বাপের জমি বেচে না দেওয়ায় স্ত্রীকে রাতের আঁধারে গুলি

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৪, ০০: ৫৮
Thumbnail image

ঘটনার কয়েক দিন পর জানা গেল, রহিমা খাতুন সাগরিকা (২৩) নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন। অভিযোগ উঠেছে, ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে একটি পক্ষ। অবশেষে গৃহবধূর শ্বশুর আত্মগোপন থেকে ফিরে ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় থানায় মামলা করেছেন। তবে গৃহবধূর স্বামী আত্মগোপনে। 

গুলিবিদ্ধ ওই গৃহবধূ কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের উথলি গ্রামের হাবিব প্রামাণিকের স্ত্রী। দুই সন্তান জননী তিনি। 

গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাত ১১টার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন ওই গৃহবধূ। স্বামীর পরিবারের লোকেরা অত্যন্ত গোপনে গৃহবধূকে প্রথমে পাংশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রেফার করা হয়। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানেই ২০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে তিনি চিকিৎসাধীন। গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান স্বামী হাবিব। তাঁর ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। 

এ ঘটনায় সোমবার (৩ জুন) খোকসা থানায় মামলা করেন আহত গৃহবধূর শ্বশুর আসলাম প্রামাণিক। আসামি করা হয়েছে দূর সম্পর্কের আত্মীয় আনিস শেখ নামের এক যুবককে। মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। তবে ওই ঘটনায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধার কারা যায়নি। তাঁর রিমান্ডও চাওয়া হয়নি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ গৃহবধূ রহিমা খাতুন একই উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের আমবাড়িয়া গ্রামের মৃত শামসুদ্দিনের মেয়ে। কয়েক বছর আগে মাও মারা গেছেন। তিনি বাবা–মায়ের একমাত্র সন্তান। প্রথম দফায় বাবার জমি বিক্রি করে স্বামী হাবিব সব টাকা নিয়ে নেন। আরও প্রায় ২০ লাখ টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে না দেওয়া নিয়ে রহিমাকে গুলি করা হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ। 

গৃহবধূর চাচি জেসমিন পারভিন জানান, তিন দিন আগে তাঁরা শোনেন, রহিমা গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। বারবার ফোন কল করেও নম্বর বন্ধ পার। গত রোববার সকালে রহিমার মৃত্যুর সংবাদ আসে। এরপর তাঁরা রহিমার শ্বশুরবাড়ি যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মেয়ে বেঁচে আছে। মেয়ের শাশুড়ির কাছে ফোন নম্বর নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি নম্বর না দিয়ে টালবাহানা করেন। কোথায় চিকিৎসা চলছে সে তথ্যও দেননি। পরে নম্বর জোগাড় করে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। মেয়ে জানিয়েছেন, তাঁকে গুলি করা হয়েছে। তিনি এখন ভালো আছেন। 

কে গুলি করেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেসমিন ঘাতকের নাম বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ে যেহেতু বেঁচে আছে তাই তার কাছ থেকে জানেন। সে অস্ত্রধারীকে চিনেছে।’ 

জেসমিন জানান, প্রায় ১০ বছর আগে হাবিবের সঙ্গে রহিমার বিয়ে হয়। একমাত্র সন্তান হওয়ায় মৃত্যুর আগে বাবা শামসুদ্দিন তাঁর বেশির ভাগ জমি বিক্রি করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা জামাতা হাবিবকে যৌতুক হিসেবে দেন। কিছুদিন পর শামসুদ্দিন মারা যান। এরপর হাবিব বাকি জমি বিক্রি করার জন্য রহিমার ওপর চাপ দিতে থাকেন। এ নিয়ে স্বামী–স্ত্রী বিরোধ চলছিল। 

মঙ্গলবার (৪ জুন) দুপুরে উথলি গ্রামে গিয়ে সর্বত্র গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা নিয়ে কানাঘুষা শোনা যায়। তবে কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না। গুলিবিদ্ধ গৃহবধূকে উদ্ধার ও চিকিৎসার জন্য নিয়েছিলেন প্রতিবেশী আব্দুল আজিজ। তিনি জানান, রাতে গুলির ঘটনার পর তিনি ঘটনাস্থলে যান। গৃহবধূর পিঠের বাম পাশের ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝরছিল। ওড়না দিয়ে বেঁধে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন। ফরিদপুর হাসপাতালে তাঁকে অক্সিজেন দিতে হয়। তবে এখন তিনি সুস্থ। ঘটনার সময় গৃহবধূর স্বামী হাবিব ঘটনাস্থলে ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেন আব্দুল আজিজ। 

দুপুরে হাবিবের বাড়িতে গিয়ে বড় মানুষ কাউকে পাওয়া যায়নি। মায়ের বিছানায় খেলা করছিল শিশু হুমাইয়া (৫) ও নোমান (৩)। তারা জানে না মা কোথায়। 
 
গৃহবধূর মেয়ে হুমাইয়া জানায়, সেদিন বাবা বাড়ি ফিরে মাকে মারে। এরপর তারা দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। এরপর সে ছোট চাচির ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। 

গৃহবধূর চাচা সাবেক সেনা সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, বাবার বাড়ির সব সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য কয়েক বছর ধরে রহিমা খাতুনের ওপর হাবিব চাপ দিয়ে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘মেয়ে হয়তো রাজি না হওয়ায় রাতের আঁধারে গুলি করা হয়েছে।’ 

মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে মামলা হয়েছে সেখানে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করা হয়েছে। রহিমা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দুই তিন দিন ঘটনাটি গোপন করা হলো, আমাদের খবর না দিয়ে চিকিৎসা করানো হলো—এর মধ্যে দুরভিসন্ধি থাকতে পারে।’ 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ গৃহবধূ রহিমা খাতুন সাগরিকা আজকের পত্রিকাকে ফোনে বলেন, ‘রাতে বাইরে ডেকে নিয়ে গুলি করেছে। মারার সময় ও (স্বামী) আর গোষ্ঠীর অনেক লোকজন ছিল। প্রথমেই আমাকে মারধর করে জমির কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। বাবার বাড়ি থেকে আনা ১ লাখ টাকাও নিয়ে নিয়েছে।’ 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কবির হোসেন জানান, মামলা তদন্তাধীন। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কথা বলবেন। আর বিস্তারিত কিছু তিনি বলতে চাননি। 

খোকসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আননুর যায়েদের কাছে জানতে চাইলে তিনি আজকের পত্রিকাকে জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। 

গ্রেপ্তার ব্যক্তিই গুলি করেছেন—এটি তিনি স্বীকার করেছেন কিনা জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আমরা তার কাছ থেকে কিছু তথ্য পেয়েছি। তা নিয়ে তদন্ত চলছে। ওই গৃহবধূ এখনো শঙ্কামুক্ত নন।’ স্বামী হাবিবের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘হয়তো স্ত্রীর চিকিৎসায় ব্যস্ত আছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত