সরকারি ঘর ও জমি পেয়ে জীবন বদলে যাচ্ছে তাঁদের

সৌগত বসু, লালমনিরহাট থেকে
প্রকাশ : ১০ জুন ২০২৪, ২৩: ২০
আপডেট : ১১ জুন ২০২৪, ০১: ৩২

দিনে এখন ১০০ থেকে ১২০ কাপ চা বিক্রি করেন মো. বাহার আলী। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের সব দল কুঠিরপাড়া গ্রামের বাহার আলী এর আগে রিকশা চালাতেন। শহুরে ব্যস্ততা না থাকা, আর অসুস্থতার কারণে রিকশা চালিয়ে আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের আশা ছিল না তাঁর। তবে তিন বছর আগে থেকে জীবনের পরিবর্তন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ঘর পেয়েছেন তিনি। সেখানে খুলেছেন ছোট টং দোকান। আর তাতেই সংসারের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। 

লালমনিরহাটে বাহার আলীর মতো প্রায় ২০০ গৃহহীন পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। কিছুদিন আগেও যারা পরের জমিতে বাস করতেন, তাঁরা এখন নিজের ঘর, ছোট ফসলের খেত, সেলাই মেশিনে আয়ের চাকা ঘুরিয়েছেন। আজ সোমবার এই জেলার চারটি প্রকল্প ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। 

আগামীকাল মঙ্গলবার লালমনিরহাটের জেলার চার উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর হবে মোট ১ হাজার ২৮২টি। এর মধ্যে রয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলায় ৮৭৫ টি, পাটগ্রাম ৯৯টি হাতীবান্ধা ১৬৬টি ও আদিতমারী ১৪২। সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন। লালমনিরহাটের সঙ্গে আরও উদ্বোধন হবে ভোলা ও কক্সবাজারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। 

বাহার আলীর স্ত্রী মমতাজ বেগম বলেন, এখন দোকান থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়। সংসারের সঙ্গে ছেলের পড়াশোনার খরচও চালাতে পারছেন তাঁরা। দোকানে চা, বিস্কুট, চিপস, কোমলপানীয় বিক্রি হয়। 

তবে বাহার আলী স্বাবলম্বী হলেও অনেকের অভিযোগও রয়েছে। ঘর পেলেও কাজ পাচ্ছেন না তাঁরা। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, গৃহহীনদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য তাঁরা সব ভাবেই চেষ্টা করছেন। কিন্তু অনেকেই সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ না নিয়েই সুবিধা নিতে চাচ্ছেন। 

বাহার আলী যে আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকেন সেখানে নারীদের অভিযোগ, তাঁরা সেলাই মেশিন পাননি। এমন দুজন নারী আমেনা ও সামিনা খাতুন। 

রোববারের বৃষ্টিতে পানি জমে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে। ছবি: আজকের পত্রিকাআমেনা ও সামিনা আজকের পত্রিকাকে বলেন, এর আগে সারা দিন মানুষের কাছে হাত পেতে যা পেতেন তাতেই কোনোরকমে পেট চলত। তবুও একবেলা কম-বেশি কিংবা ভালো-মন্দ খাবারে জুটত। সারা দিন যেমন-তেমন কাটলেও রাত হতেই ভর করত নতুন দুশ্চিন্তা। কখনো রেলস্টেশন, কখনো মানুষের বাড়ির বারান্দা আবার কখনো রাস্তায় কেটেছে দিনরাত্রি। 

এখন তাঁরা ঘর পেয়েছেন। কিন্তু পেটে দায় মেটেনি। এই প্রকল্পে ৬৫টি পরিবার থাকলেও আমেনা–সামিনার মতো কিছু পরিবার স্বাবলম্বী হতে পারছে না। 

আমেনা খাতুন বলেন, তাঁরা দুই বোন সেলাই মেশিন পাননি। সেলাই মেশিন পেলে একটু আয় করা যেত। 

এ বিষয়ে আদিতমারী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, তাঁরা এসব মানুষকে স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন। তবে অনেকেই সেলাই মেশিন কার্যক্রমে প্রশিক্ষণ নিতে চান না। এ জন্য হয়তো তাঁরা সেলাই মেশিন পাননি। 

এদিকে এই উপজেলার সাপ্টিবাড়ি ইউনিয়নে ৩৪টি পরিবার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছে। তবে সেখানে এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। গতকাল রোববার রাতের বৃষ্টিতে পানি জমেছে প্রকল্প এলাকায়। 

এ বিষয়ে ইউএনও বলেন, খুব শিগগিরই এসব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। পানি যাতে না জমে এর জন্য মাটি ফেলা হলেও ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়নি। এটাও করা হবে শিগগির। 

আশ্রয়ণ ঘর পেয়ে অনেকেই সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন। ছবি: আজকের পত্রিকাকিছু পরিবারের স্বাবলম্বী না হওয়ার চিত্র দেখা গেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িয়াতেও। ছিটমহল হিসেবে পরিচিত দশিয়ারছড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনেকে কাজ খুঁজে পেয়েছে। অনেকে এখনো কিছুই করতে পারছেন না। বাড়ির পুরুষদের শহরে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করতে হচ্ছে। 

এই প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন মর্জিনা বেগম। তিনি বলেন, তাঁর দুই ছেলে ও স্বামী ঢাকায় রিকশা চালান। তবে স্বামীর হাঁপানির সমস্যা। এই বয়সে যদি এখানে একটা কিছু করা যেত তাহলে আরও ভালো হতো। 

মর্জিনা বলেন, ঘর পেয়ে অনেক খুশি। তবে আগের মতই বাড়ির সব পুরুষ বাড়ি থাকতে পারছে না। 

লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা ইউনিয়নে ৬৫টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়েছেন গৃহহীনেরা। এর আগে পাশেই রেলের জমিতে উদ্বাস্তুর মতো থাকতেন তাঁরা। এখন নিজের ঘর পেয়ে শুরু করেছেন চাষাবাদ। তিস্তা নদীর সঙ্গে গড়ে ওঠা এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে শাকসবজি ও বাদাম চাষ এবং গরু–ছাগল পালন করে আয় বাড়িয়েছেন তাঁরা। 

তবে অভিযোগ আছে, এখানে ঘর পেলেও ২৫টি পরিবার এখনো থাকে রেলের জমিতে গড়ে তোলা আগের ঘরে। রাতে চৌকিদার এলে কেউ কেউ বাড়ি ফেরেন। 

এ বিষয়ে ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের সেক্রেটারি মো. রছু মিয়া বলেন, কয়েকটি পরিবার এখনো আগের জায়গাতেই আছে। এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। এটার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এদিকে সারা দেশে আরও ১৮ হাজার ৫৬৬টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে দেশের আরও ৭০টি উপজেলা সম্পূর্ণ গৃহহীন মুক্ত হবে। আগামীকাল মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে এই ঘর এবং দুই শতাংশ করে জমির দলিল হস্তান্তর করবেন তিনি।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত