ক্যাম্পাসে পরিচিত এক মা

মাসুদুর রহমান মাসুদ, ঝিকরগাছা (যশোর) 
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৩, ০৮: ৪৫
আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯: ১৭

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) মূল ফটক পেরিয়ে মোটরযানটি থামাতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘উপাচার্য স্যারের কাছে যাবেন?’ ‘না’, বলতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাকে খুঁজছেন?’ ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তামান্না পড়েন না?’ এতটুকু উচ্চারণ করতেই তিনি বললেন, ‘ও, তামান্না আপুকে খুঁজছেন? ওনার মা আপুকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসেন।

ভেতরের বিল্ডিংয়ে তাঁদের ক্লাস হয়।’ মোটরসাইকেল থেকে নেমে তামান্নাদের বাসার ঠিকানা জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ বলে দিলেন সব। এ-ও জানালেন, ক্যাম্পাসে তামান্না ও তাঁর মাকে সবাই চেনে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ইংরেজি বিভাগে পড়েন তামান্না আক্তার নুরা। এবার প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিক ভবনের সামনে পথে হুইলচেয়ারে বসে আছেন তামান্না। পেছন থেকে হুইলচেয়ারটি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মা। এটি ক্যাম্পাসের প্রতিদিনের দৃশ্য। এই দৃশ্য ক্যাম্পাসে তামান্নার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মাকেও পরিচিত করে তুলেছে। এরপর স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হুইলচেয়ারে বসা তামান্না ও তাঁর মায়ের সঙ্গে নানান কথায় মেতে উঠলাম।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার আলীপুর গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পীর মেয়ে তামান্না নুরা। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। জন্মগতভাবেই তাঁর দুই হাত ও ডান পা নেই। বাঁ পা দিয়ে লিখেই তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে প্রাতিষ্ঠানিক সব পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেছেন। এরপর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। যবিপ্রবির গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে তামান্না মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু মাইক্রোবায়োলজিতে যেহেতু ব্যবহারিক ক্লাস করতে হবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই, তাই উপাচার্যের পরামর্শে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন।

ক্যাম্পাসের বিশাল মাঠের দূর্বা ঘাসের ওপর বসা কিংবা সহপাঠীদের হাত ধরে কখনো ঘোরাঘুরি করা হয়নি তামান্নার। সেই অপূর্ণতা দূর করেছেন তাঁর মা খাদিজা পারভীন শিল্পী। তিনি তামান্নাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ান।

সহপাঠী ইসরাত জাহান চাঁদনী বলেন, ‘তামান্নাকে ক্যাম্পাসে আনা-নেওয়া ওর মা-ই করেন। আমরা অনেক সময় ক্লাসে ওকে সাহায্য করি। ওকে নিয়ে অন্যদের মতো আমরা সবাই আনন্দ-উল্লাস করি।’ আরেক সহপাঠী শাফাত হোসেন মাসুম জানান, বন্ধুরা তামান্নাকে লিফটে চারতলা থেকে পাঁচতলায় ওঠানামায় সহযোগিতা করলেও মূলত তাঁর মা ক্যাম্পাসে তাঁকে নিয়ে আসেন। ক্লাস শেষে নিয়ে যান।

মেধাবী তামান্নার এইচএসসিসহ সব পরীক্ষার সাফল্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোঁজখবর নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন তিনি। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। সেখানকার প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনের তত্ত্বাবধানে তাঁকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করানো হয়।

তামান্নার মা খাদিজা পারভীন শিল্পী বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বা চলাফেরার সুযোগ হয়নি আমার। কিন্তু তামান্নাকে নিয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেতে পারি। এটা ভালো লাগে। তামান্নার বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগে আমরা খুশি।’ 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত