১২ গ্রামে বঞ্চনার কান্না

আনিসুল হক জুয়েল, দিনাজপুর
প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১: ৪৭
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩: ০০
ফাইল ছবি

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির আশপাশের ১২ গ্রামের মানুষ ক্ষতিপূরণসহ ৬ দফা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ দাবি পূরণে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে গত ৬ নভেম্বর আবারও আন্দোলনের ডাক দেন তাঁরা। তাঁদের এ ঘোষণার পর ৫ নভেম্বর খনি কর্তৃপক্ষ আলোচনা সাপেক্ষে সমস্যা সমাধানে ৪৫ দিন সময় চায়। খনি কর্তৃপক্ষের দাবি, সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলো খনি এলাকার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ টিমের সহযোগিতা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার রাশেদ কামাল জানান, ভূগর্ভ থেকে কয়লা উত্তোলনের কারণে সম্প্রতি খনিসংলগ্ন প্রভাবিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ৮টি গ্রামের জনগণকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু ২০১৭ সালে জরিপের ফলে সাময়িক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে, সে কারণে বর্তমানে এই ১২ গ্রামের জনগণ আবার ক্ষতিপূরণ দাবি করে আন্দোলন করছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে খনি কর্তৃপক্ষ কয়লা উত্তোলনের কারণে ওই ১২ গ্রামের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) প্রতিনিধি ও বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কারিগরি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণের জন্য অন্যান্য বিশেষজ্ঞ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান রাশেদ কামাল।

কয়লাখনির পাশের বৈগ্রাম, মোবারকপুর, রসুলপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, অনেকের বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে। কারও-বা ইটের ঘর আশঙ্কাজনকভাবে ফেটে গেছে। বাড়িঘরের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাড়ির টিউবওয়েলেও মিলছে না পানি। ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তাঁরা। বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় তাঁরা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেন না। খনিতে মাইন বিস্ফোরণে মাটিতে কম্পন শুরু হলে রাতবিরাতে ঘর থেকে পরিবার-পরিজনসহ দৌড়ে বের হতে হয়। ৬-৭ বছর আগে একবার খনি কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিলেও তার পর থেকে আর দেওয়া হয়নি। তাই দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছেন তাঁরা।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সংগঠন ‘বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি আদায় বাস্তবায়ন কমিটির’ উদ্যোগে ৬ দফা দাবি জানানো হয়েছে। সেগুলো হলো খনি কর্তৃপক্ষের সমঝোতা চুক্তি মোতাবেক ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার থেকে স্থায়ী চাকরি দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ভূমিহীনদের মাইনিং সিটি অথবা উন্নতমানের বাসস্থান তৈরি করা, এককালীন ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও রাস্তা পুনর্নির্মাণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জমি থেকে উত্তোলিত কয়লার শতকরা ৫ শতাংশ হারে উৎপাদন বোনাস।

এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা এবং ভূতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ দলকে গত ১৭ নভেম্বর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তারিখ নির্ধারিত না হলেও শিগগিরই তাঁদের আসার জন্য যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। তাঁরা তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন দিলে, সে অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে খনি সূত্র।

খনিতে ক্ষতিগ্রস্ত বড়পুকুরিয়ার অধিগ্রহণ করা জিগাগাড়ি গ্রামের সাবেক বাসিন্দা ও বর্তমানে জায়গা কিনে মোবারকপুর গ্রামে বসবাসরত গোলজার হোসেনের স্ত্রী মোসলেমা বেগম বলেন, ‘সামান্য যে জায়গাজমি ছিল, তা খনি অধিগ্রহণ করছে। স্বামীরা পাঁচ ভাই। ভাগে যে সামান্য টাকা পাইছি, তা দিয়া জায়গা কিনি বাড়ি করইতেই শেষ। ১২ বছর হয় এখানে বাড়ি করছি; কিন্তু সমস্যা মেটে নাই। বোম ফাটলে (খনিতে বিস্ফোরণ হলে) চমকি উঠি ঘর থাকি বাইর হইবার নাগে। শান্তিতে ঘুমাইতে পারি না। বাড়িও ফের ফাটি গেইছে। টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। বহু সমস্যা নিয়া দিন পার করছি।’

হামিদপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও মোবারকপুর গ্রামের আব্দুল খালেক বলেন, ‘মাটির নিচে যখন বোম ফুটে তখন আমাদের এখানে মাটিগুলা কাঁপে। মনে হয় যে, ভূমিকম্প মনে হয় আইসলো। অনেক বাড়িঘর ফাটি গেছে। আমার বাড়ির দরজাটা পড়ে গেছে। মসজিদের দেয়াল ফাটি গেছে।’

বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি আদায় বাস্তবায়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি। খনি কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েকবার লিখিতভাবে জানিয়েছি। একটা তদন্ত কমিটি হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আমরা তা মেনে নেব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত