬০ হাজার ৯৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য পেয়েছেন ৫৫ হাজার ৫৮৭ ভোট। 

নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকার টিপু সুলতানকে পরাজিত করেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বপন ভট্টাচার্য। সবশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে স্বপন ভট্টাচার্য নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পান। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে এমপি ও তার পরিবারের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি-অনিয়ম এবং দলের নিবেদিত প্রাণদের ওপর নিপীড়নের কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ স্বপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে নেই। তার ভাগনে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চু ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগে কারাগারেও গেছেন। ভবদহ অঞ্চলের নদী খননে তার ছেলের কাজ পাওয়া এবং সেই কাজে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। 

এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপারে সংসদ সদস্যের অবস্থান নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন আলোচনা। নব্য আওয়ামী লীগারের কারণে মনিরামপুরে ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। তারা এখনো আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ান। পাশাপাশি এই আসনে সংখ্যালঘু ভোটার সবচেয়ে বেশি। সেখানে মন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া নিয়ে সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও হয়েছে। 

এ জন্য তারা নৌকার প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও প্রতিমন্ত্রী স্বপন বিজয়ী হতে পারেনি। এদিকে, জেলার দুই শীর্ষ ও বর্তমান সংসদ সদস্যরা পরাজিত হওয়াতে এই দুই প্রার্থীর বিরোধী পক্ষেদের মাঝে আনন্দ বন্যা বইছে। দুই উপজেলায় মিষ্টি ও বিজয় মিছিল বের করতে দেখা গেছে। 

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনে ভোটযুদ্ধে নামেন ৩২ জন প্রার্থী। নৌকার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ৮ প্রার্থী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যশোরের চারটি আসনে যশোর-১ (শার্শা) আসনে শেখ আফিল উদ্দিন (নৌকা), যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে ডা. তৌহিদুজ্জামান তুহিন (নৌকা), যশোর-৩ (সদর) আসনে কাজী নাবিল আহমেদ (নৌকা), যশোর-৪ (অভয়নগর-বাঘারপাড়া) আসনে এনামুল হক বাবুল (নৌকা) বিজয়ী হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত