‘রানওয়ে’-র রুহুলের স্মৃতিতে তারেক মাসুদ

ফজলুল হক, অভিনেতা
Thumbnail image

সিনেমার শেষ দৃশ্য চলছে। হল ভর্তি দর্শক। আমি একেবারে পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখছেন। সিনেমা শেষে মুহুর্মুহু করতালিতে গোটা হল ভেঙে পড়ছে। দর্শকদের ভালো লাগা, সত্যিই দেখার মতো একটি দৃশ্য। পরিচালক তারেক মাসুদ মঞ্চে উঠে এলেন। উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন, এতক্ষণ আপনারা যে সিনেমা দেখলেন, এর নায়কের সাথে পরিচিত হবেন না? গোটা হল জুড়ে আওয়াজ উঠলো, হ্যাঁ।

তারেক ভাই মঞ্চ থেকে ইশারায় আমাকে ডাকলেন, সামনে চলে এসো। তারেক ভাইয়ের ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমাকে দেখার জন্য সকলে পেছনে ফিরে তাকালেন।

আমি একদম পেছন থেকে এগিয়ে যাচ্ছি মঞ্চের দিকে। আশপাশ থেকে তুমুল করতালি। কেউ কেউ অন্যদের থেকে মাথা ডানে-বায়ে সরিয়ে আমাকে দেখছেন। আঙুলের ইশারায় আমাকে চিনিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। মোবাইলে ছবি তুলে নিচ্ছেন অনেকে। এগিয়ে যাওয়ার সময় দু-পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে অনেকে হাত মিলাচ্ছেন আমার সাথে। ঠিক এই মুহুর্তে আমি যেন এক মস্ত বড় রাজা! সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে আমার। আমি মঞ্চে উঠলাম।

শুটিংয়ে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদতারেক ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে, ‘এই হচ্ছে আমাদের রুহুল (রানওয়ে চলচ্চিত্রে আমার নাম রুহুল ছিল)। এখন আরেকটি শো শুরু হবে। আপনারা যদি কেউ আমাদের সাথে কথা বলতে চান, আপনাদের যদি কোনো জিজ্ঞাসা থাকে, প্রশ্ন থাকে, কোনো পরামর্শ বা অনুভূতি প্রকাশ চান, আমরা বাইরে আছি।’

বেরিয়ে এলাম তারেক ভাইয়ের সাথে। দর্শকদের মধ্যে অনেকে ঘিরে ধরলেন আমাকে। ছবি তুলবেন একসাথে। অটোগ্রাফ চাইলেন আমার। জীবনে প্রথম অটোগ্রাফ দিয়ে চলেছি। এই আনন্দ লেখায় কিছুতেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

অবশ্যই আমার এ সফলতার পেছনে তারেক ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। আমি মহাসৌভাগ্যবান যে, তারেক ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলাম।

‘রানওয়ে’-র অডিশনের গল্প আমি অনেকবার বলেছি, আজ না হয় শুটিংয়ের কিছু কথা বলি। আমাদের শুটিং হতো অত্যন্ত সাবলীল ছন্দে। কোনো তাড়াহুড়া ছিল না। পরদিন কোন কোন দৃশ্যের শুটিং হবে, সেটি সম্ভাব্য কত সময়জুড়ে হতে পারে— তেমন একটি লিস্ট পেয়ে যেতাম আগের দিনই।

আরেকটি বিষয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সারাদিন জুড়ে শুটিং হতো না। যেদিন খুব ভোর থেকে শুটিং শুরু হতো, সেদিন দেখা যেত— বিকেল কিংবা সন্ধ্যার আগেই শুটিং শেষ। আর যেদিন রাতের দৃশ্য থাকতো, সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুটিং শুরু হতো। এভাবে অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে শুটিং করেছি। উপভোগ করেছি।

আমার দেখা তারেক মাসুদ একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। কেউ তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, কথা বলতে চেয়েছেন, অথচ তিনি তাকে অবজ্ঞা করেছেন, সময় দেন নি, এমনটি কখনো হয়নি।

‘রানওয়ে’ সিনেমার শুটিংয়ের প্রস্তুতিঅনেক বড় নির্মাতা বা চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে শুরু করে একদম নবীন নির্মাতা বা নির্মাণে আগ্রহী ব্যক্তির সাথেও তিনি তাঁর মূল্যবান সময় শেয়ার করেছেন অকপটে। দিগন্ত বিস্তৃত হাসিমুখের এই মানুষটির মধ্যে অহংকার বা আত্নগরিমা ছিল না। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার চলচ্চিত্রপ্রেমী।

শুটিং চলাকালীন লোকেশনে তারেক ভাইকে দেখে মনে হতো একজন মহারাজা। তিনি যখন হেঁটে বেড়াতেন, সকলে তটস্থ হয়ে থাকত। নিজ নিজ কাজের প্রতি প্রত্যেকের মনযোগ শতভাগ থাকত তখন। তিনি যে কাউকে বকাঝকা করে কথা বলেছেন এমনটি নয়, তাঁর মুখ থেকে একটি অকথ্য শব্দও আমি কখনো শুনিনি।

তাঁকে সবাই যতটা না ভয় পেত, বরং তার চেয়ে বেশি সম্মানে বিনয়ে অবনত হয়ে থাকত। শুটিংয়ের প্রতিটি বিভাগের কাজই তিনি বুঝতেন। ক্যামেরা, লাইট, আর্ট, মেকআপ, সাউন্ড, অভিনয়— সব তিনি পর্যবেক্ষণ করতেন নিবিড়ভাবে। প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকা আমি, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অবাক হয়ে দেখতাম।

তারেক মাসুদশুটিংয়ের মজার একটা ঘটনা বলি। কয়েকটা দিন বিরতি পেয়েছি। অলসভাবে ঘুরেফিরে দিন কাটছিল। দাড়ি-গোঁফ বড় হয়ে যাচ্ছিল। কেমন যেন নিজের কাছে বেখাপ্পা লাগছিল নিজেকে। ভাবলাম, কাঁচি চালিয়ে হালকা একটু ছোট করে ফেলি। আয়না হাতে নিয়ে কাঁচি দিয়ে গোঁফটা একটু ছোট করে ফেললাম। মাথাটা ভালো করে ডানে-বায়ে ঘুরিয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখি অন্য এক পাশের তুলনায় আরেকপাশ সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। আবার একটু কেটেকুটে মিলানোর চেষ্টা করলাম।

অনভিজ্ঞ হাতে এবারও ভুল হলো। যে পাশ ছোট করলাম, তা আরেক পাশের তুলনায় সামান্য একটু ছোট হয়ে গেছে। এই মিলকরণের খেলা শেষে আয়নায় যখন নিজের চেহারা দেখলাম, নিজেই আঁতকে উঠলাম! একি! গোঁফ অনেক ছোট হয়ে গেছে। এখন যদি শুটিংয়ের কল এসে পড়ে তখন উপায়!

তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম তারেক ভাইয়ের অফিসে (তখন মোহাম্মদপুর বাবর রোডে অফিস ছিল)। অফিসে উপস্থিত ছিলেন সহকারী পরিচালক। তিনি আদ্যোপান্ত দেখে এবং শুনে চোখ ছানাবড়া করে ফেললেন। জানলাম যে আগামীকাল শুটিং। আমাকে কল দেয়া হতো এখনই।

শুটিংয়ে তারেক মাসুদকালবিলম্ব না করে আমাকে পাঠালেন তারেক ভাইয়ের বাসায়। তারেক ভাইয়ের গাড়ি অফিসে ছিল। সেটিতে করেই তাঁর বাসায় চলে এলাম। মনে মনে দোয়া যতগুলো পারি পড়া শুরু করেছি। তারেক ভাই কি যে বলবেন আজকে! কি দরকার ছিলো এত চালাকি করার!

উৎকন্ঠা নিয়ে তারেক ভাইয়ের বাসায় পৌঁছুলাম। দরজা খুললেন তারেক ভাই নিজেই। আমাকে দেখে তিনি তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর খুব শান্ত গলায় বললেন, এসো ভিতরে এসো। কোন উচ্চবাচ্য না, কড়া কথা না, কটু কথা না, এতো শান্তভাবে তিনি বললেন যে প্রাণ ফিরে পেলাম। এই হলেন তারেক মাসুদ। তিনি জানেন কীভাবে নিজেকে শান্তু ও অবিচল রাখতে হয়। পরের দিন ঠিকই শুটিং করেছিলাম আমরা। ওই অবস্থাতেই।

পিতৃতুল্য তারেক মাসুদকে আমি কী ভীষণ অনুভব করি, তা বোঝাতে পারবো না কোনোদিনই। তিনি আমার সুখ-দুঃখ সব সময়ে পিতার মতোই পাশে ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়েছেন। সেই দিনের কথাটি আমার এখনও মনে পড়ে। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছি। সমালোচকদের ভোটে সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া আমার জন্য দারুণ একটি অর্জন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দিন আমার পাশে ছিলেন তারেক মাসুদ, ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ ও ‘রানওয়ে’-তে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা মনি আপা।

‘রানওয়ে’ সিনেমার দৃশ্যআমরা অপেক্ষা করছি। নাম ঘোষণা করা হচ্ছে একেকটি ক্যাটাগরিতে। সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে আমি পুরস্কারটি পাই নি। মন খারাপ হয়ে গেল। তারেক ভাই আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, মন খারাপ করো না। এতো অল্প সময়ে অনেকে এতদূর পর্যন্ত আসতেও পারে না। তুমি সেরা চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়েছ, এটি কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। সামনে অনেক পথ বাকি আছে। সেদিন তারেক ভাইয়ের সস্নেহে আমি দুঃখ ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, আমার মধ্যে আর একটুও মন খারাপ ছিলো না। এমন পিতা যার কাঁধে হাত রেখে সাহস দেয়, শক্তি যোগায়, তার আর অপূর্ণতা কোথায়?

আজ তারেক ভাই নেই, এটা আমি এখনও মানতে পারি না। জনবহুল এলাকায় পুত্রের সাহস পরীক্ষার জন্য যেমন পুত্রকে রেখে পিতা আড়াল হয়ে পুত্র কি করে পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনি আমার সব সময় মনে হয় তারেক ভাই আড়াল থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমি ভয় পেলে তিনি আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকবেন, ‘রুহুল, এই যে আমি এখানে’।

অনেকেই শুনেছেন হয়তো, তারেক ভাই একটি কথা প্রায়ই বলতেন, দর্শকই আমার প্রাণ। সেই প্রাণ আজও বেঁচে রয়েছে হাজারো দর্শকের মাঝে। বেঁচে থাকবে চিরকাল। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

শুভ জন্মদিন তারেক ভাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত