বিজ্ঞানশিক্ষা কেন জরুরি

মুহাম্মাদ শাওন মাহমুদ
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩, ০৮: ৩৪

মানবসভ্যতার শুরুর দিকে পৃথিবী ছিল অপার বিস্ময় ও রহস্যের স্থান। সে পৃথিবীকে মানুষ হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। প্রাচীনকালে জীবনযাপনের একপর্যায়ে মানুষ পাথরে পাথর ঘষে আগুন আবিষ্কার এবং পশুশিকারের জন্য অস্ত্র হিসেবে গাছের ডাল ও পাথর ব্যবহার করতে শেখে। তখন থেকেই শুরু হয় বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা। তার পর থেকে মানুষ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হয়ে উঠতে থাকে। আর এই নেশার মূলে ছিল ভৌত ও বাস্তব বিশ্বের সমস্যা সমাধান। ধাপে ধাপে এই বিজ্ঞানই হয়ে ওঠে ‘গ্লোবাল কোলাবোরেশন’, ক্ষমতা এবং বিশ্বে টিকে থাকা তথা নিরাপত্তার মূলসূত্র। বিজ্ঞানশিক্ষা কেন জরুরি, এই প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা যাক—

গ্লোবাল কোলাবোরেশন ও নিরাপত্তা
‘মাইক্রোচিপ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। প্রথম মাইক্রোচিপ ব্যবহার করে কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছিল উনিশ শ ষাটের দশকে। তারপর অসংখ্য প্রযুক্তি কোম্পানি মাইক্রোচিপের ব্যবহার শুরু করলেও এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটায় ‘ইনটেল’। ১৯৭১ সালে তারা মাইক্রোচিপকে মাইক্রোপ্রসেসর আকারে প্রথম বাজারে নিয়ে আসে। তার পর থেকেই মানুষ বুঝতে পারে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের ক্ষমতা কতটুকু। ইনটেলের সেই প্রথম মাইক্রোপ্রসেসরটি ছিল Intel 4004, যা ব্যবহার করে মানুষ প্রথমবার চাঁদে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। এর জনক আমেরিকান হলেও ধীরে ধীরে মাইক্রোপ্রসেসর উৎপাদন এশিয়া মহাদেশে চলে আসে। বর্তমানে বিশ্বের ৭৫ ভাগ রেগুলার মাইক্রোপ্রসেসর এবং ৯২ ভাগ ‘হাই-ইন্ড’ মাইক্রোপ্রসেসর (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যাশনাল সিকিউরিটি, ফাইটার জেটে ব্যবহৃত মাইক্রোপ্রসেসর) তৈরি করছে তাইওয়ান (টিএসএমসি)। বাকি বাজার ধরে রেখেছে নোকিয়া, এনভিডিয়া, ইনটেল ইত্যাদি। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তাইওয়ানের মাইক্রোচিপ ব্যবহার করে যেমন অন্যান্য দেশের ইলেকট্রনিকস উৎপাদন শিল্প টিকে আছে, ঠিক তেমনি এই পণ্যগুলো উৎপাদন করে তাইওয়ান নিজেও পুরো বিশ্বে নিজের অস্তিত্বকে নিরাপদ রেখেছে। যত দিন তাইওয়ান তার এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অটল থাকবে, তত দিন সে বহির্বিশ্বের আক্রমণ থেকে মুক্ত। চাঁদে নিয়ে যাওয়া সেই মাইক্রোপ্রসেসর Intel 4004

ভেবে দেখুন, একটা রাষ্ট্র বহিঃআক্রমণ থেকে কতটুকু নিরাপদ থাকবে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে তার কতটুকু কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় থাকবে, তা নির্ভর করছে দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কতটুকু স্বশিক্ষিত। হাই-ইন্ড মাইক্রোপ্রসেসর থেকে ম্যাসিভ স্পেস ইনস্ট্রুমেন্ট যখন বাংলাদেশে তৈরি হবে, তখনই বাংলাদেশ শীর্ষ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারবে। আর সে জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিজ্ঞানশিক্ষা।

জীবনমান উন্নয়নে জ্ঞানের অগ্রগতি
ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস কেন হয়, ভূমিকম্প কীভাবে হয়, নদীর জল কোথা থেকে কোথায় গড়াবে—এ ধরনের প্রাকৃতিক চরিত্র সম্পর্কে যেমন বিজ্ঞানই আমাদের শেখায়, তেমনি প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচার রাস্তাটিও সেই বিজ্ঞানই বাতলে দেয়। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে উপ-পারমাণবিক কণা থেকে জল-স্থল পেরিয়ে জয় করেছে অন্তরিক্ষ! শিখেছে কীভাবে মহাশূন্যে টিকে থাকা যায়। শিখেছে দেহের ভেতর প্রয়োজনে ন্যানো-রোবট পাঠিয়ে কীভাবে ক্যানসার কোষ খুঁজে বের করা যায়। বিজ্ঞান গবেষণা এবং ছোট-বড় আবিষ্কার প্রতিনিয়ত আমাদের ধারণা দিচ্ছে। একটি ন্যাচারাল ঘটনা কীভাবে সামলাতে হয় অর্থাৎ একটি নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে জীবনযাত্রার মান কী করে আরও সমৃদ্ধ করা যায়। এ ব্যাপারে যাঁদের বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান নেই, তাঁদের সাহায্য করতে পারে পপুলার বিজ্ঞানের সংগঠন ‘বিজ্ঞানপ্রিয়’ (facebook.com/bigyanpriyo)।

বাস্তবমুখী সমস্যার সমাধান
বিশ্বে প্রতিবছর প্রতি ছয়টি মৃত্যুর একটি হয় ক্যানসারের কারণে। ক্যানসারের বহু চিকিৎসা প্রচলিত আছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো দেহের ঠিক কোথায় ক্যানসার কোষ রয়েছে, খুঁজে বের করা। বিজ্ঞানের ঘাড়ে বসেই প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতির তালাশ করছি আমরা। বাস্তবমুখী সমস্যাগুলোর সমাধান কেবল বিজ্ঞানই দিতে পারে। যেমন, একদা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলেই মানুষ মারা যেত। এখন তা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত। একসময় কেবল মাটিতেই ফসল চাষ হতো, ভূমিস্বল্পতায় এখন উদ্ভাবিত হয়েছে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। এককথায়, নানা সম্পাদ্যের সমাধান করে মানবসভ্যতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান। 

কুসংস্কারের গতি আলোর চেয়েও বেশি
জন্ডিস রোগটির তেমন কোনো চিকিৎসা নেই। আপনা-আপনি হয়ে আপনা-আপনিই ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসকেরাও তেমন কোনো ওষুধ দেন না। অথচ এই সুযোগের অপব্যবহার করে ‘হাত-ধোয়া’ নামের চিকিৎসার ডালা নিয়ে বসে আছেন অসংখ্য ফকির-কবিরাজ। আজ বিজ্ঞান যদি ওপরের তথ্যটি না জানাত, তবে এই ঠগবাজ কবিরাজেরাই হতো একমাত্র ভরসা। যুগে যুগে অপবিজ্ঞান, অপসাংস্কৃতিক উত্থাপন, মনের সংকীর্ণতা ও ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়ে সত্যের সন্ধান দিয়ে এসেছে বিজ্ঞান। একটা সময় পৃথিবীকে মনে করা হতো সমুদয় মহাবিশ্বের কেন্দ্র। এই তথ্যের সত্যতা তুলে ধরতে গিয়ে আজীবন গৃহবন্দী থেকে মৃত্যুবরণ করলেন গ্যালিলিও গ্যালেলি। কিন্তু কোপার্নিকাস প্রচলিত ধারণার বিপরীতে গিয়ে প্রমাণ করে ছাড়লেন, পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয়, বরং সামান্য একটা হ্যাভিটেবল গ্রহ মাত্র। এভাবেই যাঁরা যুক্তিবাদী ও বিচারবোধসম্পন্ন হয়ে বিজ্ঞানশিক্ষা অর্জন করছেন, তাঁরাই মানুষের অজ্ঞতা দূর করে কোনো ঘটনা বা সমস্যার প্রকৃত কারণ জানতে সচেষ্ট হয়েছেন। কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বিজ্ঞানশিক্ষার বিকল্প নেই।

কর্মসংস্থান ও ক্যারিয়ার
যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান রয়েছে কোন সেক্টরে? উত্তর হবে, কৃষি এবং টেকনিক্যাল সেক্টরগুলোতে। দুটোই বিজ্ঞানের অঙ্গ। বিজ্ঞানকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, হিসাবব্যবস্থা। মহাকাশ গবেষণা, স্পেসক্র্যাফট, মেডিসিন, কম্পিউটার, চাষাবাদ, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল, ডিজাইনসহ বিজ্ঞানের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা রয়েছে, যেখানে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান সুষম হারে তৈরি হচ্ছে। এদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিরাচরিত এই কর্মসংস্থানের জন্য হুমকি হলেও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই বৃহৎ এক কর্মসংস্থানের ঝুলি নিয়ে হাজির হচ্ছে। 

বিজ্ঞানেরও আছে সীমাবদ্ধতা!
বিজ্ঞানেরও আবার ‘লিমিটেশন’ আছে নাকি? হ্যাঁ, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, নৈতিক বিবেচ্য বিষয়াদি, জ্ঞানের পরিধি, প্রাকৃতিক জটিলতা ইত্যাদি প্যারামিটার বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। যেমন, প্রযুক্তি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে; কিন্তু এখনো কিছু প্রশ্ন রয়েছে, যা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে উত্তর দেওয়া যায় না। আবার, নৈতিক বিবেচনার কারণে একজন বিজ্ঞানী চাইলেই মানুষের দেহ বা অন্য প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালাতে পারেন না। অনুমোদনই নেই। তা ছাড়া প্রাকৃতিক বিশ্ব অবিশ্বাস্যভাবে জটিল। অসংখ্য ফ্যাক্টর রয়েছে, যা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলকে প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। সব ভ্যারিয়েবল নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অনেক সময়ই কঠিন হয়ে পড়ে। যার কারণে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার সংখ্যাই বেশি। তবে এই ব্যর্থতার যাত্রাটাও অত্যন্ত উপভোগ্য। বিজ্ঞানে ব্যর্থ হতে গেলেও বিজ্ঞানশিক্ষা জরুরি। বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে হলেও, বিজ্ঞানশিক্ষার বিকল্প নেই। জীবনে বিজ্ঞানকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমরা একদম কিছু না জেনেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদগুলো ব্যবহার করতে পারি। আজকের বিজ্ঞান যখন কালকের প্রযুক্তি হয়ে আসবে, আকাশ থেকে পড়ব। বিজ্ঞানশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন কখনো বাস্তবায়িত হবে না। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবটি ছিল ডিজিটাল বিপ্লব। এখন অপেক্ষা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এ দেশের বিজ্ঞানশিক্ষায় অধিক পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ, জনসচেতনতা, সেই সঙ্গে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।

মুহাম্মাদ শাওন মাহমুদ, প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞানপ্রিয় (জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২২ বিজয়ী)

অনুলিখন: মো. আশিকুর রহমান

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত