ট্রাম্পের শুল্কনীতি বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ে যাবে যেই খাদে

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মোতাবেক পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বাণিজ্য ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে। বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব কেমন হবে? এটি ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদারীকরণ যুগের অবসান ঘটাবে নাকি সবকিছু উল্টে দিবে?

ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের মডেল অনুযায়ী, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্ক আরোপের কারণে বিশ্বের অসংখ্য দেশের বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়বে। এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক ক্ষতি পূরণ করতে একে অপরের সঙ্গে আরও বেশি বাণিজ্য করবে। এতে বিশ্বায়ন চলমান থাকলেও সেটি আর যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে হবে না।

এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে ব্লুমবার্গ উইকএন্ড ব্লুমবার্গ ইকোনমিকসের প্রধান বাণিজ্য ও জলবায়ু অর্থনীতিবিদ মায়েভা কাউসিনের সঙ্গে কথা বলেছেন।

তাঁদের অভিমত, যুক্তরাষ্ট্রে সকল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ ১৯৪০-এর দশকে ফিরে যাওয়ার সমান। ট্রাম্প চীনের ওপর ৬০ শতাংশ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্কহার প্রায় ৩ শতাংশ। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের আগে এটি ১ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৩০ সালের স্মুট-হাওলি শুল্ক আইনে গড় শুল্ক প্রায় ২০ শতাংশে পৌঁছেছিল। তবে এই বৃদ্ধির আগে তৎকালীন শুল্কহার ১৪ শতাংশ ছিল। সেখানে ট্রাম্পের শুল্কহার ৩ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশে বৃদ্ধি আরও বড় ধাক্কা হবে।

এর প্রভাব সম্পর্কে ঐতিহাসিক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হওয়ায় ব্লুমবার্গ বিশ্ব অর্থনীতির ‘কম্পিউটেবল জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল’ ব্যবহার করেছে। মডেল অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের আমদানি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যাবে ও চীনের পণ্য আমদানি প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যাবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রায় কোনো বাণিজ্যই থাকবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানির কী হবে?

চীন বা অন্যান্য দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ নীতিতে না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাবে। আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করলে বিদেশি পণ্যর দাম বাড়বে ও যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। অন্য দেশগুলো পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে মার্কিন রপ্তানি প্রায় ৬০ শতাংশ কমে যাবে। আমদানি ও রপ্তানি একসঙ্গে কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতিও একই থেকে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু খাত কি লাভবান হবে?

আমদানির সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করা খাতগুলোর জন্য শুল্ক আরোপ লাভজনক হতে পারে। ব্লুমবার্গের মডেলে দেখা যায়, দেশটির খনিজ সম্পদ ও টেক্সটাইল খাত উপকৃত হতে পারে।

বিশ্বের অন্য দেশগুলো কী লাভবান হবে?

বিশ্বে বাণিজ্যিক পণ্যের ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে আসে বা সেখান থেকে যায়। শুল্ক আরোপের প্রভাবে তা ৯ শতাংশে নেমে আসবে। অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের শূন্যতা পূরণ করবে ও পণ্য আমদানি বাড়াবে। অন্যান্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য ৫ শতাংশ বাড়তে পারে, আর মোট বিশ্ব বাণিজ্য প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলেও বাকি বিশ্বের তুলনায় এখনো অনেকটা ছোট (মেক্সিকো ও কানাডা বিশেষ ব্যতিক্রম)।

চীনের রপ্তানি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কীভাবে টিকিয়ে রাখবে?

চীন বর্তমানে আমদানির তুলনায় অনেক বেশি রপ্তানি করে। এর একটি বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। এই বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত আয় অব্যাহত থাকবে কী?

চীনের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ও উৎপাদন সক্ষমতা পুনর্গঠনের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথম বাণিজ্য যুদ্ধে দেশটি বেশ ভালোভাবে সামাল দিয়েছিল। চীন সম্ভবত নতুন বাজার খুঁজে পাবে। তবে রাজনৈতিকভাবে এটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা ও প্রতিযোগিতা নিয়ে। এই চ্যালেঞ্জ ব্লুমবার্গের মডেল পুরোপুরি মূল্যায়ন করতে পারেনি।

যদি শুধু চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং অন্যদের ওপর না করা হয়, তখন কি হবে? সে ক্ষেত্রে ‘সংযোগকারী’ অর্থনীতির মাধ্যমে সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠিত হতে পারে। মার্কিন আমদানি শুল্কের কারণে আগামী ১০ বছরে বিশ্ব বাণিজ্য কমে গেলে অন্য দেশগুলোও পাল্টা আমদানি শুল্ক আরোপ করতে পারে। ফলে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য আরও কমে যেতে পারে।

বিশ্বজুড়ে উদ্ভাবন ও উৎপাদনশীলতার ওপর শুল্কের প্রভাব কী হবে?

ব্লুমবার্গের মডেল অনুযায়ী, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি। তাই প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে ভবিষ্যতে কিছু দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি মেক্সিকোর জন্য বড় সমস্যা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, টেক্সটাইল বা খনিশিল্প উৎপাদনে গুরুত্ব দিলে আরও বেশি সম্পদ এই খাতগুলোতে ব্যয় করতে হবে। এতে উচ্চ উৎপাদনশীল খাতগুলোতে কম সম্পদ ব্যয় করতে হবে।

পাঠকদের কোন বিষয়ে নজর রাখা উচিত?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ব্লুমবার্গের মডেল বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য প্রবাহ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং কীভাবে তা দ্রুত সমন্বয় করা হচ্ছে সেটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। চীনের প্রোডিউসার প্রাইস ইনডেক্সে (পিপিআই) কম চাহিদা মূল্য নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে কিনা ও মন্দাভাব দেখা দিচ্ছে কিনা তাও দেখতে হবে। এটি এমন পরিস্থিতি হতে পারে যে, চীন রপ্তানির জন্য যথেষ্ট বাজার না পেলে কারখানাতেই পণ্যের মূল্য কমাতে বাধ্য হবে, এর প্রভাব চীনের শ্রমিকদের মজুরির ওপরও পড়বে।

অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির দিকেও নজর রাখতে হবে, যাতে ট্যারিফরা ভোক্তাদের কাছে বেশি দামি পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়।

মার্কিন আমদানি শুল্ক আরোপের সমর্থকদের ধারণা, এই বিষয়ে প্রচলিত অর্থনীতির ভুল ব্যাখ্যা রয়েছে। এমন কোনো অর্থনৈতিক প্রশ্ন রয়েছে কী, যা ট্যারিফের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে?

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, সমন্বয় কত দ্রুত ঘটে। আমরা জানি যে, আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে কোম্পানিগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নতুন উপায় খুঁজে বের করতে পারে। তবে শুল্ক অনেক বেশি এবং সব ধরনের পণ্যের ওপর আরোপ করা হলে দেখতে হবে তাঁরা কত দ্রুত সামঞ্জস্য ঘটাতে পারবে?

ব্লুমবার্গ থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত