আমীন আল রশীদ
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য দেড় শ সুপারিশ করেছে এ-সম্পর্কিত কমিশন—যেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সত্যিই একটা গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। যদিও কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া কঠিন।
বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় খুব বেশি ত্রুটি আছে, তা বলা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি নির্বাচনে রাজনৈতিক তথা ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপ—যার ফলে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, হয় না। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি দলীয় প্রতীক।
জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যে প্রভাব বিস্তার করে বা করতে পারে, সেটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা পলিটিক্যাল কালচারের সমস্যা। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নয়। কেননা, প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি করা যায়নি। যায়নি বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করতে হয়েছিল গণতন্ত্রকে পাহারা দেওয়ার জন্য। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধানটি বাতিল করে দেওয়ার পরে ২০১৪ থেকে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তার সবই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এটিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি বলার সুযোগ নেই। কেননা, এই ব্যবস্থাতেই সারা বিশ্বে ভোট হয়। কিন্তু তারপরও নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের সুপারিশ করেছে কমিশন। অবশ্য তারা সুপারিশ না করলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই ব্যবস্থাটি এখন সংবিধানে পুনরায় যুক্ত হওয়ার পথে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসময় উন্মুক্ত ছিল। অর্থাৎ দলীয় প্রতীক ছিল না। প্রার্থীদের অনেকের পেছনে দলীয় সমর্থন থাকলেও বা তাঁরা স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতা হলেও ভোট হতো নির্দলীয়। প্রার্থীদের পোস্টারে দলীয় শীর্ষ নেতার ছবি বা দলীয় প্রতীক থাকত না। ফলে যিনি যে দলের লোকই হোন না কেন, তিনি ভোট পেতেন মূলত ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।
বলাই হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ ও হানাহানি, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ভেতরে যে একটা অলিখিত সুসম্পর্ক ছিল, সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ। কেননা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী হতেও দলীয় নেতাদের মধ্যে এত বেশি প্রতিযোগিতা ও টাকার খেলা হয়েছে যে তার ফলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। মেয়র ও চেয়ারম্যান গ্রুপ এবং তার এক বা একাধিক গ্রুপ। তাতে করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে, যা ক্ষমতায় থাকার কারণে সে টের পায়নি। ৫ আগস্টের পরে নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছে যে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করে তারা নিজের কত বড় সর্বনাশ করেছে। শেষ দিকে আওয়ামী লীগ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল এবং কিছু কিছু জায়গায় দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছার ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগের মতোই উন্মুক্ত তথা নির্দলীয় প্রতীকে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু আইনটি বাতিল হয়নি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার সুপারিশ করেছে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেটি যে দলীয় প্রতীকে হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচন আদৌ এই সরকারের অধীনে হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনাও এ রকম ছিল। কিন্তু এই ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পুরোপুরি বিপরীতে। তারা কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, এ মুহূর্তে তাঁদের ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। তার মানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরে গঠিত সরকার যদি আইন পরিবর্তন করে আগের মতোই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার বিধান চালু না করে তাহলে যে ধরনের সংকট আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, তাদেরও সেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন। স্মরণ করা যেতে পারে, যখন ইভিএম চালু করা হয় তখন বলা হয়েছিল যে এটি তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। কেননা, এই সিস্টেমকে সরকারের বিরোধীপক্ষ বিশ্বাসে নেয়নি। তারা শুরু থেকেই এই মেশিনে ভোট ম্যানিপুলেট করার অভিযোগ এনেছে। যদিও সরকার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের অনেকেই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে এই মেশিনে কোনো ত্রুটি নেই বা চাইলেই মেশিনে কারসাজি করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও এটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এটার ওপর সব দলের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা যায়নি। একটি পদ্ধতি যতই ভালো হোক না কেন, সেটার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সেই পদ্ধতি চালু রাখা কঠিন।
নির্বাচনীব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সবচেয়ে বিপ্লবী বা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো, কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় ভোট গ্রহণ। কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ এই সুপারিশ করেছিলেন। কেননা, অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, মাত্র ৮-১০ শতাংশ ভোট পেয়েও একেকজন মেয়র হয়ে যাচ্ছেন। তার মানে ৯০ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট তাঁদের পক্ষে ছিল না। সুতরাং, যে ভোটে অন্তত মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট পড়বে না, তাতে ধরে নেওয়া হবে যে অধিকাংশ লোক ভোট চায় না। অতএব সেখানে পুনরায় ভোট হবে। এই ব্যবস্থাটি চালু করা গেলে প্রার্থীরা ভোটারদের প্রতি নমনীয় হবেন। তাঁদের কাছে যাবেন। তাঁদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে অনুরোধ করবেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচনী ব্যবস্থাটা এমন হয়েছিল যে প্রার্থীরা ভোটারদের আমলেই নিতেন না। এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান হতে তাঁদের ভোটও প্রয়োজন হতো না। কারণ, অনেক সময় একাধিক প্রার্থীই থাকত না। ফলে তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যেতেন। এই অদ্ভুত কালচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ন্যূনতম ভোটের বিধান করা জরুরি। তবে এটা ঠিক যে এই ইস্যুতে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন হবে।
কমিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা। রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎ, যোগ্য এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘না ভোটে’র বিধান ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও করেছে কমিশন। অর্থাৎ নির্বাচনে ‘না ভোট’ বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা।
এ রকম আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে কমিশন। কিছু সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। কিন্তু সেসব সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সরকারের পক্ষে সেটা করা কঠিন হবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে যে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রবল পরাক্রমশালী
দলের যে পতন হলো, তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। অতএব ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে এবং নির্বাচনগুলো যাতে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়, সে জন্য যে ধরনের সংস্কার ও পরিবর্তন লাগবে, সে বিষয়ে তাদের একমত হতে হবে। না হলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থাকবে।
আমীন আল রশীদ সাংবাদিক ও লেখক
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য দেড় শ সুপারিশ করেছে এ-সম্পর্কিত কমিশন—যেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সত্যিই একটা গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব। যদিও কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া কঠিন।
বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় খুব বেশি ত্রুটি আছে, তা বলা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি নির্বাচনে রাজনৈতিক তথা ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপ—যার ফলে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, হয় না। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রধান ত্রুটি দলীয় প্রতীক।
জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যে প্রভাব বিস্তার করে বা করতে পারে, সেটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তথা পলিটিক্যাল কালচারের সমস্যা। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নয়। কেননা, প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই ক্ষমতাসীন দলের অধীনেই বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি করা যায়নি। যায়নি বলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংবিধানে যুক্ত করতে হয়েছিল গণতন্ত্রকে পাহারা দেওয়ার জন্য। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধানটি বাতিল করে দেওয়ার পরে ২০১৪ থেকে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তার সবই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এটিকে নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি বলার সুযোগ নেই। কেননা, এই ব্যবস্থাতেই সারা বিশ্বে ভোট হয়। কিন্তু তারপরও নির্বাচনকালীন একটি দলনিরপেক্ষ সরকারের সুপারিশ করেছে কমিশন। অবশ্য তারা সুপারিশ না করলেও সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে এই ব্যবস্থাটি এখন সংবিধানে পুনরায় যুক্ত হওয়ার পথে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসময় উন্মুক্ত ছিল। অর্থাৎ দলীয় প্রতীক ছিল না। প্রার্থীদের অনেকের পেছনে দলীয় সমর্থন থাকলেও বা তাঁরা স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতা হলেও ভোট হতো নির্দলীয়। প্রার্থীদের পোস্টারে দলীয় শীর্ষ নেতার ছবি বা দলীয় প্রতীক থাকত না। ফলে যিনি যে দলের লোকই হোন না কেন, তিনি ভোট পেতেন মূলত ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণে। কিন্তু ২০১৫ সালে এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।
বলাই হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভেদ ও হানাহানি, বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ভেতরে যে একটা অলিখিত সুসম্পর্ক ছিল, সেটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্বয়ং আওয়ামী লীগ। কেননা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের প্রার্থী হতেও দলীয় নেতাদের মধ্যে এত বেশি প্রতিযোগিতা ও টাকার খেলা হয়েছে যে তার ফলে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। মেয়র ও চেয়ারম্যান গ্রুপ এবং তার এক বা একাধিক গ্রুপ। তাতে করে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়েছে, যা ক্ষমতায় থাকার কারণে সে টের পায়নি। ৫ আগস্টের পরে নিশ্চয়ই এখন বুঝতে পারছে যে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করে তারা নিজের কত বড় সর্বনাশ করেছে। শেষ দিকে আওয়ামী লীগ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল এবং কিছু কিছু জায়গায় দলীয় কোন্দল চরমে পৌঁছার ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগের মতোই উন্মুক্ত তথা নির্দলীয় প্রতীকে করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু আইনটি বাতিল হয়নি।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করার সুপারিশ করেছে এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে সেটি যে দলীয় প্রতীকে হবে না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচন আদৌ এই সরকারের অধীনে হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবনাও এ রকম ছিল। কিন্তু এই ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পুরোপুরি বিপরীতে। তারা কোনোভাবেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, এ মুহূর্তে তাঁদের ফোকাস জাতীয় নির্বাচন। তার মানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হচ্ছে না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের পরে গঠিত সরকার যদি আইন পরিবর্তন করে আগের মতোই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় করার বিধান চালু না করে তাহলে যে ধরনের সংকট আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে, তাদেরও সেই একই পরিণতি বরণ করতে হবে।
নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিধান বাতিলের সুপারিশ করেছে কমিশন। স্মরণ করা যেতে পারে, যখন ইভিএম চালু করা হয় তখন বলা হয়েছিল যে এটি তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। কেননা, এই সিস্টেমকে সরকারের বিরোধীপক্ষ বিশ্বাসে নেয়নি। তারা শুরু থেকেই এই মেশিনে ভোট ম্যানিপুলেট করার অভিযোগ এনেছে। যদিও সরকার ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের অনেকেই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে এই মেশিনে কোনো ত্রুটি নেই বা চাইলেই মেশিনে কারসাজি করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও এটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এটার ওপর সব দলের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা যায়নি। একটি পদ্ধতি যতই ভালো হোক না কেন, সেটার বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সেই পদ্ধতি চালু রাখা কঠিন।
নির্বাচনীব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সবচেয়ে বিপ্লবী বা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো, কোনো আসনে মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় ভোট গ্রহণ। কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ এই সুপারিশ করেছিলেন। কেননা, অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, মাত্র ৮-১০ শতাংশ ভোট পেয়েও একেকজন মেয়র হয়ে যাচ্ছেন। তার মানে ৯০ শতাংশ ভোটারের ম্যান্ডেট তাঁদের পক্ষে ছিল না। সুতরাং, যে ভোটে অন্তত মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ ভোট পড়বে না, তাতে ধরে নেওয়া হবে যে অধিকাংশ লোক ভোট চায় না। অতএব সেখানে পুনরায় ভোট হবে। এই ব্যবস্থাটি চালু করা গেলে প্রার্থীরা ভোটারদের প্রতি নমনীয় হবেন। তাঁদের কাছে যাবেন। তাঁদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে অনুরোধ করবেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নির্বাচনী ব্যবস্থাটা এমন হয়েছিল যে প্রার্থীরা ভোটারদের আমলেই নিতেন না। এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান হতে তাঁদের ভোটও প্রয়োজন হতো না। কারণ, অনেক সময় একাধিক প্রার্থীই থাকত না। ফলে তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যেতেন। এই অদ্ভুত কালচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ন্যূনতম ভোটের বিধান করা জরুরি। তবে এটা ঠিক যে এই ইস্যুতে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্য গড়ে তোলা কঠিন হবে।
কমিশনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন বন্ধ করা। রাজনৈতিক দলগুলোকে সৎ, যোগ্য এবং ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দেওয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘না ভোটে’র বিধান ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও করেছে কমিশন। অর্থাৎ নির্বাচনে ‘না ভোট’ বিজয়ী হলে সেই নির্বাচন বাতিল করা এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাতিলকৃত নির্বাচনের কোনো প্রার্থী নতুন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারার বিধান করা।
এ রকম আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে কমিশন। কিছু সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। কিন্তু সেসব সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে সরকারের পক্ষে সেটা করা কঠিন হবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে যে আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রবল পরাক্রমশালী
দলের যে পতন হলো, তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া। অতএব ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচন নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে এবং নির্বাচনগুলো যাতে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়, সে জন্য যে ধরনের সংস্কার ও পরিবর্তন লাগবে, সে বিষয়ে তাদের একমত হতে হবে। না হলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থাকবে।
আমীন আল রশীদ সাংবাদিক ও লেখক
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্ট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। দীর্ঘ সময় তিনি জাতীয় স্বার্থে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির অন্যতম সংগঠক।
২ ঘণ্টা আগেরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও ফরিদপুরের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী খায়রুজ্জামান খাজার কর্মকাণ্ডের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে সাবেক মন্ত্রী আবদুর রহমানের কাছের লোক ছিলেন। এখন হয়েছেন যুবদল নেতা। ফলে তাঁর দাপট সমানতালে চলছে। এ নিয়ে ১৫ জানুয়ারি আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
৩ ঘণ্টা আগে‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!’ এটি একটি প্রবাদ বাক্য। আমরা অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বোঝাতে গিয়ে প্রবাদ বাক্য ব্যবহার করে থাকি। যে বাক্য বা উক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে এবং রূপক আকারে বিশেষ অর্থ বহন করে, যার মাঝে কোনো বাস্তব সত্য নিহিত রয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে লোকের মুখে মুখে চলে আসছে, তাকেই আমরা প্রবাদ...
১ দিন আগেটানাপোড়েন যে একটা সৃষ্টি হবে, সে ইঙ্গিত শুরু থেকেই ছিল। সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় এখন তা স্পষ্টতর হয়েছে। মূল প্রতিপাদ্য একটাই। সংস্কার করে জাতীয় নির্বাচন, নাকি জাতীয় নির্বাচনের পরে সংস্কার? যদি সংস্কার করে নির্বাচন হয়, তাহলে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করার পরে নির্বাচন...
১ দিন আগে