রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়: ৭৪ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে নয়ছয়

  • নকশা বদলে এক ভবনের জায়গায় তিনটি।
  • দুই বছরের কাজ শেষ হয়নি ছয় বছরেও।
  • দরপত্রসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়মের ছড়াছড়ি।
সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকা 
Thumbnail image
ছবি: সংগৃহীত

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে নেওয়া ‘বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প’ অনিয়মের কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে। প্রকল্প পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব অ্যান্ড কোংসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কাজ অসম্পূর্ণ রেখে প্রায় ৭৪ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় মোট তিনটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্প তিনটি হচ্ছে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল, ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও স্বাধীনতা স্মারক। এ জন্য মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৭৪ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৯ টাকা। ২০১৬-১৭ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পগুলোর কাজ ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৬ বছর পর এখনো তা শেষ হয়নি।

তিনটি প্রকল্পেই ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রস্তাবে ৪৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৮০৬ টাকা ব্যয়ে ৯ হাজার বর্গমিটার আয়তনের দশতলা শেখ হাসিনা ছাত্রী হল নির্মাণের কথা। ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সাড়ে ১৭ হাজার বর্গমিটার আয়তনের দশতলা ভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ২৫ কোটি ২৭ লাখ ৬২ হাজার ৯৫৩ টাকা। স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণের অনুমোদিত ব্যয় ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। প্রকল্পের সূত্র বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন শর্তের গুরুতর ব্যত্যয় ঘটেছে। অননুমোদিতভাবে নকশার পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে।

ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউট প্রকল্পে একটি দশতলা ভবন তৈরির কথা থাকলেও অনুমোদন ছাড়াই তিনটি পৃথক ভবনের আংশিক কাজ করা হয়।

এর একটি পাঁচতলা ও অন্য দুটি দোতলা। এই তিনটি ভবনের শুধু পিলারসহ বাইরের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের একটি দশতলা ভবনের জায়গায় এ পর্যন্ত শুধু ভিতের ওপর পাঁচতলা পর্যন্ত পিলারের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এই ‘বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের’ তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম অননুমোদিত অতিরিক্ত কাজ বাস্তবায়ন করান। তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাজ সম্পন্ন না করেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের পুরো টাকা তুলে নেন।

দরপত্রে দ্বিগুণ মূল্য

দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, প্রকল্পের কাজ শুরুর দিকে গণপূর্ত বিভাগের রেট অনুসারে ম্যাট ফাউন্ডেশনের কংক্রিটের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ১০ হাজার ৯৭০ টাকা থাকলেও তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা দরে চুক্তি করা হয়েছে। দুটি ভবনের প্যাকেজেই অস্বাভাবিক হারে মূল্য দাখিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) ২০০৮-এর বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উভয় ভবনের চুক্তিমূল্যে টাইলস, মোজাইক ইত্যাদিতে অস্বাভাবিক কম মূল্য (২ টাকা) এবং ভবনের কংক্রিট ও ম্যাট ফাউন্ডেশনের কংক্রিটের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক হারে উচ্চমূল্য ধরা হয়েছে। ডিপিপিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও দুটি বিভাগের আসবাবপত্র কেনার জন্য ১টি উন্মুক্ত টেন্ডার (ওটিএম) পদ্ধতির পরিবর্তে তিনটি পৃথক আরএফকিউ পদ্ধতির (রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন) টেন্ডারের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৫ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

দরপত্র প্রভাবিত করার অভিযোগ

দুদক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা ছাত্রী হল ও ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট উভয় প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াতেই তুলনামূলক বিবরণীতে কথিত গাণিতিক ভুল দেখিয়ে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা পরিবর্তন করা হয়েছে। পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ১১ অনুযায়ী, এমন গাণিতিক ভুল ধরা পড়লে তা সংশোধন করে দ্রুত সংশ্লিষ্ট দরদাতাদের লিখিতভাবে জানাতে হবে। এ নিয়ম মানা হয়নি।

চুক্তির ঊর্ধ্বসীমা উপেক্ষা ও অনিয়ম

আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আইন ২০১৫-এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী, ৩০ কোটি টাকার ওপরের অর্থমূল্যের চুক্তি করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন-সংক্রান্ত কোনো নথি পাওয়া যায়নি বলে দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন প্রকল্প পরিচালক এ কে এম নূর-উন-নবীই। ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়সাপেক্ষ স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণকাজের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) এবং পিএসসির অনুমোদন ছাড়াই অসম্পূর্ণ দরপত্র (আংশিক কাজ) আহ্বান করে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তিন কিস্তিতে ক্যাশ চেকের মাধ্যমে মোট ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকার বিল দেওয়া হয়। উপস্থাপিত নথিপত্রে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের অনুমোদনের কোনো প্রমাণ নেই। এ বিষয়টিকে দুর্নীতি বলেছে দুদক।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

দুর্নীতি-অনিয়মের এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। বিষয়টি যেহেতু দুদক দেখছে, আমরা তাদের অনুসন্ধানকে সহায়তা করছি। অনেক ক্ষেত্রে নিয়মনীতির চরম লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রকল্পটি ৯৭ কোটি টাকার। একে সংশোধন করে ১৭৮ কোটি টাকা করার একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা মন্ত্রণালয় আটকে দেয়। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে নিয়ম ভেঙে কাজের চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার কাজই সম্পন্ন করেননি।’

এই অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব অ্যান্ড কোং-এর আব্দুস সালামকে বারবার ফোন করা হলেও তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে।

সাবেক উপাচার্য এ কে এম নূর-উন-নবী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কাজে কোনো অনিয়ম বা ব্যত্যয় ঘটেনি। এ বিষয়ে তদন্ত হয়েছে, তদন্ত রিপোর্ট আছে।’

প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) নুজহাত ইয়াসমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। দুদকের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নজরদারি সংস্থা ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কেনাকাটায় দুর্নীতি একটা সাধারণ বিষয় হয়ে গেছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত তাঁদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায় না বলেই সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি ক্রমেই বাড়ছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে: সলিমুল্লাহ খান

সংস্কারের কিছু প্রস্তাবে মনঃক্ষুণ্ন বিএনপি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত