Ajker Patrika

উত্তরবঙ্গে দ্রুত বদলে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহপথ, বাড়বে খরার তীব্রতা: গবেষণা

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১: ৪৩
দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকেরা পানি প্রবাহপথের পরিবর্তনকে তুলে এনেছেন। ছবি: সংগৃহীত
দেশের উত্তরাঞ্চলে খরা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে গবেষকেরা পানি প্রবাহপথের পরিবর্তনকে তুলে এনেছেন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ হিসেবে পরিচিত রংপুর বিভাগের বেশির ভাগ জেলাতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। অঞ্চলটিতে খরার অন্যতম কারণ এটি। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, কেবল স্তর নিচে নেমে যাওয়া নয়, ভূগর্ভে পানির প্রবাহের যে পথ ও বিন্যাস তা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফলে, পানির প্রাপ্যতাও সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হচ্ছে।

গবেষণাটি করেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান মনির, সুবরণ চন্দ্র সরকার, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের গবেষক (সিইজিআইএস) রথীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের মো. নজরুল ইসলাম।

বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল নেচারে প্রকাশিত ‘পানি-সংকটপূর্ণ ও খরাপ্রবণ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে আঞ্চলিক ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহপথের পরিবর্তনের পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন’—শীর্ষক গবেষণার উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশে পানি সংকটাপন্ন ও খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহপথের পরিবর্তন ও প্রবাহগতির বিরূপ প্রভাব মূল্যায়ন করা। ভৌগোলিক তথ্যপ্রযুক্তি ও ডার্সি প্রবাহ মডেল একত্রিত করে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহপথের পরিবর্তনের ভিজুয়ালাইজেশন, প্রবাহ প্রবণতা, ভলিউম ব্যালেন্স ও প্রবাহগতি নিরূপণ করা হয়েছে।

গবেষণা থেকে দেখা গেছে, গত ২০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানি প্রবাহের ফলে কোনো একটি স্থানে সাধারণত যে পরিমাণ পানি স্থিতিশীল থাকে, তার পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে এবং প্রবাহগতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো—স্যাচুরেটেড স্তরের (সাধারণত মাটির নিচে সর্বনিম্ন যে গভীরতায় স্বচ্ছ ও সুপেয় পানি নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়) পরিবর্তন ও হাইড্রোলিক হেডের (নদী বা সাগরের পানিপৃষ্ঠের তুলনায় কোনো একটি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতার ফারাক) ওঠানামা।

গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গড় প্রবাহ গতির হার ছিল প্রতি বছর ৫ হাজার ৯০০ থেকে ৭ হাজার ৩০০ মিটার পর্যন্ত এবং প্রতিটি মৌসুমেই এটি ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ভলিউম ব্যালেন্স রেসিডিউয়াল (কোনো একটি ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে পানি আসা-যাওয়ার পর কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে) ২০০১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে সামান্য বৃদ্ধি পেলেও ২০১০-২০২০ সালের মধ্যে তা হ্রাস পেয়েছে।

এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায়। গবেষণা এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহপথের ওঠানামার হার ব্যাপকভাবে বদলে যাচ্ছে এবং এর প্রবণতাও পরিবর্তিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্ম মৌসুমে পানির স্তর যেখানে থাকার কথা প্রতি বছরই সেটা আরও নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে যে, উত্তরবঙ্গের ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ পথের পরিবর্তন নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে এবং এর বিন্যাসও বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে, যেসব অঞ্চলে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যাপক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, সেসব এলাকায় এই অবক্ষয় সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গেছে। গবেষণার এলাকার ৩১ শতাংশেরও বেশি অঞ্চল বর্তমানে চরম ও তীব্র খরার সম্মুখীন, যার প্রধান কারণ ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের তারতম্য।

সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার গবেষণার এলাকার পরিবেশগত ব্যবস্থা ও কৃষি উৎপাদনের ওপর গুরুতর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। উত্তরবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও বিপর্যয়কর হবে যদি আমরা গভীর জলাধার থেকে ভূগর্ভস্থ পানির নিষ্কাশন কমিয়ে না আনি এবং পৃষ্ঠস্থ পানির ব্যবহার কমানোর যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া হয়।

উল্লেখিত গবেষণা এলাকার বিভিন্ন জেলার অসংখ্য কূপের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব মনিটরিং কূপে মৌসুমি প্রবণতা সাধারণত একরকম হলেও অঞ্চলজুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে উল্লেখযোগ্য তারতম্য রয়েছে। যেখানে গড় স্তর যথাক্রমে ২ দশমিক ৭১ মিটার, ৩ দশমিক ৮৭ মিটার এবং ৩ দশমিক ৭০ মিটার। ২০০১ সালের প্রাক-বর্ষা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ মূলত উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে জমা হয়েছিল, তবে বিভিন্ন স্থানে পানির অভাবের কারণে ছড়িয়ে পড়া প্রবাহের কিছু বিচ্ছিন্ন দিকও দেখা যায়।

এই গবেষণায় দেখা গেছে, উত্তরাঞ্চলের উত্তর অংশ এবং কেন্দ্রীয় কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের গতি তুলনামূলকভাবে বেশি। গবেষণা এলাকার দক্ষিণাংশেও অপেক্ষাকৃত বেশি প্রবাহ গতি লক্ষ্য করা যায়। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোর ফলাফল অনুযায়ী, সাধারণত ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে হয়ে থাকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাহের গতিপথে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে, যা শুধুমাত্র উত্তর থেকে দক্ষিণেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এমন কয়েকটি স্থানের দিকেও প্রবাহিত হচ্ছে যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

এই গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে যে, উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহের দিক উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর প্রবণতা ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে এমন এলাকাগুলোতে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে, যেখানে বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়। বর্তমান বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অধিকাংশ মনিটরিং স্টেশনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিম্নগামী প্রবণতা দেখাচ্ছে। পাশাপাশি, ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে, বৃষ্টিপাত ও ভূগর্ভস্থ পানির গভীরতার মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক বিদ্যমান, এবং সম্ভাব্য বাষ্পীভবন ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে।

সেচের জন্য ব্যাপক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে কৃষি উৎপাদন এবং গবেষণা এলাকার জীববৈচিত্র্যের ওপর গভীর প্রভাব পড়ছে, যা শেষ পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলে খরার তীব্রতা বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে বাষ্পীভবনের ক্রমাগত বৃদ্ধি রবি শস্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই মৌসুমে গাছের বৃদ্ধির জন্য অধিক হারে পানির প্রয়োজন হয়। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস এবং গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা শুষ্ক ও গরম পরিবেশ সৃষ্টি করছে, যা সরাসরি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এবং ফসল উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলছে।

এই গবেষণা ভবিষ্যতে উত্তরাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির সংকট এবং পরিবেশগত অবনতি মোকাবিলার জন্য কার্যকর পথনির্দেশনা প্রদান করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার আহ্বান ত্রিপুরার রাজপরিবার প্রধানের

পরিবারের সামনে পুলিশ কর্মকর্তা লাঞ্ছিত, স্বেচ্ছাসেবক দলের ৩ নেতা-কর্মী আটক

নয়াদিল্লি হাসিনা আমলের দৃষ্টিভঙ্গিই ধরে রেখেছে: ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

গ্রেপ্তার আসামিকে ছিনিয়ে নিতে পুলিশের ওপর হামলা, বিএনপির ১৭ নেতা-কর্মী আটক

তখন অন্য একটা সংগঠন করতাম, এখন বলতে লজ্জা হয়: জামায়াতের আমির

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত