যে গ্রামে সব আছে

ইমাম হাসান মুক্তি, লালপুর (নাটোর)
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২১, ০৮: ৩০

নীল চাষ হতো বহু আগে থেকেই। ভারতে চাষ করা সে নীল রপ্তানি করা হতো ইউরোপে। লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করলে জমিদারেরা জমির ওপর নিরঙ্কুশ মালিকানার অধিকারী হন।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লাভজনক পণ্যের তালিকায় নীল চাষ শুরু করে। ১৮৭১ সালে বাংলাদেশের মেদিনীপুর জমিদার (এম জেড কোম্পানি) পদ্মা নদীর তীরবর্তী লালপুর ও বিলমাড়িয়ায় নীলকুঠি স্থাপন করে প্রজাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে নীল চাষে বাধ্য করতে শুরু করেন।

নীলকুঠি স্থাপনের ফলে বিলমাড়িয়ার দুটি ফুটবল মাঠে প্রতিযোগিতার আয়োজন, গান ঘরে ১৫ দিন ধরে বৈশাখী মেলা ও যাত্রাপালা, অগ্রহায়ণে সপ্তাহজুড়ে পালাগান, নিয়মিত লাঠিখেলার আয়োজন হতো। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর ইংরেজরা এই কুঠি ত্যাগ করে।

নাটোরের লালপুরের বিলমাড়িয়ার মোহরকয়া গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছিল নীলকুঠির মূল স্থাপনা। সেই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির আদর্শ গ্রাম মোহরকয়ায় গড়ে ওঠে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।

মোহরকয়া গ্রামের ২৩টি পাড়ার লোকসংখ্যা ১১ হাজার ৮১০ জন। এই গ্রামে বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন অবস্থিত। ১৯২৯ সালে মোহরকয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে বাথানবাড়ি ও পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিলমাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়, মোহরকয়া ডিগ্রি পাস ও অনার্স কলেজ, মোহরকয়া উচ্চবিদ্যালয়, মোহরকয়া নতুনপাড়া ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট এবং উপজেলার একমাত্র ছায়া প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মোহরকয়া দাখিল মাদ্রাসা, বিলমাড়িয়া দাখিল মাদ্রাসা, মোহরকয়া আজিজিয়া দারুল উলুম কওমি মাদ্রাসা, দারুল আমান হাফিজিয়া মাদ্রাসা, মোহরকয়া হজরত হালিমাতুস সাদিয়া (রা.) বালিকা মাদ্রাসা এই গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মোহরকয়া গ্রামে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্বপাড়া জামে মসজিদ। এ ছাড়া কেন্দ্রীয়, পশ্চিমপাড়া, মধ্যপাড়া, খাঁপাড়া, নতুনপাড়া, বায়তুল মামুর, ডিগ্রি কলেজ, কয়লারডহর জান্নাতুল মাওয়া, বায়তুল মোকাররম, পশ্চিমপাড়া জান্নাতুল মাওয়া এবং দারুল কারার হজরত আয়েশা (রা.) মহিলা জামে মসজিদ রয়েছে। মোহরকয়া হিন্দুপাড়া কালীমন্দির রয়েছে।

মোহরকয়া কেন্দ্রীয় ঈদগাহ, মধ্যপাড়া, খাঁপাড়া, পূর্বপাড়া, কয়লারডহর, পশ্চিমপাড়া, জান্নাতুল ফেরদাউস ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদের জামাত হয়ে থাকে।

সামাজিক প্রতিষ্ঠান মোহরকয়া তরুণ সংঘ, মোহরকয়া পাবলিক লাইব্রেরি, মোহরকয়া-মোমিনপুর পাবলিক লাইব্রেরি, দারুল খুলদ পাবলিক লাইব্রেরি, মোহরকয়া ফোকলোর চর্চাকেন্দ্র ও মোহরকয়া ভিলেজ ফাউন্ডেশন মানব উন্নয়নে কাজ করছে। স্বাস্থ্যসেবায় মোহরকয়া কমিউনিটি ক্লিনিক মানুষের সেবা দিচ্ছে। পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রত্যাশা বহুমুখী সমবায় সমিতি ও যুব উন্নয়ন সমিতি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

এই গ্রামের ৯০ ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। প্রায় ৯৫ ভাগ শিক্ষিত।

মোহরকয়া ভিলেজ ফাউন্ডেশন ও ফোকলোর চর্চাকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অধ্যক্ষ ড. মো. ইসমত হোসেন বলেন, ‘এই গ্রামের যাত্রাপালা দল, মাদারের গান, শব্দপালা দল, লাঠিখেলা দল, ঢুলিদল আমাদের লোকসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই গ্রামের ১০ কিলোমিটার রাস্তায় ১০ হাজার গাছ লাগিয়ে সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে। এই গ্রামের প্রধান অর্থকরী ফসল আখ। আখের গুড়, খেজুরের গুড়, খয়ের তৈরি এই গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য।

কামার ও জেলে পেশায় রয়েছেন অনেকে।’

এ গ্রামে সব আছে। আরও ভালো কিছু করার চেষ্টাও চলছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত