Ajker Patrika

একবার-দুবার নয়, ১৬ বার সুন্দরবনে বাঘ দেখেছেন মনিরুল খান

আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৩, ১৫: ৪৮
একবার-দুবার নয়, ১৬ বার সুন্দরবনে বাঘ দেখেছেন মনিরুল খান

সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। বাঘ দেখার জন্য অসংখ্যবার সুন্দরবনে গিয়েও অনেক পর্যটক, বন্যপ্রাণীপ্রেমী বাঘের দেখা পাননি। তেমনি বছরের পর বছর ধরে গোলপাতা বা অন্য কোনো উদ্ভিদ আহরণে সুন্দরবনে যাওয়া অনেক বাওয়ালি কিংবা মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালও এর দেখা পাননি। সুন্দরবনে কাজ করা বন বিভাগের কর্মীদের জন্যও বাঘের দেখা মেলে কালেভদ্রে। 

সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল খান ব্যতিক্রম। একবার-দুবার নয়, সুন্দরবনে বাঘ দেখেছেন তিনি ১৬ বার। তাঁর সর্বশেষ বাঘ দেখার অভিজ্ঞতাসহ আগের কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।

শুরুটা অবশ্যই মনিরুল খানের সর্বশেষ, অর্থাৎ তাজা অভিজ্ঞতাটি দিয়ে। বন বিভাগের ফরেস্টারদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে এতে অংশ নিতে মনিরুল খান সুন্দরবনে গিয়েছিলেন গত মে মাসের শেষ দিকে। ২৮ মে যান সুন্দরবনের কচিখালীতে। বেলা সাড়ে ৩টা বাজে তখন। ছোট একটা নৌকা নিয়ে তাঁদের দলটা ঢুকল কচিখালী খালে। নৌকাটা বেশি বড় নয়, তবে ফরেস্টার, অন্য বন কর্মকর্তাসহ তাঁরা ৩০ জনের মতো ছিলেন নৌকাটিতে। 

সাড়ে ৪টার দিকে খালের একেবারে গভীরে চলে গেল তাঁদের বহন করা নৌকাটি। এখানে খালটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে গেছে। একটা মোটামুটি সোজা, আরেকটু একটু বাঁয়ে বেঁকে গেছে। অনেকটা ওয়াইয়ের মতো তৈরি হয়েছে এখানে। ওয়াইয়ের শুরু যেখানটায়, সেখানে হেতালের চারার একটি ঝোপের মতো তৈরি হয়েছে। ওখানে ঝোপের আড়ালে ঘুমিয়ে ছিল বাঘটি। 

মজার ঘটনা, বাঘটার ১০ ফুটের মধ্যে চলে এলেও প্রথমে মনিরুল খান এবং তাঁর সঙ্গীরা একে দেখতেই পাননি। তবে নৌকার কিংবা যাত্রীদের কথাবার্তার শব্দেই সম্ভবত জেগে উঠে যখন সামনের ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়ল, তখন দেখতে পেলেন একে। বাঁ দিকের খালের পাশের জঙ্গলেই ঢুকল বলে মনে হলো। নৌকা নিয়ে সেদিকে এগোলেন তাঁরা। কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে আসার সময় দেখলেন, যেখানে প্রথম ঘুমিয়েছিল, তার কাছেই আবার ঘুমিয়ে আছে বাঘ। 

বহুবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেও অনেকে বাঘের দেখা পাননি, তবে মনিরুল খান গুনে গুনে ১৬ বার বাঘ দেখেছেন এই বনে‘মোটামুটি ওটার থেকে ফুট পঁচিশেক দূরে গিয়ে নৌকাটা বাঁধা হলো। একটা ঝোপের আড়ালে থাকায় বাঘটার শরীরের ওপরের অংশটি দেখা যাচ্ছে। আমরা এখানেই অপেক্ষায় রইলাম। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়েই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটিকে দেখতে লাগলাম। কী আশ্চর্য! বাঘটাও একটু পরপর ঘুম থেকে জেগে মাথা তুলে আমাদের দেখছিল। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল। এভাবেই চলতে লাগল। আমরা শুরুতে কোনো কথা না বললেও একপর্যায়ে যখন দেখলাম বাঘটার ডেম কেয়ার ভাব। অর্থাৎ আমাদের গুনায়ই ধরছে না। নিজেদের কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এভাবেই চলল।’ বলেন মনিরুল খান। 

তারপর বাঘের বিচরণ, অর্থাৎ চলাফেরার সময় হয়ে যাওয়ায় এটি উঠে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। তখন আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পান তাঁরা এটাকে। পূর্ণবয়স্ক আর চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী একটি মদ্দা বা পুরুষ বাঘ এটি। 

সুন্দরবনে মনিরুল খানের প্রথম বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলে আপনাকে টাইম মেশিনে চেপে চলে যেতে হবে গুনে গুনে ২২ বছর আগে। সেটা ২০০১ সাল, দিনটা ৯ আগস্ট। সেটি ছিল মনিরুল খানের পিএইচডির মাঠ পর্যায়ে কাজের প্রথম ভ্রমণ। তিন সঙ্গীসহ লঞ্চ থেকে নেমে কটকা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের জেটির পাশের একটা খালের জঙ্গল ধরে হাঁটছিলেন তাঁরা। শ্বাসমূলে ভরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেশ কসরত করে হেঁটে যেতে হচ্ছে তাঁদের। জঙ্গলের ভেতরে ভ্যাপসা গরম, শরীরের সঙ্গে ভেজা জবজবে পোশাক লেগে আছে। হঠাৎ সরু খালটার ওপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে এল ‘হাউউউ, হাউউউ’। বাঘ ডাকছে। 

রোমাঞ্চিত হলেন, জীবনে প্রথম শুনলেন বাঘের ডাক। তারপর তাঁদের চমকে দিয়ে খুব কাছ থেকেই ভেসে এল অপর একটি বাঘের ডাক। বনের ভেতরে একটা নয়, দুই–দুটো বাঘের এত কাছাকাছি থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। দ্রুত বনের মধ্য দিয়ে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আকতারুজ্জামান কামাল। সুন্দরবন তাঁর নখদর্পণে। মনিরুল খানের অনুরোধেই ষাটোর্ধ্ব আকতারুজ্জামান কামাল তাঁদের সঙ্গে এসেছেন।

সাঁতরে নদী পেরোচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ।বাঘকে বোকা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। সুন্দরবনে আসার পথে মোংলা বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন মাটির এক হাঁড়ি। খুব সাবধানে টাওয়ার থেকে নেমে কাছাকাছি যেদিক থেকে বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছিল, সেদিকে একটু এগোলেন। তারপর একটা বুনো বরই ঝোপের নিচে লুকিয়ে কয়েকবার বাঘের ডাক নকল করলেন তাঁরা। যেন অন্য কোনো বাঘ এসেছে মনে করে বাঘটি এগিয়ে আসে। 

কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল ঘটনাবিহীনভাবে। তবে টেনশন, উত্তেজনায় তাঁরা রীতিমতো কাঁপছেন। তারপর সবুজ কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা মাঠে দেখা দিল প্রকাণ্ড একটা মাথা। তাহলে এটাই সেই মদ্দা বাঘ, যেটা বাঘিনীকে ডাকছিল। অপলক চোখে সোজা তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোমাঞ্চে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততর হলো তাঁদের। খালি চোখে দেখলেন, বাইনোকুলার দিয়ে দেখলেন। জীবনে প্রথমবার বাঘ দেখা বলে কথা। 

বাঘের দুই পাশের গাল থেকে ঝুলে আছে লম্বা লোম। বিকেলের পড়ন্ত রোদে চকচক করছে ওটার গায়ের সোনালি রং। মিনিট বিশেক তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকল ওটা, জায়গা থেকে না সরেই। তারপর ধীরেসুস্থে হেঁটে মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকে পড়ল। 

দ্বিতীয়বার বাঘ দেখেন ওই বছরই। তারিখটা ১৮ অক্টোবর। দিনের পর দিন শুধু বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল। শণের মাঠে শুকনো বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে মনিরুল খান বলেন, ‘বাঘের পায়ের ছাপই তো শুধু দেখি, বাঘ তো দেখি না।’ যে ছাপটা দেখছিলেন, সেটা ছিল আকারে বিশাল। তো পায়ের ছাপ থেকে মাথা তুলতেই চমকে উঠলেন, দূরে হালকাভাবে গজিয়ে ওঠা শণের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বিশাল এক পুরুষ বাঘ। মনিরুল খান জানান, সুন্দরবনে যত বাঘ দেখেছেন, আকারে এটি ছিল সবচেয়ে বড়। 

হাতের লাঠি বাগিয়ে বাঘটার পিছু পিছু রওনা দিলেন তাঁরা। বাঘটা বেশ সামনে ছিল। একপর্যায়ে বাঘ মল ত্যাগ করতে বসল। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ওটার কাছাকাছি চলে গেলেন তাঁরা। ওই অবস্থায় ওটার ছবি তুললেন। বাঘটা তারপর ঘন জঙ্গলের দিকে রওনা হলো। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দেখেন আর কেবল একটি ছবি তোলা যাবে। উত্তেজনার বশে করলেন দুঃসাহসিক এক কাজ। বাঘের দিকে ক্যামেরা তাক করে লেন্স ফোকাস করে জোরে শিস দিলেন। বাঘটি ধীরেসুস্থে মাথা তুলে তাঁর দিকে তাকাল। তিনিও ঝটপট ছবি তুলে ফেললেন। আর ছবি তোলার সুযোগ ছিল না, তাই ক্যামেরা নামিয়ে বাঘটির দিকে তাকালেন। বাঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা যে কতটা কঠিন, তা হাড়ে হাড়ে বুঝলেন। বাঘ একবার তাঁর দিকে তাকাল। তারপর বড় বড় কয়েক লাফে গভীর জঙ্গলে ঢুকল। 

ছবি তোলার সময় বাঘটা যেন সরাসরি আলোকচিত্রীর দিকেই তাকিয়ে ছিল।পরদিন ১৯ অক্টোবর আবার বাঘ দেখলেন। মনিরুল খানদের ছোট্ট লঞ্চটি বাঁধা ছিল কটকা নদীর ঘাটে। সকালে ঘুম ভাঙল বাঘের ডাকে। গোটা এলাকা কাঁপছে দুটি বাঘের ডাকে। নদীর দুই পাড় থেকে একটু বিরতি দিয়ে ডেকেই যাচ্ছে বাঘ দুটি। লঞ্চের ওপর গেলেন টেপরেকর্ডার নিয়ে। উদ্দেশ্য, বাঘের ডাক রেকর্ড করা। 

কুয়াশার কারণে কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ কিছু দূরে নদীর পাড় ঘেঁষে কিছু একটাকে সাঁতরাতে দেখলেন। প্রথমে ভাবলেন কুমির। হঠাৎ কাছের জেলে নৌকা থেকে ভেসে আসা চিৎকার শুনতে পেলেন, ‘বাঘ, বাঘ’। বাইনোকুলার বের করে চোখে লাগাতেই, কুমিরটা হয়ে গেল বাঘ। ততক্ষণে সাঁতরে কটকা নদীর অন্য পাড়ে চলে গেছে বাঘটা। ঝটপট লঞ্চ স্টার্ট দিয়ে সেদিকে রওনা হলেন। বাঘটি পাড়ের কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে লঞ্চের দিকে তাকাল। 

এভাবেই বারবার সুন্দরবনে বাঘের দেখা পেয়েছেন মনিরুল খান। প্রতিবার যে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঘের দেখা পেয়েছেন তা নয়। কখনো কখনো খুব সামান্য সময়ের জন্যও ধরা দেয় বনের মহাপরাক্রমশালী প্রাণীটি তাঁর চোখের সামনে। কিন্তু তাঁর এতবার বাঘ দেখার রহস্য কী? মনিরুল খানের মতে, এর একটি কারণ বেশি সময় দেওয়া। আরেকটি বাঘের আচরণ সম্পর্কে জানা—অর্থাৎ কোথায়, কীভাবে সময় দিলে বাঘ দেখা যেতে পারে সেটা বোঝা।

একজন বন্যপ্রাণীপ্রেমী বা পর্যটকের বাঘ দেখার সম্ভাবনা বাড়াবে কখন প্রশ্ন করা হলে মনিরুল খান জানান, কম পর্যটক যখন থাকে, তখন। অর্থাৎ বর্ষাকাল বাঘ দেখার জন্য ভালো সময় হতে পারে। তখন এমনকি দিনের বেলায়ও বাঘ খোলামেলা জায়গায় চলে আসে। অন্যদিকে পর্যটক বেশি থাকলে তাদের বিচরণটা হয় মূলত রাতেই। বাঘ দেখার জন্য কোনো একটা জায়গায় রেকি করাটাও জরুরি মনে করেন তিনি। জঙ্গলের যে অংশে তাজা পায়ের ছাপ মিলবে, সেখানে সময় দিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আজ ঢাকার আবহাওয়া কেমন থাকবে জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকায় আজ শুক্রবার সকালে তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।

আজ সকাল ৭টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পূর্বাভাসে এ কথা বলা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ সকাল ৬টায় ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৮৬ শতাংশ।

পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া থাকতে পারে শুষ্ক। তবে আকাশ আংশিক মেঘলা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় উত্তর অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৬ থেকে ১২ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যেতে পারে। দিনের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

পূর্বাভাসে আরও জানানো হয়েছে, আজ সূর্যাস্ত ৫টা ১৫ মিনিটে এবং আগামীকাল সূর্যোদয় ৬টা ৩৬ মিনিটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণে বছরে প্রাণ হারাচ্ছে ১০ লাখ মানুষ

  • ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মধ্যে আছে বাংলাদেশও
  • অস্বাস্থ্যকর বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে কোটি কোটি মানুষ
  • ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির ১০ শতাংশের সমপরিমাণ
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দক্ষিণ এশিয়ার গাঙ্গেয় সমভূমি ও হিমালয়ের পাদদেশ (আইজিপি-এইচএফ) অঞ্চলের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ নিয়মিত অস্বাস্থ্যকর বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে। এতে বছরে এই অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে অঞ্চলটির অর্থনীতিতে বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশের সমপরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। এই দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশও।

বিশ্বব্যাংকের ‘এ ব্রেথ অব চেঞ্জ: সলিউশনস ফর ক্লিনার এয়ার ইন দ্য ইন্দো-গেঞ্জেটিক প্লেইনস অ্যান্ড হিমালয়ান ফুটহিলস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আইজিপি-এইচএফ অঞ্চলে বায়ুদূষণ এখনো অন্যতম বড় উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। সমন্বিত ও বাস্তবভিত্তিক কিছু পদক্ষেপ নিলে দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এতে একই সঙ্গে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুটোরই উন্নতি হবে।

গাঙ্গেয় সমভূমি ও হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও ভুটানের অংশবিশেষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ অঞ্চলের বায়ুদূষণের প্রধান পাঁচটি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রান্না ও ঘর গরম করার কাজে লাকড়িজাতীয় কঠিন বস্তু ব্যবহার, শিল্পকারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) ও বায়োম্যাসের ফিল্টার ছাড়া অদক্ষ ব্যবহার, অনুন্নত প্রযুক্তির ইঞ্জিনের যানবাহন চালানো, কৃষকদের খেতের ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানো এবং রাসায়নিক সার ও গোবরের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং গৃহস্থালি ও কারখানার বর্জ্য পোড়ানো।

দূষণ কমাতে কয়েকটি তুলনামূলকভাবে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। এগুলো হলো–বৈদ্যুতিক চুলায় রান্না, শিল্পকারখানার বয়লার, ফার্নেস ও ইটভাটার আধুনিকায়ন, নন-মোটরাইজড ও বৈদ্যুতিক পরিবহনব্যবস্থার প্রসার, কৃষিবর্জ্য ও পশুবর্জ্যের উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্য পৃথক্‌করণ ও পুনর্ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া।

প্রতিবেদনে নির্মল বায়ু নিশ্চিত করার কৌশলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. দূষণের উৎসেই নির্গমন কমানোর ব্যবস্থা। ২. স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করে শিশু ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া। ৩. কার্যকর আইন, বাজারভিত্তিক প্রণোদনা ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা।

বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ অর্থনীতিবিদ মার্টিন হেগার বলেন, ‘নির্মল বায়ু নিশ্চিত করার সমাধানগুলো বাস্তবসম্মত ও কার্যকর। নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার পরিবার, কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারে আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক সুযোগ তৈরি করে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মল বায়ু নিশ্চিত করতে ‘চারটি আই’ (ইংরেজি আদ্যক্ষর)—তথ্য, প্রণোদনা, প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা, পরিচ্ছন্ন বিকল্পে বিনিয়োগে প্রণোদনা, কার্যকর প্রতিষ্ঠান এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলাই এই রূপান্তরের মূল চাবিকাঠি।

বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিবেশবিষয়ক প্র্যাকটিস ম্যানেজার অ্যান জিনেট গ্লাউবার বলেন, স্থানীয় থেকে আঞ্চলিক পর্যায় পর্যন্ত সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া নির্মল বায়ু অর্জন সম্ভব নয়। সরকারগুলো একসঙ্গে কাজ করলেই কেবল দূষণ কমানো, লাখো মানুষের জীবন রক্ষা এবং সবার জন্য নিরাপদ বায়ু নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঢাকার বাতাস সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর, আজও দূষণে শীর্ষে দিল্লি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ০২
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বেশ কিছুদিন ধরে দিল্লির বাতাসের অবস্থা দুর্যোগপূর্ণ। আজ বৃহস্পতিবার দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে শহরটি। অন্যদিকে ঢাকার বায়ুমান আজ সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, আজ বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকার ১২৭টি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে ঢাকা।

আইকিউএয়ারের সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের রেকর্ড অনুযায়ী, ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ১৯০। যা নির্দেশ করে ঢাকার বাতাসের অবস্থা সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর।

ঢাকার বেশ কিছু স্থানের বাতাসের অবস্থা সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর থেকে খুব অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে রয়েছে— কল্যাণপুর (২৬০), দক্ষিণ পল্লবী (২৫৬), বেজ এজওয়াটার আউটডোর (১৯৬), গোড়ান (১৯৬) ও বেচারাম দেউরি (১৯০)।

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে দিল্লি। শহরটির একিউআই স্কোর ৩১০। যা এই শহরের বাতাসকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে।

তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের লাহোর (২৭০, খুব অস্বাস্থ্যকর), তৃতীয় স্থানে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সারাজেভ (২২৭, খুব অস্বাস্থ্যকর), চতুর্থ স্থানে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি (২০১, খুব অস্বাস্থ্যকর) এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে মিসরের কায়রো (১৯৪, সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর)।

বাতাসের গুণমান সূচকের (একিউআই) মাধ্যমে দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়মিত বায়ু পরিস্থিতি তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। তাদের তালিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই দূষণের প্রধান উৎস। বেশিমাত্রার দূষণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদ্‌রোগ এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

বাতাসের মূল ক্ষতিকারক উপাদান হলো ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২.৫। এটি এতই সূক্ষ্ম যে তা ফুসফুসে এমনকি রক্তপ্রবাহেও প্রবেশ করতে পারে।

বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১-১০০ হলে তা সহনীয়। ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১-২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ।

বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় প্রতিবছর বহু মানুষ মারা যায়। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বায়ুদূষণ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৫২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ বলে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় তুলে ধরা হয়।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গৃহস্থালি ও পারিপার্শ্বিক বায়ুদূষণের সম্মিলিত প্রভাবে বছরে ৬৭ লাখ মানুষ মারা যায়।

দীর্ঘদিন ঢাকার বাতাস অতিমাত্রায় দূষিত হওয়ায় বাইরে বের হলে সবাইকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সংবেদনশীল ব্যক্তিদের অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার অনুরোধও করা হয়েছে।

পাশাপাশি ইটভাটা, শিল্পকারখানার মালিক এবং সাধারণ মানুষকে কঠিন বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ রাখা, নির্মাণস্থলে ছাউনি ও বেষ্টনী স্থাপন করা, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ট্রাক বা লরি ঢেকে নেওয়া, নির্মাণস্থলের আশপাশে দিনে অন্তত দুবার পানি ছিটানো এবং পুরোনো ও ধোঁয়া তৈরি করা যানবাহন রাস্তায় বের না করতে বলা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বেড়েছে ঢাকার তাপমাত্রা, জানাল আবহাওয়া অধিদপ্তর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পৌষ মাসের তৃতীয় দিন আজ। শীতের মৌসুম চলে এলেও রাজধানী ঢাকায় বাড়ছে তাপমাত্রা। আজ বৃহস্পতিবার সকালের আবহাওয়া বুলেটিনে দেখা যায়, গতকালের তুলনায় আজ সকালে তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ সকাল ৬টায় ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গতকাল মঙ্গলবার ছিল ১৬ দশমিক ৬। এ সময় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৮৯ শতাংশ।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সকাল ৭টায় পরবর্তী ছয় ঘণ্টার জন্য ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুপুর পর্যন্ত আবহাওয়া থাকতে পারে শুষ্ক। তবে আকাশ আংশিক মেঘলা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় উত্তর অথবা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘণ্টায় ৬ থেকে ১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়ে যেতে পারে। দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

পূর্বাভাসে আরও জানানো হয়েছে, আজ সূর্যাস্ত ৫টা ১৫ মিনিটে এবং আগামীকাল সূর্যোদয় ৬টা ৩৬ মিনিটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত