দক্ষিণ আফ্রিকায়ও ‘ভয়ংকর’ বাংলাদেশি অপরাধীরা

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২২, ১২: ২২
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২২, ১৩: ১২

দক্ষিণ আফ্রিকায় মানব পাচার, অপহরণ, নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়, পুড়িয়ে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে দুই শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি জড়িত। তারা প্রতি মাসে ৬০-৭০ জনকে অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায় করে। মুক্তিপণ না মিললে হত্যাও করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েও কোনো প্রবাসী সহজে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না। তাঁদের ভয়, বাংলাদেশের পুলিশ ফেরত নিয়ে আসবে অথবা অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া নিয়ে পরিবার জেরার মুখে পড়বে। হয়রানি ও ভীতির কারণে দেশে থাকা স্বজনেরা অপহরণকারীদের স্থানীয় প্রতিনিধির হাতে মুক্তিপণ দিলেও পুলিশকে জানান না।

জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ, কেপটাউন ও ডারবানে বেশি থাকেন বাংলাদেশিরা। সেখানকার বেশির ভাগ মুদিদোকানের মালিক তাঁরা। ওই সব দোকানে চাঁদাবাজি, মালিক ও কর্মচারীদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশিরাই জড়িত। প্রবাসীদের টার্গেট করে অপহরণের পর দেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয় স্থানীয় দালালের মাধ্যমে।

প্রবাসী রেজাউল আমিন মোল্লা ও রিয়াজ হোসেন পাটোয়ারী এমন অপহরণের শিকার। রেজাউলের বাড়ি মাদারীপুর এবং রিয়াজের বাড়ি চাঁদপুরে। রিয়াজ মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও রেজাউল আমিনকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তাঁর লাশ জঙ্গলে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। পরে জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় মাথার খুলি ও কঙ্কাল। তবে পরিচয় শনাক্ত হয়নি এখনো। ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।

৯০% অপহরণে জড়িত বাংলাদেশিরা
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশি অপরাধীরা নিষ্ঠুরতায় কৃষ্ণাঙ্গ অপরাধীদেরও ছাড়িয়ে যায়। হত্যার পর পুড়িয়ে লাশ গুম করতেও পিছপা হয় না তারা। দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া মামলার পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, সে দেশে ৯০ শতাংশ অপহরণ ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশিরা জড়িত।স্বজনেরা জানান, মাদারীপুরের রেজাউল আমিন মোল্লাকে (৩০) অপহরণ ও পুড়িয়ে হত্যার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি চক্রই। তিনি কুমুতলাং শহরে ২০১৪ সাল থেকে মুদিদোকানের ব্যবসা করতেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে একদিন রেজাউলের কাছে এক বাংলাদেশি তরুণ আশ্রয় চান নিজেকে মাদারীপুরের পরিচয় দিয়ে। রেজাউল বিশ্বাস করে তাঁকে জায়গা দেন। এর কয়েক দিন পরই দেশে রেজাউলের মায়ের মোবাইল ফোন নম্বরে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। বাংলাদেশি ওই লোক তাঁর মায়ের কাছে ইমো নম্বর চায়। রেজাউলের মা বুঝতে না পেরে ছোট ছেলে নিজামুর রহমান মাসুদকে ফোন দেন।

ওই ব্যক্তির কথায় মাসুদ ইমো নম্বর দেন। এরপর ওই ব্যক্তি মাসুদকে বলেন, রেজাউল সিগারেট কিনে টাকা না দেওয়ায় পাকিস্তানিরা তাঁকে আটকে রেখেছে, ৩০ লাখ টাকা দিলে মুক্তি দেবে। ওই লোকের দাবি, তাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের যোগাযোগ আছে, টাকা দিলে তারা ছাড়াতে পারবে।

মাসুদ জানান, রেজাউলকে মুখ বেঁধে, উলঙ্গ করে পেটানোর একাধিক ভিডিও চিত্র তাঁর ইমো নম্বরে পাঠায় অপহরণকারীরা। নির্মমতা দেখে পরিবার ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে রাজি হয়। যাত্রাবাড়ীতে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর মাসুদ এক লাখ টাকা নিয়ে দুই ব্যক্তিকে দেন। তারা বলে, বাকি টাকা দ্রুত দিলে রেজাউলকে ছাড়া হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় জামালপুরের সিহাব থাকে। তার মা ও বোনকে টাকা পৌঁছে দিলে রেজাউল মুক্তি পাবে। এরপর রেজাউলের আর কোনো সন্ধান পায়নি তার পরিবার।

ওই ঘটনায় ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা করেন নিজামুর রহমান মাসুদ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ডেমরা জোনাল টিম মামলাটির তদন্ত করছে। তথ্য যাচাই করতে সম্প্রতি তাদের একটি দল দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল। জোহানেসবার্গ, কেপটাউন ও ডারবানে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ডিবির এসআই কামরুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রেজাউলকে অপহরণ করে বাংলাদেশি একটি চক্র। তাদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ও পাকিস্তানি থাকলেও তারা মূল হোতা নয়। বাংলাদেশি অপরাধী চক্রটি কার কাছে টাকা রয়েছে, কার অবস্থা কেমন, তার খোঁজ নেয়। এরপর আশ্রয় বা চাকরি চেয়ে সহানুভূতি আদায় করে। কেউ আশ্রয় দিলে তাকে কৌশলে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অজ্ঞাত স্থানে রেখে নির্যাতন করে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে। রেজাউলকেও অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।’ লাশ গুম করতে জঙ্গলে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলেও জানান তিনি।

রেজাউলের ভাই মাসুদ বলেন, ‘আমরা অপহরণকারীদের ১১ লাখ টাকা দিয়েছি, তারপরও তারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এরা সবাই বাংলাদেশি। আমরা ২০২২ সালের ৭ জানুয়ারি জানতে পারি, ভাইকে হত্যা করে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

হয়রানির ভয়ে মামলা করতে অনাগ্রহ
প্রবাসীরা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও কোনো মামলা করতে চান না। ২০২১ সালের ৯ মে দালালের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা যান চাঁদপুরের রিয়াজ হোসেন পাটোয়ারী (২১)। যারা তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়েছিল, তারাই তাঁকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চায়। রিয়াজের বাবা মিলন হোসেন দেশে অপহরণকারীদের প্রতিনিধিকে প্রথমে ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেন, পরে নূর আলম নামের এক মানব পাচারকারীর মাধ্যমে আরও টাকা দেন। এরপর রিয়াজ মুক্তি পান।

রিয়াজের বাবা মিলন হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে পাঠিয়েছি। সেখানে আমার ভাইয়েরা রয়েছে। এখন যদি ফেরত আসতে হয়, সেই ভয় ছিল আমাদের। অপহরণকারীরা টাকা দেওয়ার পরই ছেড়ে দিয়েছে।’

রিয়াজকে অপহরণের সঙ্গে জড়িত শফিউল আজম, নুর আলম, রুহুল আমিন ও বাহারকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করেছিল ডিএমপির ডিবি। তবে সবাই জামিনে মুক্ত।

দেশে শনাক্ত করার কাজে পুলিশ
জনশক্তি রপ্তানির চুক্তি না থাকায় নানা দেশ ঘুরে ট্যুরিস্ট ভিসায় সেখানে যান বাংলাদেশিরা। গত এক দশকে বাংলাদেশের একটি চক্র পাকিস্তানি ও দক্ষিণ আফ্রিকার অপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এদের ২০৭ জনের নাম ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়েছে ওই দেশের পুলিশ। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে বাংলাদেশের পুলিশ।

দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়া পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশি দুই শ অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ পুলিশেরও সহযোগিতা চেয়েছে। আমরা তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করব। এরপর ব্যবস্থা নিতে যৌথভাবে কাজ করব।’

ডিবির ডেমরা জোনাল টিমের অতিরিক্ত কমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা দুটি মামলা তদন্ত করছি। রিয়াজের মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তদন্ত শেষ পর্যায়ে। রেজাউলের লাশ শনাক্তের কাজ শেষ হলে দ্রুত তাঁর বিষয়েও তদন্ত অগ্রসর হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত