গ্রামেও শিশুরা আসক্ত অনলাইন গেমসে

  • আগে যেখানে শোনা যেত ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ, ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপ্রতি উড়ে যা’।
  • এখন শোনা যায় ‘বোমা মার’, ‘গুল্লি মার’, ‘সাইডে যা’, ‘রিজার্ভ দে’, ‘হিল কর’, ‘স্মোক মার’।
  • মাঠ ছেড়ে অনলাইন গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে শিশু-কিশোর-তরুণেরা।
  • আচরণে পরিবর্তন এসেছে, শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গেও বেয়াদবি করছে।
মহিউদ্দিন রানা, ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ) 
Thumbnail image

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সোহাগী ইউনিয়নের বৈরাটি গ্রাম। উপজেলা শহর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব অন্তত ১০ কিলোমিটার। কয়েক বছর আগেও পড়ন্ত বেলায় গ্রামটিতে শোনা যেতে শিশু-কিশোরদের হইহুল্লোড়—ওপেন টি বায়োস্কোপ, ইচিং বিচিং চিচিং চা, প্রজাপ্রতি উড়ে যা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ। আবার কেউ কেউ ব্যস্ত থাকত কাবাডি, গোল্লাছুট, লুকোচুরি নিয়ে।

কিন্তু সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে শোনা যায়—‘এই তুই বোমা মার’, ‘গুল্লি মার’, ‘সাইডে যা’, ‘রিজার্ভ দে’, ‘হিল কর’, ‘স্মোক মার’ প্রভৃতি শব্দ। জটলা বেঁধে বসে থাকা ওই শিশু-কিশোরদের প্রত্যেকের হাতেই ছিল স্মার্টফোন। তারা এখন মাঠ ছেড়ে অনলাইন গেমসে সময় কাটাচ্ছে।

এ চিত্র কেবল বৈরাটির নয়, উপজেলার সব গ্রামেরই। আধুনিকতার আধিপত্যে বিলুপ্ত হয়েছে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা। এর জায়গা দখলে নিয়েছে ফ্রি ফায়ার, পাবজিসহ নানা ধরনের অনলাইন গেমস। দীর্ঘ সময় ডিভাইসে আসক্ত থাকায় দিন দিন আচরণ বদলে যাচ্ছে শিশু-কিশোর-তরুণদের। দূরে সরে যাচ্ছে পড়াশোনা থেকেও। জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবনেও। এই অবস্থায় উদ্বেগ বেড়েছে অভিভাবকদের।

এ বিষয়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার। তাঁরা জানান, শিশু-কিশোরদের হাতে মোবাইল ফোনের অভ্যাসটা তৈরি হয় করোনাকাল থেকে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস হতো তখন। সেই যে মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল, দিন দিন এর প্রবণতা আরও বেড়েছে। এখন অস্বাভাবিক আচরণ করে।

সরিষা ইউনিয়নের এনায়েতনগর গ্রামের আব্দুর রশিদ নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে সকাল-বিকেল খালি টাকা চায়। টাকা না দিলেই তার মাসহ আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে দেয়। একপর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম, মোবাইলে কি সব গেমস খেলায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।’

জাটিয়া ইউনিয়নের কুমারুলী উচ্চবিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক শিক্ষার্থী আগে নিয়মিত থাকলেও সম্প্রতি অনিয়মিত হয়ে যায়। তার সহপাঠীদের মাধ্যমে জানা যায়, সে অনলাইন গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ধূমপানও ধরেছে। পরে তাকে হাতেনাতে ধরে শাসন করলে উল্টো সেই শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করে। অভিভাবককে জানালেও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি; বরং বেশি চাপ দিলে নাকি স্কুলে আসাই বন্ধ করে দেবে বলে জানায়।

তারুন্দিয়া ইউনিয়নের সাখুয়া আদর্শ বিদ্যানিকেতনের (উচ্চবিদ্যালয়) প্রধান শিক্ষক হাসিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল গেমসের আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সেটি করতে হলে অভিভাবকদের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সচেতন মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে।’

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রতিষ্ঠানপ্রধানদেরকে বারবার বলে দিয়েছি, কোনো শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে অভিভাবককে যেন ডেকে আনা হয়, পাশাপাশি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণ জানতে চাওয়া হয়। কারণ, অভিভাবেকেরা সচেতন না হলে শিক্ষকদের একার পক্ষে শিক্ষার্থীদের বাজে অভ্যাস থেকে ফেরানো সম্ভব নয়।’

খেলাধুলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কবির হাসান পারভেজ বলেন, অতিরিক্ত মোবাইল গেমসের আসক্তির ফলে শিশু-কিশোরদের খাবার-দাবারে অনীহা এসে যায়। ঘুম কম হয়। ফলে দিন দিনই তার ওজন হ্রাস হওয়ার পাশাপাশি মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে। স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। এভাবে চলতে থাকার পর একটা সময়ে মানসিকভাবেও চরম বিপর্যস্ত হয়ে মাদকের দিকে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই শিশু-কিশোরদের মোবাইল গেমসের আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে খেলাধুলার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য অভিভাবকদের আহ্বান জানান এই চিকিৎসক।

নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি যেভাবে

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু নজরদারির প্রয়োজন। ৫ বছরের নিচের শিশুদের জন্য ডিভাইস ব্যবহার সীমিত করা উচিত ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে। স্কুলগামী বাচ্চাদের জন্য দৈনিক সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টার সীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর অভিভাবকীয় নিয়ন্ত্রণ সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই ডিভাইসের বিভিন্ন ফিচার সীমিত করা যায়। অনুপযুক্ত ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশন ব্লক করা, প্রতিদিন কতক্ষণ ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে, তা নির্ধারণ এবং শুধু নির্দিষ্ট শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত