আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা
কালের গহ্বরে বিলীন হলো আরেকটি বছর। নতুন বছরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি গড়ে উঠবে। নতুন বছরে আসতে পারে এমন চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত—এ বিষয়ে কথা বলেছেন নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি জানুন আজকের পত্রিকায়, রোকন উদ্দীন ও আসাদুজ্জামান নূর-এর প্রতিবেদনে।
আছে ৬ চ্যালেঞ্জ থাকছে সুযোগও
ড. আব্দুর রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)
নতুন বছর বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হবে প্রধান অগ্রাধিকার। অনেক ব্যাংক বর্তমানে তারল্যসংকট, পরিচালন দুর্বলতা ও আস্থার সংকটে ভুগছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত ও দৃঢ় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সংঘাত রপ্তানি খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনে এ সংকট আরও বাড়তে পারে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করবে।
রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি। আয় না বাড়ালে আর্থিক পরিসর সংকুচিত হয়ে উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য রাজস্বনীতি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যা বৈষম্য হ্রাস ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
পরবর্তী জাতীয় বাজেট একটি বড় পরীক্ষা হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে স্পষ্ট নীতি ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। শ্বেতপত্রে উঠে আসা সমস্যা মাথায় রেখে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার খাতে ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
পবিত্র রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি, যাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সুরক্ষিত থাকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিশেষ সহায়তা পায়।
২০২৫ সাল অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, যেখানে আর্থিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী নীতি ও বাজেট বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করছে। সবশেষে ২০২৫ সালটি চ্যালেঞ্জের হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা মোকাবিলা সম্ভব। সেখানে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও জনমুখী নীতি অগ্রগতির পথ সুগম করবে।
উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্প নেই
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি অর্থনীতিবিদ
কোভিড-১৯-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি উপকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্য, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্য। যদিও বেশির ভাগ দেশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফিরেছে, বাংলাদেশে তা ক্রমেই বাড়ছে। আমদানিনির্ভরতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি খোলার বিলম্ব, আমদানি-রপ্তানি বিঘ্ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং পূর্ববর্তী সরকারের গ্রহণ করা নীতি, যেমন ক্রলিং পেগ, সুদহার পরিবর্তন, এসবের মাধ্যমে অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও তা কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বাজারে মুদ্রা সরবরাহের কারণে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ হচ্ছে কস্ট-পুশ বা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি। এটি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন খরচ কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে উদ্ভাবনী নীতি এবং সহায়তার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব। বিশেষ করে স্বল্পকালীন কৌশল হিসেবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানো এবং খাদ্যপণ্যের দাম মনিটরিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম মনিটরিং ও এন্ট্রি-হোর্ডিং রেগুলেশনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ কোনোভাবে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে। আমদানি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ঋণপত্র খোলাতে সহযোগিতা ও সময়মতো পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়নে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে; যা আমাদের পণ্যের সরবরাহ এবং ডলারের রিজার্ভ বাড়াবে। উৎপাদন কার্যক্রম ও বাজারব্যবস্থা যাতে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে চলতে পারে, সেই রকম আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে না পারলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
বড় চাওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি
তাসকীন আহমেদ, সভাপতি, ডিসিসিআই
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যেগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে, কলকারখানার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার, অর্থায়নের অভাব এবং জ্বালানির সরবরাহ সংকট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাও ব্যবসায়িক পরিবেশে অসুবিধা সৃষ্টি করছে, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, ব্যবসার আয় কমছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
নতুন বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আমাদের প্রধান প্রত্যাশা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে। একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে। একইভাবে ব্যবসায়িক খাতে যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারের জন্য। এই খাতে আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হলো নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। জ্বালানির অনিশ্চিত সরবরাহ উৎপাদন খাতে বড় সমস্যা তৈরি করছে, যা ব্যবসার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে জ্বালানির সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সহজীকরণ ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা থাকবে যে তারা ব্যবসায়ীদের জন্য নীতিগত সহায়তা প্রদান করবে এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে জটিলতা দূর করবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, শিল্পে অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও উন্নত হবে এবং অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
উদ্বেগ কাটাতে চাই ৩ সমস্যার সমাধান
মহিউদ্দিন রুবেল, সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ
২০২৪ সালে পোশাকশিল্প নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, যার কারণে কাঙ্ক্ষিত রপ্তানি আয় অর্জন সম্ভব হয়নি। তবে ২০২৫ সালে আমরা বিশ্ব অর্থনীতি এবং পোশাকশিল্পের পুনরুদ্ধারের প্রতি গভীর আশাবাদী। এর জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্প সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পোশাক খাতের টেকসই বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপগুলো অত্যাবশ্যক। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
২০২৪ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয় ছিল ৩৪.৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও কারখানা বন্ধের মতো অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মজুরি ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময়ে এটি বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়।
শিল্পটি আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যখন সরকার ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি প্রণোদনা ৬০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এদিকে বৈশ্বিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের শেষে আঙ্কটাড বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে ৫ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির পরেও পোশাকের ইউনিট মূল্য হ্রাস পেয়েছে।
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খরচের বৃদ্ধি এবং উচ্চ ব্যাংক সুদের কারণে পোশাকশিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যা বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই মাসের আন্দোলনের ফলে কিছু অস্থিরতা তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে রপ্তানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। অক্টোবর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পোশাক খাত টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়েছে, যেমন লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অ্যাকটিভ ওয়্যারের মতো নতুন পণ্যের বৈচিত্র্য।
কালের গহ্বরে বিলীন হলো আরেকটি বছর। নতুন বছরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি গড়ে উঠবে। নতুন বছরে আসতে পারে এমন চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত—এ বিষয়ে কথা বলেছেন নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি জানুন আজকের পত্রিকায়, রোকন উদ্দীন ও আসাদুজ্জামান নূর-এর প্রতিবেদনে।
আছে ৬ চ্যালেঞ্জ থাকছে সুযোগও
ড. আব্দুর রাজ্জাক, চেয়ারম্যান, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)
নতুন বছর বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা হবে প্রধান অগ্রাধিকার। অনেক ব্যাংক বর্তমানে তারল্যসংকট, পরিচালন দুর্বলতা ও আস্থার সংকটে ভুগছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দ্রুত ও দৃঢ় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সংঘাত রপ্তানি খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনে এ সংকট আরও বাড়তে পারে, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করবে।
রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য জরুরি। আয় না বাড়ালে আর্থিক পরিসর সংকুচিত হয়ে উন্নয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য রাজস্বনীতি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যা বৈষম্য হ্রাস ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
পরবর্তী জাতীয় বাজেট একটি বড় পরীক্ষা হবে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে স্পষ্ট নীতি ও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। শ্বেতপত্রে উঠে আসা সমস্যা মাথায় রেখে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার খাতে ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
পবিত্র রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি, যাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি সুরক্ষিত থাকে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিশেষ সহায়তা পায়।
২০২৫ সাল অর্থনৈতিক সংস্কার ও জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ, যেখানে আর্থিক ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণ এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী নীতি ও বাজেট বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করছে। সবশেষে ২০২৫ সালটি চ্যালেঞ্জের হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা মোকাবিলা সম্ভব। সেখানে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ ও জনমুখী নীতি অগ্রগতির পথ সুগম করবে।
উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্প নেই
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি অর্থনীতিবিদ
কোভিড-১৯-পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, যা বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি উপকরণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্য, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্য। যদিও বেশির ভাগ দেশ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফিরেছে, বাংলাদেশে তা ক্রমেই বাড়ছে। আমদানিনির্ভরতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি খোলার বিলম্ব, আমদানি-রপ্তানি বিঘ্ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং পূর্ববর্তী সরকারের গ্রহণ করা নীতি, যেমন ক্রলিং পেগ, সুদহার পরিবর্তন, এসবের মাধ্যমে অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও তা কার্যকর হয়নি। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বাজারে মুদ্রা সরবরাহের কারণে মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির মূল কারণ হচ্ছে কস্ট-পুশ বা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিজনিত মুদ্রাস্ফীতি। এটি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন খরচ কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে উদ্ভাবনী নীতি এবং সহায়তার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব। বিশেষ করে স্বল্পকালীন কৌশল হিসেবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়ানো এবং খাদ্যপণ্যের দাম মনিটরিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম মনিটরিং ও এন্ট্রি-হোর্ডিং রেগুলেশনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ কোনোভাবে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে। আমদানি শুল্ক কমানোর পাশাপাশি ঋণপত্র খোলাতে সহযোগিতা ও সময়মতো পণ্যের ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘ মেয়াদে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারব্যবস্থা উন্নয়নে অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে; যা আমাদের পণ্যের সরবরাহ এবং ডলারের রিজার্ভ বাড়াবে। উৎপাদন কার্যক্রম ও বাজারব্যবস্থা যাতে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে চলতে পারে, সেই রকম আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে না পারলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে।
বড় চাওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি
তাসকীন আহমেদ, সভাপতি, ডিসিসিআই
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যেগুলো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে, কলকারখানার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার, অর্থায়নের অভাব এবং জ্বালানির সরবরাহ সংকট ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতাও ব্যবসায়িক পরিবেশে অসুবিধা সৃষ্টি করছে, ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, ব্যবসার আয় কমছে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
নতুন বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আমাদের প্রধান প্রত্যাশা হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে। একটি স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলার পরিবেশ বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করবে। একইভাবে ব্যবসায়িক খাতে যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করা জরুরি, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসারের জন্য। এই খাতে আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সম্ভব হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হলো নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। জ্বালানির অনিশ্চিত সরবরাহ উৎপাদন খাতে বড় সমস্যা তৈরি করছে, যা ব্যবসার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে জ্বালানির সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা অত্যন্ত জরুরি। প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সহজীকরণ ব্যবসায়ীদের খরচ কমাবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের এই প্রত্যাশা থাকবে যে তারা ব্যবসায়ীদের জন্য নীতিগত সহায়তা প্রদান করবে এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে জটিলতা দূর করবে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি, শিল্পে অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও উন্নত হবে এবং অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
উদ্বেগ কাটাতে চাই ৩ সমস্যার সমাধান
মহিউদ্দিন রুবেল, সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ
২০২৪ সালে পোশাকশিল্প নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, যার কারণে কাঙ্ক্ষিত রপ্তানি আয় অর্জন সম্ভব হয়নি। তবে ২০২৫ সালে আমরা বিশ্ব অর্থনীতি এবং পোশাকশিল্পের পুনরুদ্ধারের প্রতি গভীর আশাবাদী। এর জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্প সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পোশাক খাতের টেকসই বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপগুলো অত্যাবশ্যক। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এই বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
২০২৪ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয় ছিল ৩৪.৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও কারখানা বন্ধের মতো অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মজুরি ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হলেও জাতীয় নির্বাচনের সময়ে এটি বাস্তবায়নে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়।
শিল্পটি আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, যখন সরকার ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি প্রণোদনা ৬০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এদিকে বৈশ্বিক সংঘাত ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের শেষে আঙ্কটাড বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে ৫ শতাংশ হ্রাসের পূর্বাভাস দিয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির পরেও পোশাকের ইউনিট মূল্য হ্রাস পেয়েছে।
গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খরচের বৃদ্ধি এবং উচ্চ ব্যাংক সুদের কারণে পোশাকশিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, যা বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই মাসের আন্দোলনের ফলে কিছু অস্থিরতা তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে রপ্তানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। অক্টোবর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পোশাক খাত টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়েছে, যেমন লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অ্যাকটিভ ওয়্যারের মতো নতুন পণ্যের বৈচিত্র্য।
সিঙ্গাপুরের উইলমার ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে ভোগ্যপণ্য ব্যবসার যৌথ উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ভারতের আদানি গ্রুপ। উইলমার ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসতে ২০০ কোটি ডলারে চুক্তি করেছে আদানি।
১১ ঘণ্টা আগেলালমনিরহাটের বড় কমলাবাড়ির চাষি আসাদ মিয়া ঋণ করে এবার ২৭ শতাংশ জমিতে ফুলকপির চাষ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছে। আশা ছিল, ফুলকপি বিক্রি করে ঋণের টাকা শোধ করবেন। মুনাফার একটা অংশ দিয়ে সংসারের খরচ, আরেক অংশ দিয়ে পরবর্তী ফসল চাষের খরচ মেটাবেন। কিন্তু তাঁর সেই হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। এবার ফুলকপির দাম ৫ থেকে ৬
১ দিন আগেরাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) ওপর ভর করার যে পথটি বেছে নিয়েছে, তা প্রতিকূল ফলাফল নিয়ে আসতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন। ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদশালীদের ওপর সরাসরি বাড়তি কর আরোপের পরিবর্তে
১ দিন আগেফেব্রুয়ারির পর ব্যবসা-বাণিজ্যের ১৯ বিভাগের সব লাইসেন্স আবেদন বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে করতে হবে। তা না হলে ওই বিভাগের বরাদ্দ বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
১ দিন আগে