বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর বিনোদনের প্রধান উৎস গেমস

জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩: ৪২
আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩: ৫৭

২১ বছর বয়সী নিহাদ (ছদ্মনাম) নিজ কক্ষে সারা দিন একাকী থাকার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি প্রতি নিদ চার থেকে ছয় ঘণ্টা মোবাইলে গেমস খেলেন। এতে তার মানসিকভাবে বিষণ্ন সময় কাটে। যার কারণে ইদানীং চোখে ঝাপসা দেখা ও মাথা ব্যথার মতো সমস্যাগুলো নিয়মিত অনুভব করছেন নিহাদ। বলছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছাত্রের কথা।

নিহাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের মাঝে মোবাইল গেমস আসক্তি ও এর ক্ষতিকর প্রভাব আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ১২৫ জন শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফলে এমন তথ্য জানা যায়। এতে দেখা যায়, ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্ররা ১ দশমিক ৩ গুন বেশি মোবাইল গেমসে আসক্ত। এ ছাড়া গবেষণায় অংশগ্রহণ করা পুরুষ শিক্ষার্থীদের ৫৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছাত্র মাঝারি এবং ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ ছাত্র তীব্রভাবে মোবাইল গেমসে আসক্ত। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের ৬৫ দশমিক ২ শতাংশ তাঁদের বিনোদনের প্রধান উৎস হিসেবে গেমস খেলেন।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির।

গত ৬ই সেপ্টেম্বর ‘প্রিভ্যালেন্স অ্যান্ড আন্ডারলায়িং ফ্যাক্টরস অব মোবাইল গেম অ্যাডিকশন এমং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক নিবন্ধটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ’ জার্নালের অষ্টম ভলিউমের অন্তর্ভুক্ত।

গবেষণাটি পরিচালনা করেন জাবি পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন, ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সাব্বির রহমান রাসেল এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবরার আহামেদ হাবিবউল্লাহ। 

গবেষক আবু সাঈদ বলেন, ‘বর্তমান প্রযুক্তির কল্যাণে দেশের কিশোর ও তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে উন্নতমানের স্মার্টফোন সহজলভ্য। আমাদের এই গবেষণার উদ্দেশ্যে, স্মার্টফোন ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা কীভাবে গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে এবং এর প্রভাবে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পরিবর্তন গুলো চিহ্নিত করা।’ 

সাব্বির রহমান রাসেল বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের স্বনামধন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার ১২৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে অনলাইন জরিপ পরিচালনা করি। যেখানে ৭৭৭ জন ছাত্র ও ৩৪৮ জন ছাত্রী ছিলেন। তাদের গড় বয়স ছিল ২২ দশমিক ৪ বছর। তাদের মাঝে আসক্তির মাত্রা মূল্যায়নের জন্য Lemmens game addiction scale (2009) ব্যবহার করা হয়েছে।’ 

আবরার আহামেদ হাবিবউল্লাহ বলেন, ‘আমাদের গবেষণাটি আসক্তির মাত্রা অনুযায়ী তিনটি ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীদের ভাগ করা। এতে হালকা, মাঝারি ও তীব্র আসক্তি অনুসারে শিক্ষার্থীদের আসক্তিকরণের প্রভাবকসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়।’ 

গবেষণাতে উল্লেখ করা হয়, ‘৬৫ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর বিনোদনের প্রধান মাধ্যম গেমস। যাদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ মাঝারি ও ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী তীব্রভাবে আসক্ত। ছাত্রীরা ছাত্রদের তুলনায় তীব্র আসক্তির ঝুঁকিতে কম রয়েছে। সদ্য ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবর্ষের শেষ দিকের শিক্ষার্থীদের আসক্তির মাত্রা বেশি থাকে। এ ছাড়া তদূর্ধ্ব-২৫ বছরের শিক্ষার্থীদের ৫১ দশমিক ৯ শতাংশ তীব্র আসক্তির লক্ষণ প্রকাশ করেছে। যেখানে ২২ বছরের কম বয়সীরা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যবর্তী ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মাঝারি ধরনের আসক্তি প্রকাশ করেছে।’ 

গবেষণায় বলা হয়, ‘আসক্তি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ গেম খেলার স্থায়িত্ব। যারা দৈনিক ৪ ঘণ্টার বেশি গেমস খেলে তাঁদের প্রতি ১০ জনের ৬ জন শিক্ষার্থী তীব্রভাবে মোবাইল গেমসে আসক্ত, এবং দৈনিক ২ থেকে ৪ ঘণ্টা গেমস খেলে এমন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রতি ৫ জনে ১ জন শিক্ষার্থী তীব্র ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে।’ 

উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘আসক্তি বৃদ্ধির প্রভাবক গুলির মধ্যে একাকিত্ববোধ অন্যতম। শিক্ষার্থীরা যখন বন্ধু-বান্ধব, পরিবার ও সামাজিক মেলামেশা থেকে বিচ্ছিন্ন তখন মোবাইল গেমসের প্রতি আসক্তি ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।’ 

গবেষণায় জানা যায়, ‘যেসব শিক্ষার্থীরা অল্প বয়সে স্মার্টফোন ব্যবহার শুরু করেছে, তাঁদের গেমসের প্রতি আসক্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহারের সময়কাল যত বেশি হয়, আসক্তির মাত্রাও বাড়তে থাকে।’ 

নিবন্ধে সচেতন করা হয়, ‘মাত্রাতিরিক্ত গেম খেলার সাথে শারীরিক সমস্যা যেমন, চোখে ঝাপসা দেখা, চোখ ও কানের অস্বস্তি অনুভূত হওয়া এবং মাথা ব্যথার সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে। তীব্র আসক্ত ৩২ শতাংশ শিক্ষার্থীরা মাথা ব্যথা ও কানের অস্বস্তিবোধ জনিত সমস্যায় ভোগে এবং মাঝারি আসক্তির ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থীরা ঝাপসা দেখা ও চোখের অস্বস্তি জনিত সমস্যায় ভোগে।’ 

তবে গবেষণায় জানা যায়, মোবাইল গেমসে আসক্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। 

সহযোগী অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাধারণত একাকিত্ব বোধের কারণে শিক্ষার্থীদের মোবাইল গেমিংস প্ররোচিত করে। এ জন্য বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, পরিবারের সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী হবে শিক্ষার্থীদের শারীরিক খেলাধুলা ও পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রম। ফলে একাকিত্ব তথা আসক্তির মাত্রা অনেকাংশে কমে আসবে এবং বিনোদনের প্রধান উৎস হিসেবে মোবাইল ফোন পরিত্যাগ করতে হবে। এ জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত একটি সুস্থ বিনোদন মাধ্যমের ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের তাতে আগ্রহী করে তোলা।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত