বিলীনপ্রায় নদীতে শতকোটির সেচ প্রকল্প

মাসুদ পারভেজ রুবেল  ডিমলা (নীলফামারী) 
Thumbnail image
উৎসমুখে ভারতের বাঁধের কারণে তিস্তার শাখা বুড়িতিস্তা শুকিয়ে গেছে। তবে এই নদীকে জলাধার দেখিয়ে পাউবো হাতে নিয়েছে সেচ প্রকল্প। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে চলছে চাষাবাদ। সম্প্রতি নীলফামারীর ডিমলায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তরের তিস্তার শাখা বুড়িতিস্তা। তবে ভারতের বাঁধের কারণে এই শাখা নদীতে পানি নেই অন্তত ৩০ বছর। এরপরও সেখানে সেচ প্রকল্পের নামে খননের কাজ হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার পাঁচটি গ্রামে নেওয়া এ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণও হয়নি ঠিকঠাক। ফলে কাজে বাধা দেওয়ায় ৭০০ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে করা হয়েছে হয়রানির মামলা।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সেচ প্রকল্পের নামে পাউবোর কর্মকর্তারা ও সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার সেখান থেকে বালুর ব্যবসা করছেন। শতকোটি টাকার এই প্রকল্পে কোনো কাজেই আসবে না। উৎসে বাঁধ থাকায় খাল খনন করলেও বুড়িতিস্তায় পানি আসার সুযোগই নেই। পাউবো সূত্র, কৃষিকাজে সেচ সুবিধার্থে তিস্তা সেচ প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর আওতায় ১ হাজার ২১৭ একর জমিতে জলাধার খনন করার কথা। প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি প্যাকেজে ৬৬৭ একর খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৯৯ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাউবো ডিমলার রামডাঙ্গা এলাকায় জলাধার খননের কাজ শুরু করেছিল। তখন জমির মালিকেরা খাল খননের সঠিক কার্য নীতিমালা ও অনুমোদিত নকশার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন। পরে খননকাজ স্থগিত করা হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে খনন শেষ হওয়ার কথা। তবে কাজ না হওয়ায় দুই বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।

খাল খননের প্রকল্পটি বেশ পুরোনো। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৮ সালের প্রকল্পের আওতায় পাঁচটি গ্রামের প্রায় ১ হাজার ৩০০ একর জমিতে জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এলাকাবাসীর দাবি, সরকার শুধু ১০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকার আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ওই জমির প্রকৃত মালিকেরা চাষাবাদ করে আসছেন। এসব জমি বেচাকেনাও হয়েছে। নতুন খননের নামে চার ফসলি জমি নষ্ট হবে। এতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন বন্ধ হবে।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল হাসান বলেন, জলাধার প্রকল্পটি জনগণের কোনো কল্যাণে আসবে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বাস্তবতা না থাকায় ২০১০ সালে পাউবো সেখানে একটি বেসরকারি কোম্পানিকে লিজ দিয়েছিল অ্যাগ্রো প্রজেক্ট বা পর্যটনকেন্দ্র করার জন্য। পরে গ্রামবাসী মামলা করলে আদালত তাও বাতিল করে। তাহলে এখন কার স্বার্থে আবাদি জমিতে এই জলাধার খনন করা হচ্ছে?

সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর রামডাঙ্গা এলাকায় প্রায় ৪০ একর কৃষিজমি খনন হয়েছে। তবে সেখানে নেই খননের বালু। পাউবোর খাতায় বালুর কোনো হিসাবও নেই। স্থানীয়রা জানান, খননের নামে দিনরাত শতাধিক ট্রাক্টরে ভরে বালু বিক্রি করেছেন ঠিকাদার ও সাবেক এমপি আফতাব উদ্দিনের লোকজন। প্রতি ট্রাক্টর বালু ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

কুটিরডাঙ্গা-গোলনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একসময় গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িতিস্তা নদী এখন পানিশূন্য। এতে চাষাবাদ চলছে। জলাধার খননের নির্ধারিত এলাকা পুরোটাই কৃষিজমি ও জনবসতি। সেখানে পাঁচ শতাধিক কাঁচাপাকা বাড়ি, দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মসজিদ ও মাদ্রাসা রয়েছে। সেখানে কথা হয় কুটিরডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল আলিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিস্তা নদীর শাখা ছিল বুড়িতিস্তা। তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হলে এটি মরা নদীতে পরিণত হয়। এর উৎসমুখেও বাঁধ দিয়েছে ভারত সরকার। পানির প্রবাহ বন্ধ। ফলে সেচের স্বার্থে জলাধার খনন হচ্ছে, এটা একটা অবাস্তব কথা।

গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা

এই জলাধার খননের প্রতিবাদে মানববন্ধনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকাবাসী। তাঁদের দাবি, সরকার যদি একান্তই নদী খনন করতে চায়, তাহলে করতে পারে। তবে সেটা করতে হবে খাসজমিতে। এই সংকট সমাধানে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বালু ব্যবসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় এবং খননে বাধা দেওয়া পাউবো ৭০০ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে ১০ থেকে ১২টি মামলা করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ‘কতবার অভিযোগ দিয়েছি, কেউ শোনে না আমাদের কথা। এলাকার জয়নাল আবেদীনসহ চারজন আদালতে মামলাও করেছেন। তাঁদের দাবি, এখন যেখানে জলাধার খনন শুরু হয়েছে, সেখানে বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানার জমি।’

আর জয়নাল আবেদীন বলেন, তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ভেতরে খাল টেনে আনা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে তাঁরা মামলা করেছেন। কিন্তু পাউবো মামলা-হামলা করে বাসিন্দাদের গ্রামছাড়া করতে চাইছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারী পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বলেন, পাউবোর অধিগ্রহণ করা জমিতে জলাধার খনন করা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয়দের বাধায় কাজ বন্ধ। যারা বাঁধা দিয়েছে, তাদের নামে ১০টির মতো মামলা করা হয়েছে।

জমি অধিগ্রহণের কাগজপত্র আছে কি না, এ বিষয়ে আতিকুর রহমান বলেন, ‘আদালতে মামলা চলমান, তাই নরমালি কাগজপত্র ওপেন করতে চাচ্ছি না।’ তবে বালু ব্যবসার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। পানির উৎস কী, কার স্বার্থে ফসলি জমিতে জলাধার খনন—এমন প্রশ্নের সদুত্তর দেননি তিনি। তাঁর দাবি, খনন হলে জলাধারে পানি থাকবে, সেখান থেকে কৃষকেরা উপকৃত হবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত