কাজী রতনপুরী
প্রথমে একটা ঘটনা বলে নিই। বাংলাদেশের ব্যাংকঋণের বর্তমান সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গেলেই এ ঘটনার কথা মনে আসে। এক যুবক ড্রাইভিং লাইসেন্স নেবে। একটা ভালো ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হয়ে কয়েক মাস খুব নিষ্ঠার সঙ্গে শিখে, ভালোভাবে প্র্যাকটিস করে সে আবেদন করল। যথাসময়ে এবং নিয়ম মেনে সে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু পরীক্ষায় সে ফেল করে। সুতরাং সে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসে এবং আবারও ফেল করে। এ রকম কয়েকবার ফেল করার পর সে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। অথচ সে দেখতে পায়, তার বন্ধুরা খুব সহজে লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে কম জেনেও ওদের পরীক্ষা পাস করতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। শেষমেশ ছেলেটি তার এক বন্ধুর পরামর্শ নিয়ে দালালের শরণাপন্ন হয়। দালালের সহায়তায় সে কোনোমতে পরীক্ষায় অংশ নিয়েই পাস করে। আমরা একটু পরেই এ দেশের ব্যাংকিং সংস্কৃতির সঙ্গে এ ঘটনার সাযুজ্য দেখতে পাব।
চরিত্র নষ্টের গোড়ার কথা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সংস্কৃতি আসলে ‘টাকা মেরে দেওয়ার’ সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির গোড়ায় আছে অপশাসন। দেশে যখন প্রথম সামরিক শাসন জুড়ে বসল, তখন শাসকের জন্য একটা সমর্থকগোষ্ঠীর প্রয়োজন পড়ল। শাসক তখন লোভের সংস্কৃতিকে কাজে লাগালেন। এর হাতিয়ার হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয়করণ করা ব্যাংকগুলো। জানিয়ে দেওয়া হলো, স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানের সুপারিশ থাকলেই পাওয়া যাবে ব্যাংকঋণ। আর্থিক মাপকাঠিতে নয়, স্থানীয় টাউট-বাটপারদের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে ব্যাংক খাতের টাকা চলে গেল তাদের মনোনীত মানুষের হাতে হাতে। বলা বাহুল্য, জনপ্রতিনিধিও নন, তাঁদের চেলাচামুণ্ডারাই ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচন করল এবং সমর্থক একটা চরিত্রহীন গোষ্ঠী তৈরি করল। তারাই প্রথম শেখাল, ব্যাংকের টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া যায়; তাই ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশে সামরিক শাসন প্রলম্বিত হলো; নাম বদল করে সামরিক স্বৈরাচার দশ বছর ধরে এই ‘টাকা মেরে দেওয়ার সংস্কৃতি’র বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটাল। কেবল গরিব কৃষকের দল নয়, সমাজের সম্ভ্রান্ত এবং নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হলো ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে।
নীতি ছাড়, বেড়ায় যদি ঘাস খায়
অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে দেশে গণতন্ত্র এল। কিন্তু সামরিকতন্ত্র যে ধনিক, লোভী শ্রেণি তৈরি করে দিয়ে গেল, নয়া গণতন্ত্র তাদেরই কথায় চলতে শুরু করল। যারা ব্যাংকের ‘টাকা মেরে’ দিয়ে বড়লোক হয়েছে, তারাই নীতিনির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে লাগল। তারা একেকজন দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে নীতি ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করল। ফলে বারবার নীতি-সুবিধা, আইনি সুবিধা এসে যোগ হলো ঋণখেলাপিদের অনুকূলে। একদিকে টাকা মেরে দেওয়া খেলাপিদের বারবার ছাড় দিয়ে নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো আমানতকারীদের অর্থ ব্যবহার করে; অন্যদিকে সৎ ব্যবসায়ীদের সুদের বোঝা বাড়ানো হলো এসব লুটেরার কাছ থেকে অনাদায়ি হিসাব অবলোপনের নামে শ্রাদ্ধ করতে। আস্থা এখন এমন, কোনো ছোটখাটো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ব্যাংকের মামলায় কিছু টাকা আদায় করা হয়তো সম্ভব; কারণ, তারা প্রভাব খাটাতে পারে না। কিন্তু বড় খেলাপিরা গোষ্ঠীসুদ্ধ আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে আসে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা একটা বিষয়, কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয়—তারা জানে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা সরকার তাদের জন্য কোনো না কোনো ছাড়ের ব্যবস্থা করবেই।
বাংলাদেশ এক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ। ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের জন্য এই সংস্থার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, ছয়টি সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে দুই বছরের মধ্যে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ব্যাপকভাবে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, নতুন করে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি প্রতিরোধ করতে হবে। এই কাজ কঠিন। সহজ কাজ হলো খেলাপির ধারণা পাল্টে দেওয়া। কঠিনেরে ভালোবাসা কেবল কবির দায়িত্ব। তাই আর্থিক খাতের কর্তারা খেলাপিদের জন্য সুবিধার ডালি সাজিয়ে বসেছেন। ২০২০, ২০২১ সালে কোভিড-১৯ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আড়াল করতে ঢালাও ছাড় দেওয়ার পর ২০২২ পেরিয়ে ২০২৩-এর অর্ধেক বছর অতিক্রম করলেও ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদ আদায় না করেও কাগুজে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ এবং বিশেষ সুবিধার ঋণে আরোপিত সুদও আয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ অব্যাহত আছে। খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য নীতিছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার উদারতার পরিচয় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের স্থিতির ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ ব্যাংকে জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ ২০২৩ শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য, এই চিত্র কেবল আংশিক। বর্তমান ব্যাংকিং কাঠামোয় এই হিসাব কষতে গেলে মনে পড়বে একটা ইংরেজি প্রবাদ, can’t see the forest for the trees—যার বাংলা করতে পারি, গাছের ভিড়ে জঙ্গল খুঁজে পাই না। তবু আইএমএফের এক হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে থাকা ঋণ, পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ বিবেচনায় নিলে আইএমএফের দেওয়া পরিসংখ্যান মেনে নিতে হয়। তবে ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, পরতে পরতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার সুযোগ আছে এবং এর চর্চা সর্বজনীন।
খেলাপি ঋণের প্রবণতা বৃদ্ধিতে নীতিসহায়তার কথা খুব গুছিয়ে বলেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই একজন সাবেক গভর্নর। ২০২৩ সালের ২৯ মে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সমস্যাটা হলো, কিছু ভুল নীতি এবং সেটা ঠিক না করেই ব্যবস্থা নেওয়া। এটা আসলে লিগেসি প্রবলেম—আপনি কিছুদিন পরপর ঋণখেলাপিদের ছাড় দিচ্ছেন। এটা আসলে তাদের একটা ব্যাড সিগন্যাল দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশ এভাবে দিনের পর দিন ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয় না।’
বিবিসির সঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘যারা বড় বড় অঙ্কের খেলাপি হয়েছে, তাদের কখনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি। যেসব ব্যাংক এর সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ভয় থাকে না।’
মালিকদের ঋণ ও প্রবণতা
২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকেরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা সে সময় মোট ব্যাংকঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। এই পরিচালকেরাই একে অন্যের ঋণপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে পুনঃ তফসিল করাসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অর্থনৈতিক বিবেচনাকে পাশ কাটিয়ে একসময় কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যাংকের পরিচালকের পদ বাগিয়ে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত সুবিধা নেওয়ার হিড়িক। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক, যাঁরা সততার সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবসা করতে চেয়েছেন, তাঁরাও দেখলেন, এর চেয়ে ঢের ভালো ধান্দাবাজি করা। এখন তো ব্যাংকমালিকেরা হোটেলে বসে আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারছেন। আইএমএফের চাপে অতি সম্প্রতি পরিবর্তিত হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১। মালিকদের পক্ষে এখন একাধারে ১২ বছর পরিচালকের আসনে বসে থাকা সম্ভব; এই বিধান কেমন করে সংযোজিত হয়েছে, তার ফিরিস্তি মিডিয়ায় আছে। এখানে আর উল্লেখ না-ই করলাম। হায় রে আইএমএফ, তুমি গাও কী আর তোমার সারিন্দা বাজায় কী? শুরুতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য দালাল ধরার ঘটনা বলেছিলাম। এবার মিলিয়ে নিন!
শেষ আশা তবে সুশাসনেই
ব্যাংক কোম্পানির সর্বশেষ সংশোধনীতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নামে একটা বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। তথাকথিত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাত্মক বা নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ডকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিবিশেষের জন্য থাকছে বিশেষ বিবেচনা। সুতরাং এই আইনের এই বিধান দীর্ঘসূত্রতা বাড়াবে, সুশাসনের পথকে নিদারুণভাবে ব্যাহত করবে। এতে অবশ্যই নতুন করে ঋণ খেলাপ সংস্কৃতির প্রসার ঘটবে।
তাহলে কি আশার দুয়ার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল? না। রাজনৈতিক সদিচ্ছার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। সুশাসনই পারে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে। চীন, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া করে দেখিয়েছে। আমরাও আশা করতে চাই।
লেখক: লেখক ও ব্যাংকার
প্রথমে একটা ঘটনা বলে নিই। বাংলাদেশের ব্যাংকঋণের বর্তমান সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গেলেই এ ঘটনার কথা মনে আসে। এক যুবক ড্রাইভিং লাইসেন্স নেবে। একটা ভালো ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হয়ে কয়েক মাস খুব নিষ্ঠার সঙ্গে শিখে, ভালোভাবে প্র্যাকটিস করে সে আবেদন করল। যথাসময়ে এবং নিয়ম মেনে সে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু পরীক্ষায় সে ফেল করে। সুতরাং সে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় বসে এবং আবারও ফেল করে। এ রকম কয়েকবার ফেল করার পর সে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। অথচ সে দেখতে পায়, তার বন্ধুরা খুব সহজে লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে কম জেনেও ওদের পরীক্ষা পাস করতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। শেষমেশ ছেলেটি তার এক বন্ধুর পরামর্শ নিয়ে দালালের শরণাপন্ন হয়। দালালের সহায়তায় সে কোনোমতে পরীক্ষায় অংশ নিয়েই পাস করে। আমরা একটু পরেই এ দেশের ব্যাংকিং সংস্কৃতির সঙ্গে এ ঘটনার সাযুজ্য দেখতে পাব।
চরিত্র নষ্টের গোড়ার কথা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সংস্কৃতি আসলে ‘টাকা মেরে দেওয়ার’ সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির গোড়ায় আছে অপশাসন। দেশে যখন প্রথম সামরিক শাসন জুড়ে বসল, তখন শাসকের জন্য একটা সমর্থকগোষ্ঠীর প্রয়োজন পড়ল। শাসক তখন লোভের সংস্কৃতিকে কাজে লাগালেন। এর হাতিয়ার হলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয়করণ করা ব্যাংকগুলো। জানিয়ে দেওয়া হলো, স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানের সুপারিশ থাকলেই পাওয়া যাবে ব্যাংকঋণ। আর্থিক মাপকাঠিতে নয়, স্থানীয় টাউট-বাটপারদের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে ব্যাংক খাতের টাকা চলে গেল তাদের মনোনীত মানুষের হাতে হাতে। বলা বাহুল্য, জনপ্রতিনিধিও নন, তাঁদের চেলাচামুণ্ডারাই ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচন করল এবং সমর্থক একটা চরিত্রহীন গোষ্ঠী তৈরি করল। তারাই প্রথম শেখাল, ব্যাংকের টাকা নিয়ে মেরে দেওয়া যায়; তাই ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেশে সামরিক শাসন প্রলম্বিত হলো; নাম বদল করে সামরিক স্বৈরাচার দশ বছর ধরে এই ‘টাকা মেরে দেওয়ার সংস্কৃতি’র বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটাল। কেবল গরিব কৃষকের দল নয়, সমাজের সম্ভ্রান্ত এবং নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হলো ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে।
নীতি ছাড়, বেড়ায় যদি ঘাস খায়
অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে দেশে গণতন্ত্র এল। কিন্তু সামরিকতন্ত্র যে ধনিক, লোভী শ্রেণি তৈরি করে দিয়ে গেল, নয়া গণতন্ত্র তাদেরই কথায় চলতে শুরু করল। যারা ব্যাংকের ‘টাকা মেরে’ দিয়ে বড়লোক হয়েছে, তারাই নীতিনির্ধারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে লাগল। তারা একেকজন দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে নীতি ও আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করল। ফলে বারবার নীতি-সুবিধা, আইনি সুবিধা এসে যোগ হলো ঋণখেলাপিদের অনুকূলে। একদিকে টাকা মেরে দেওয়া খেলাপিদের বারবার ছাড় দিয়ে নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো আমানতকারীদের অর্থ ব্যবহার করে; অন্যদিকে সৎ ব্যবসায়ীদের সুদের বোঝা বাড়ানো হলো এসব লুটেরার কাছ থেকে অনাদায়ি হিসাব অবলোপনের নামে শ্রাদ্ধ করতে। আস্থা এখন এমন, কোনো ছোটখাটো ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ব্যাংকের মামলায় কিছু টাকা আদায় করা হয়তো সম্ভব; কারণ, তারা প্রভাব খাটাতে পারে না। কিন্তু বড় খেলাপিরা গোষ্ঠীসুদ্ধ আদালতে গিয়ে জামিন নিয়ে আসে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা একটা বিষয়, কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয়—তারা জানে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা সরকার তাদের জন্য কোনো না কোনো ছাড়ের ব্যবস্থা করবেই।
বাংলাদেশ এক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ। ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের জন্য এই সংস্থার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, ছয়টি সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ থেকে দুই বছরের মধ্যে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ব্যাপকভাবে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে, নতুন করে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি প্রতিরোধ করতে হবে। এই কাজ কঠিন। সহজ কাজ হলো খেলাপির ধারণা পাল্টে দেওয়া। কঠিনেরে ভালোবাসা কেবল কবির দায়িত্ব। তাই আর্থিক খাতের কর্তারা খেলাপিদের জন্য সুবিধার ডালি সাজিয়ে বসেছেন। ২০২০, ২০২১ সালে কোভিড-১৯ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ আড়াল করতে ঢালাও ছাড় দেওয়ার পর ২০২২ পেরিয়ে ২০২৩-এর অর্ধেক বছর অতিক্রম করলেও ব্যাংকগুলোকে ঋণের সুদ আদায় না করেও কাগুজে মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ এবং বিশেষ সুবিধার ঋণে আরোপিত সুদও আয় হিসেবে দেখানোর সুযোগ অব্যাহত আছে। খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিলের জন্য নীতিছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার উদারতার পরিচয় দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের স্থিতির ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ ব্যাংকে জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত মার্চ ২০২৩ শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বলা বাহুল্য, এই চিত্র কেবল আংশিক। বর্তমান ব্যাংকিং কাঠামোয় এই হিসাব কষতে গেলে মনে পড়বে একটা ইংরেজি প্রবাদ, can’t see the forest for the trees—যার বাংলা করতে পারি, গাছের ভিড়ে জঙ্গল খুঁজে পাই না। তবু আইএমএফের এক হিসাবে এই পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। সন্দেহজনক ঋণ, আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে থাকা ঋণ, পুনঃ তফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ বিবেচনায় নিলে আইএমএফের দেওয়া পরিসংখ্যান মেনে নিতে হয়। তবে ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, পরতে পরতে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার সুযোগ আছে এবং এর চর্চা সর্বজনীন।
খেলাপি ঋণের প্রবণতা বৃদ্ধিতে নীতিসহায়তার কথা খুব গুছিয়ে বলেছেন খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেরই একজন সাবেক গভর্নর। ২০২৩ সালের ২৯ মে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সমস্যাটা হলো, কিছু ভুল নীতি এবং সেটা ঠিক না করেই ব্যবস্থা নেওয়া। এটা আসলে লিগেসি প্রবলেম—আপনি কিছুদিন পরপর ঋণখেলাপিদের ছাড় দিচ্ছেন। এটা আসলে তাদের একটা ব্যাড সিগন্যাল দিচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশ এভাবে দিনের পর দিন ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয় না।’
বিবিসির সঙ্গে আরেক সাক্ষাৎকারে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘যারা বড় বড় অঙ্কের খেলাপি হয়েছে, তাদের কখনো শাস্তি হয়েছে বলে আমি শুনিনি। যেসব ব্যাংক এর সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও বাংলাদেশ ব্যাংককে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ভয় থাকে না।’
মালিকদের ঋণ ও প্রবণতা
২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের ৫৫টি ব্যাংকের পরিচালকেরা একে অন্যের ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৭১ হাজার ৬১৬ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন, যা সে সময় মোট ব্যাংকঋণের ১১ দশমিক ২১ শতাংশ। এই পরিচালকেরাই একে অন্যের ঋণপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে পুনঃ তফসিল করাসহ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অর্থনৈতিক বিবেচনাকে পাশ কাটিয়ে একসময় কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া শুরু হয়। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে ব্যাংকের পরিচালকের পদ বাগিয়ে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত সুবিধা নেওয়ার হিড়িক। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালক, যাঁরা সততার সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবসা করতে চেয়েছেন, তাঁরাও দেখলেন, এর চেয়ে ঢের ভালো ধান্দাবাজি করা। এখন তো ব্যাংকমালিকেরা হোটেলে বসে আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারছেন। আইএমএফের চাপে অতি সম্প্রতি পরিবর্তিত হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১। মালিকদের পক্ষে এখন একাধারে ১২ বছর পরিচালকের আসনে বসে থাকা সম্ভব; এই বিধান কেমন করে সংযোজিত হয়েছে, তার ফিরিস্তি মিডিয়ায় আছে। এখানে আর উল্লেখ না-ই করলাম। হায় রে আইএমএফ, তুমি গাও কী আর তোমার সারিন্দা বাজায় কী? শুরুতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য দালাল ধরার ঘটনা বলেছিলাম। এবার মিলিয়ে নিন!
শেষ আশা তবে সুশাসনেই
ব্যাংক কোম্পানির সর্বশেষ সংশোধনীতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি নামে একটা বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। তথাকথিত ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সংখ্যাত্মক বা নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ডকে পাশ কাটিয়ে ব্যক্তিবিশেষের জন্য থাকছে বিশেষ বিবেচনা। সুতরাং এই আইনের এই বিধান দীর্ঘসূত্রতা বাড়াবে, সুশাসনের পথকে নিদারুণভাবে ব্যাহত করবে। এতে অবশ্যই নতুন করে ঋণ খেলাপ সংস্কৃতির প্রসার ঘটবে।
তাহলে কি আশার দুয়ার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল? না। রাজনৈতিক সদিচ্ছার কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। সুশাসনই পারে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে। চীন, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া করে দেখিয়েছে। আমরাও আশা করতে চাই।
লেখক: লেখক ও ব্যাংকার
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪