২০৫ প্রভাবশালীর নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে শেয়ারবাজার

  • আওয়ামী লীগ আমলে পুঁজিবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ
  • ২০৫ প্রভাবশালীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বড় নেটওয়ার্ক
  • সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল ফ্লোরপ্রাইস পদ্ধতি
  • পুঁজিবাজারে আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের
  • এশিয়ায় শুধু কম্বোডিয়ার চেয়ে এগিয়ে
মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ১৭
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০: ২৩
প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও চক্রের সদস্যদের নির্লজ্জ দায়মুক্তি পুঁজিবাজারকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে নিয়ে এসেছে বলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কারসাজি চক্রের সদস্যরা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে কোম্পানি বাজারে আসার সময় জালিয়াতি করেছে। নামে-বেনামে প্রতারণা, প্লেসমেন্ট-বাণিজ্য এবং শেয়ার কারসাজি করেছে। এসবের মাধ্যমে জনগণের ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত বছরে যা হয়েছে, বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহযোগিতায় হয়েছে। বিএসইসি সরকারের বিভিন্ন মহলকে সুবিধা দিতে বাজারে এত বেশি হস্তক্ষেপ করেছে; যা বলার মতো নয়। এমন কিছু নির্দেশ সকালে এক রকম এসেছে, বিকেলে আরেক রকম। ২০১০ সালের ধসের পর দুটি কমিশন বাজার দেখভাল করছে, তারাই ভুয়া কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছে। প্লেসমেন্ট বাণিজ্য করায় উৎসাহিত করেছে। আর শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়েছে। বাজার পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। তার ফলই হচ্ছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার, এশিয়ার খারাপ বাজারের একটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত বছরে অনিয়মের কারণে পুঁজিবাজারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা এখন স্তব্ধ হয়ে আছেন। কারণ, ২০১০ সালের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; বরং তদন্ত প্রতিবেদনে যাঁদের নাম এসেছিল, তাঁদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতি শুধু বিনিয়োগকারীদেরই নয়; বরং বাজার মূলধনের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু কম্বোডিয়ার চেয়ে এগিয়ে আছে দেশের পুঁজিবাজার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ২০২৩ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী বলছেন, পুঁজিবাজারে কারসাজির মাধ্যমে লেনদেন হয়। ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, বাজার পরিচালনায় বিএসইসির কার্যক্রমে দুর্বলতা রয়েছে। বাজারের ৫০ শতাংশ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া আইপিওর মাধ্যমে বাজারে আসা কোম্পানির মধ্যে ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ দুর্বল কোম্পানি। দুর্বল কোম্পানি আসার শীর্ষে থাকা বছরটি হলো ২০২২ সাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে ১৫ বছরের দুর্নীতি, অনিয়ম তুলে ধরায় কমিটিকে ধন্যবাদ। আগের সরকারের সময় দুর্বল কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদন না দেওয়ার পাশাপাশি শেয়ার কারসাজি চক্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সব স্টেকহোল্ডার কথা বলেছি, কিন্তু কর্ণপাত করেনি; বরং নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে অধ্যাপক খায়রুল হোসেন এবং শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কমিশন অসাধু চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে খারাপ কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়েছেন। শেয়ার কারসাজি চক্রকে দায়মুক্তিও দিয়েছেন। পুঁজিবাজার খারাপ হওয়ার পেছনে এই দুই ব্যক্তি দায়ী। আমি তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত বছরে পুঁজিবাজারে ২০৫ প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীর মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে। যারা ব্যাংক খাতের অপরাধী, তারা পুঁজিবাজারে আস্থা নষ্ট করার পেছনেও ছিল।

কারসাজি সম্পর্কে শ্বেতপত্রে বলা হয়, শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা কীভাবে শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক ক্ষতি করে, তা এই বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। জনরোষ এবং তদন্ত সত্ত্বেও এই কারসাজির পেছনের মূল খেলোয়াড়দের অনেকে রাজনৈতিক সুরক্ষায় বিচার এড়িয়ে গেছেন।

কীভাবে পুঁজিবাজারে কারসাজি করা হয়, সে বিষয়ে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বেশ কিছু প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে নিজেদের মধ্যে একের পর এক লেনদেন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ায়। তারা ‘টার্গেটেড’ কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন করে, যেখানে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনেন। এভাবেই ওই কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের সক্রিয় চেহারা দেখানো হয়। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়ায় এমনভাবে কারসাজি করা হয়, যাতে কোম্পানির মূল্যায়ন বোঝা না যায়।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কিছু বড় মিউচুয়াল ফান্ড দখল করেছে। এ ক্ষেত্রে বিএসইসি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। খায়রুল কমিশন বন্ধ থাকা মিউচুয়াল ফান্ডের সময়কাল অতিরিক্ত ১০ বছর বর্ধিত করে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে নামে।

শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে সূচক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্জিন ঋণের অনুপাত বাড়ানোর নিয়ম করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারের উত্থানে ইন্ধন দেওয়া হয়। বিএসইসি প্রায়ই শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিকে উপেক্ষা করে সূচক বজায় রাখার চেষ্টা করে। যখনই দাম কমতে শুরু করে, তখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকলাপ শুরু হয়। সবচেয়ে বিতর্কিত ফ্লোর প্রাইস পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাজারের সুনামকে কলঙ্কিত করেছে। এর মাধ্যমে ভালো কোম্পানির লেনদেন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাজারে কারসাজিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শ্বেতপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের সবাই পুঁজিবাজারে গত ১৫ বছর কী হয়েছিল, তা জানতে পারল। বিগত সময়ের অরাজকতার ফলে বিনিয়োগকারী এবং পুঁজিবাজার যে ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তা পোষাতে সরকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। নতুন পরিকল্পনায় বাজার কীভাবে ভালো রাখা যায়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যায়, সেই নির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলেই আমরা বিনিয়োগকারী আনতে পারব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত