শাহানা হুদা রঞ্জনা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা-আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হকচকিত। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমাদের আসাদগেট নিউ কলোনির বাসাটা ৩২ নম্বরের খুব কাছেই ছিল। ফলে অত ভোরে গুলির শব্দ যেন ঝনঝন করে এসে আমাদের কানে লাগছিল। তখনো আমরা জানতে পারিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গুলি চলছে।
আব্বা হতভম্ব হয়ে টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেলল? তুমি রেডিও ধরো।’ আম্মার এ কথার পর আব্বা সংবিৎ ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলেন।
বয়স কম হলেও সেদিনের প্রতিটি ঘটনা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। কারণ, পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে আমরাও জড়িয়ে ছিলাম পরোক্ষভাবে। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ আমি আব্বার হাত ধরে গণভবনে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। ওই রকম বড়মাপের সুন্দর মানুষ আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম।
স্পষ্ট মনে আছে ‘যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা, গৌরী যমুনা বহমান’ কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিখে বঙ্গবন্ধুকে শুনিয়েছিলাম। তিনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। আমার ছোট হৃদয়ে সেই যে বঙ্গবন্ধু নামটা গাঁথা হয়ে গেল আর কোনো দিন তা মুছে গেল না। চোখ বন্ধ করলে সেই ক্যারিশমাটিক চেহারাটা ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম উৎসবে যাওয়ার এবং তাঁকে এত কাছ থেকে দেখার কারণে ১৫ আগস্টের ঘটনা হয়তো আমার কাছে এতটাই স্পষ্ট হয়ে আছে।
১৫ আগস্ট সকালে আব্বা বাংলাদেশ বেতার অন করার পর ভেসে এল মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর। তাঁদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছেন। কণ্ঠে নেই কোনো অনুতাপ, বরং ঝরে পড়ছিল চরম ধৃষ্টতা। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি কখনো আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছেন। তাঁদের কাঁদতে দেখে আমিও বুঝে না-বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্তু পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এর ওপর মাত্র পাঁচ মাস আগে এই মহান নেতাকে দেখে এসেছি।
আমার আব্বা আলহাজ শামসউল হুদা সে সময় ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। আব্বা পাগলের মতো কাঁদছেন, আর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধুর ঠিক পাশের বাসায় মাহবুব চাচারা থাকতেন। আব্বা ক্রমাগত সেখানে ফোন করে চলেছেন। অনেক পরে চাচা ফোন ধরে বললেন, ‘হুদা, মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাই। ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই খাটের নিচে লুকিয়ে আছি। সেনাবাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে।’
আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু দেশের হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা যেত। সেটার নম্বর ছিল তিন ডিজিটের। সেই ফোনটা বেলা ১১টার দিকে বেজে উঠল। ওই পাশ থেকে একজন আব্বাকে বলল, রেডি হয়ে নিতে, কারণ তাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এ কথা শুনে আম্মার অবস্থা হলো শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলেন, ‘ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে। ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেয়ো না রঞ্জনার আব্বা।’
যেখান থেকে ফোন এসেছে, সেখানে না গিয়ে তো কোনো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিলেন। দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিকর অবস্থা।
এরপর প্রায় দেড় দিন চলে গেল, আব্বার কোনো খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। ছোট ভাই বাবেলের বয়স এক বছর, ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয়স্বজন খোঁজখবরও নিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিলাম ওরা হয়তো আব্বাকে মেরেই ফেলবে।
ঠিক এ রকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল। ১৬ আগস্ট সকালবেলায় দেখলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, উনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। অনেকেই হাসি হাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছে। সে সময় জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর একজন সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশসুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভালো হয়েছে, সে বিষয়ে উঁচুগলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর অন্যরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম টিপ্পনী কাটছেন।
আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তখনো ভেবেছি, এখনো ভাবি, যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে এভাবে কেন মারা হলো? তারপর এই হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে মিষ্টিও খাচ্ছে মানুষ? এ রকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে? কেন একজন কর্ণধারকে পরিবারসুদ্ধ হত্যা করা হলো?
সেই সময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আজও পাইনি। কেন তাঁকে নির্বংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কারা করেছিল—সেই ইতিহাস আমি এখন জানি। কিন্তু এরপরও যতবার ১৫ আগস্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ওই মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে।
১৭ আগস্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠল। ওই পাশে আব্বার কণ্ঠস্বর। যাক তাহলে ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মতো নামতে শুরু করল। আম্মা শুধু বলতে থাকলেন, ‘তুমি কী খাইছ? ওরা তোমাকে মারে নাই তো? তুমি কখন আসবা?’ আব্বা জানালেন, তিনি বঙ্গভবনে আছেন এবং ভাত খেয়েছেন।
আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবে। ওই দিন রাত ১১টা-১২টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্তু আব্বার সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ন চেহারাটা আমি কোনো দিন ভুলব না। মনে হলো তাঁকে কেউ প্রচণ্ড রকম অত্যাচার বা নিপীড়ন করেছে। হ্যাঁ, আসলেই নিপীড়ন করেছিল, সেটা ছিল মানসিক নিপীড়ন।
আব্বা পরে বলেছিলেন সেদিন বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে দেখা গিয়েছিল, যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতেন। ছিলেন খন্দকার মোশতাক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু হত্যা করার পর তাঁরা নিজেরাও ছিলেন বিভ্রান্ত ও খানিকটা ভীত। আব্বার ইচ্ছা ছিল একটা বই লিখবেন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু সেই অবসর পাননি মানুষটা।
সেই ১০ বছর বয়সে আমি যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই আমি বুঝেছি। বুঝেছি ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর সেই কুৎসিত কাজকে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হলেন। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষতবিক্ষত হলো দেশ ও দেশের মানুষ। আমি এখনো বিশ্বাস করি এবং সারা জীবন বিশ্বাস করে যাব, ১৫ আগস্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।
এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি লিখে যাব যত দিন সুযোগ পাব। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে প্রায় ’৯০-৯১ সাল পর্যন্ত তাঁর নাম নেওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজের কোনো পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রায় কিছু ছিল না। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস জেনেছি, তারা প্রথমত, পরিবার থেকে জেনেছি আর দ্বিতীয়ত, বই পড়ে জেনেছি। বাকিরা তেমন কিছুই জানেনি অথবা পরিবার থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পেয়ে বড় হয়েছে।
এখনকার যে প্রজন্ম এরা বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযোদ্ধাও দেখেনি, দেখেনি স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে বাঙালির দুঃখ-দুর্দশা। যা জেনেছে সব তৃতীয় কোনো উৎস থেকে জেনেছে; কাজেই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বড় দায়িত্ব এই শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অন্তরে স্বাধীনতার ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর এমন একটি ইমেজ তৈরি করা, যা যুগ যুগ ধরে তারা বয়ে বেড়াবে।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা-আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হকচকিত। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমাদের আসাদগেট নিউ কলোনির বাসাটা ৩২ নম্বরের খুব কাছেই ছিল। ফলে অত ভোরে গুলির শব্দ যেন ঝনঝন করে এসে আমাদের কানে লাগছিল। তখনো আমরা জানতে পারিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গুলি চলছে।
আব্বা হতভম্ব হয়ে টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেলল? তুমি রেডিও ধরো।’ আম্মার এ কথার পর আব্বা সংবিৎ ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলেন।
বয়স কম হলেও সেদিনের প্রতিটি ঘটনা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। কারণ, পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে আমরাও জড়িয়ে ছিলাম পরোক্ষভাবে। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ আমি আব্বার হাত ধরে গণভবনে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। ওই রকম বড়মাপের সুন্দর মানুষ আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম।
স্পষ্ট মনে আছে ‘যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা, গৌরী যমুনা বহমান’ কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিখে বঙ্গবন্ধুকে শুনিয়েছিলাম। তিনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। আমার ছোট হৃদয়ে সেই যে বঙ্গবন্ধু নামটা গাঁথা হয়ে গেল আর কোনো দিন তা মুছে গেল না। চোখ বন্ধ করলে সেই ক্যারিশমাটিক চেহারাটা ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম উৎসবে যাওয়ার এবং তাঁকে এত কাছ থেকে দেখার কারণে ১৫ আগস্টের ঘটনা হয়তো আমার কাছে এতটাই স্পষ্ট হয়ে আছে।
১৫ আগস্ট সকালে আব্বা বাংলাদেশ বেতার অন করার পর ভেসে এল মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর। তাঁদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছেন। কণ্ঠে নেই কোনো অনুতাপ, বরং ঝরে পড়ছিল চরম ধৃষ্টতা। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি কখনো আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছেন। তাঁদের কাঁদতে দেখে আমিও বুঝে না-বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্তু পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল। এর ওপর মাত্র পাঁচ মাস আগে এই মহান নেতাকে দেখে এসেছি।
আমার আব্বা আলহাজ শামসউল হুদা সে সময় ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। আব্বা পাগলের মতো কাঁদছেন, আর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধুর ঠিক পাশের বাসায় মাহবুব চাচারা থাকতেন। আব্বা ক্রমাগত সেখানে ফোন করে চলেছেন। অনেক পরে চাচা ফোন ধরে বললেন, ‘হুদা, মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাই। ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই খাটের নিচে লুকিয়ে আছি। সেনাবাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে।’
আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু দেশের হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলা যেত। সেটার নম্বর ছিল তিন ডিজিটের। সেই ফোনটা বেলা ১১টার দিকে বেজে উঠল। ওই পাশ থেকে একজন আব্বাকে বলল, রেডি হয়ে নিতে, কারণ তাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এ কথা শুনে আম্মার অবস্থা হলো শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলেন, ‘ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে। ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেয়ো না রঞ্জনার আব্বা।’
যেখান থেকে ফোন এসেছে, সেখানে না গিয়ে তো কোনো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিলেন। দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিকর অবস্থা।
এরপর প্রায় দেড় দিন চলে গেল, আব্বার কোনো খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। ছোট ভাই বাবেলের বয়স এক বছর, ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই। বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয়স্বজন খোঁজখবরও নিচ্ছে না। আমরা ধরেই নিলাম ওরা হয়তো আব্বাকে মেরেই ফেলবে।
ঠিক এ রকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল। ১৬ আগস্ট সকালবেলায় দেখলাম আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, উনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। অনেকেই হাসি হাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছে। সে সময় জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর একজন সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশসুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভালো হয়েছে, সে বিষয়ে উঁচুগলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর অন্যরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা রকম টিপ্পনী কাটছেন।
আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তখনো ভেবেছি, এখনো ভাবি, যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে এভাবে কেন মারা হলো? তারপর এই হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে মিষ্টিও খাচ্ছে মানুষ? এ রকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে? কেন একজন কর্ণধারকে পরিবারসুদ্ধ হত্যা করা হলো?
সেই সময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আজও পাইনি। কেন তাঁকে নির্বংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কারা করেছিল—সেই ইতিহাস আমি এখন জানি। কিন্তু এরপরও যতবার ১৫ আগস্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ওই মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে।
১৭ আগস্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠল। ওই পাশে আব্বার কণ্ঠস্বর। যাক তাহলে ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মতো নামতে শুরু করল। আম্মা শুধু বলতে থাকলেন, ‘তুমি কী খাইছ? ওরা তোমাকে মারে নাই তো? তুমি কখন আসবা?’ আব্বা জানালেন, তিনি বঙ্গভবনে আছেন এবং ভাত খেয়েছেন।
আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবে। ওই দিন রাত ১১টা-১২টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্তু আব্বার সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ন চেহারাটা আমি কোনো দিন ভুলব না। মনে হলো তাঁকে কেউ প্রচণ্ড রকম অত্যাচার বা নিপীড়ন করেছে। হ্যাঁ, আসলেই নিপীড়ন করেছিল, সেটা ছিল মানসিক নিপীড়ন।
আব্বা পরে বলেছিলেন সেদিন বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে দেখা গিয়েছিল, যাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতেন। ছিলেন খন্দকার মোশতাক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। কিন্তু হত্যা করার পর তাঁরা নিজেরাও ছিলেন বিভ্রান্ত ও খানিকটা ভীত। আব্বার ইচ্ছা ছিল একটা বই লিখবেন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু সেই অবসর পাননি মানুষটা।
সেই ১০ বছর বয়সে আমি যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই আমি বুঝেছি। বুঝেছি ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর সেই কুৎসিত কাজকে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁরা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হলেন। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষতবিক্ষত হলো দেশ ও দেশের মানুষ। আমি এখনো বিশ্বাস করি এবং সারা জীবন বিশ্বাস করে যাব, ১৫ আগস্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।
এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি লিখে যাব যত দিন সুযোগ পাব। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে প্রায় ’৯০-৯১ সাল পর্যন্ত তাঁর নাম নেওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। স্কুল-কলেজের কোনো পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে প্রায় কিছু ছিল না। আমরা যারা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস জেনেছি, তারা প্রথমত, পরিবার থেকে জেনেছি আর দ্বিতীয়ত, বই পড়ে জেনেছি। বাকিরা তেমন কিছুই জানেনি অথবা পরিবার থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পেয়ে বড় হয়েছে।
এখনকার যে প্রজন্ম এরা বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মুক্তিযোদ্ধাও দেখেনি, দেখেনি স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে বাঙালির দুঃখ-দুর্দশা। যা জেনেছে সব তৃতীয় কোনো উৎস থেকে জেনেছে; কাজেই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বড় দায়িত্ব এই শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের অন্তরে স্বাধীনতার ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুর এমন একটি ইমেজ তৈরি করা, যা যুগ যুগ ধরে তারা বয়ে বেড়াবে।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরলেন। সেদিন অপরাহ্ণে রেসকোর্সে অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণটি আমি শুনেছিলাম—১৭ মিনিটের। ভাষণে একটি জায়গায় তিনি বলেছিলেন, একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে,
২৬ মার্চ ২০২৪১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার একটি সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র মানে বৈষম্যের অবসান। সমাজতন্ত্র মানে ন্যায্যতা। সমাজতন্ত্র মানে সবার শিক্ষা, চিকিৎসা, মাথাগোঁজার ঠাঁই, কাজের সুযোগ। সমাজতন্ত্র মানে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুয
২৬ মার্চ ২০২৪স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার চালিকা শক্তি হিসেবে চারটি মৌলনীতি গ্রহণ করেছিলেন। এগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। আজ ৫২ বছর পর দেখছি, এই মৌলনীতিগুলোর প্রতিটির সূচক এত নিচে নেমে গেছে যে, বলা চলে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলনীতি বলে এখন আর কিছু নেই। জাতীয়তা দুই ভাগে বি
২৬ মার্চ ২০২৪বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র হিসেবে নবীন, কিন্তু এর সভ্যতা সুপ্রাচীন। নদীবেষ্টিত গাঙেয় উপত্যকায় পলিবাহিত উর্বর ভূমি যেমন উপচে পড়া শস্যসম্ভারে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি নদীর ভাঙনের খেলায় রাতারাতি বিলুপ্ত হয়েছে বহু জনপদ। এরপরও সভ্যতার নানা চিহ্ন এখানে খুঁজে পাওয়া যায় এবং বাঙালিত্বের বৈশিষ
২৬ মার্চ ২০২৪