একবার-দুবার নয়, ১৬ বার সুন্দরবনে বাঘ দেখেছেন মনিরুল খান

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৩, ১৫: ৪৮
Thumbnail image

সুন্দরবনে বাঘের দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। বাঘ দেখার জন্য অসংখ্যবার সুন্দরবনে গিয়েও অনেক পর্যটক, বন্যপ্রাণীপ্রেমী বাঘের দেখা পাননি। তেমনি বছরের পর বছর ধরে গোলপাতা বা অন্য কোনো উদ্ভিদ আহরণে সুন্দরবনে যাওয়া অনেক বাওয়ালি কিংবা মধু সংগ্রহকারী মৌয়ালও এর দেখা পাননি। সুন্দরবনে কাজ করা বন বিভাগের কর্মীদের জন্যও বাঘের দেখা মেলে কালেভদ্রে। 

সে ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রধান ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল খান ব্যতিক্রম। একবার-দুবার নয়, সুন্দরবনে বাঘ দেখেছেন তিনি ১৬ বার। তাঁর সর্বশেষ বাঘ দেখার অভিজ্ঞতাসহ আগের কিছু অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে।

শুরুটা অবশ্যই মনিরুল খানের সর্বশেষ, অর্থাৎ তাজা অভিজ্ঞতাটি দিয়ে। বন বিভাগের ফরেস্টারদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে এতে অংশ নিতে মনিরুল খান সুন্দরবনে গিয়েছিলেন গত মে মাসের শেষ দিকে। ২৮ মে যান সুন্দরবনের কচিখালীতে। বেলা সাড়ে ৩টা বাজে তখন। ছোট একটা নৌকা নিয়ে তাঁদের দলটা ঢুকল কচিখালী খালে। নৌকাটা বেশি বড় নয়, তবে ফরেস্টার, অন্য বন কর্মকর্তাসহ তাঁরা ৩০ জনের মতো ছিলেন নৌকাটিতে। 

সাড়ে ৪টার দিকে খালের একেবারে গভীরে চলে গেল তাঁদের বহন করা নৌকাটি। এখানে খালটি দুটি অংশে ভাগ হয়ে গেছে। একটা মোটামুটি সোজা, আরেকটু একটু বাঁয়ে বেঁকে গেছে। অনেকটা ওয়াইয়ের মতো তৈরি হয়েছে এখানে। ওয়াইয়ের শুরু যেখানটায়, সেখানে হেতালের চারার একটি ঝোপের মতো তৈরি হয়েছে। ওখানে ঝোপের আড়ালে ঘুমিয়ে ছিল বাঘটি। 

মজার ঘটনা, বাঘটার ১০ ফুটের মধ্যে চলে এলেও প্রথমে মনিরুল খান এবং তাঁর সঙ্গীরা একে দেখতেই পাননি। তবে নৌকার কিংবা যাত্রীদের কথাবার্তার শব্দেই সম্ভবত জেগে উঠে যখন সামনের ঝোপের ভেতরে ঢুকে পড়ল, তখন দেখতে পেলেন একে। বাঁ দিকের খালের পাশের জঙ্গলেই ঢুকল বলে মনে হলো। নৌকা নিয়ে সেদিকে এগোলেন তাঁরা। কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে আসার সময় দেখলেন, যেখানে প্রথম ঘুমিয়েছিল, তার কাছেই আবার ঘুমিয়ে আছে বাঘ। 

বহুবার সুন্দরবন ভ্রমণ করেও অনেকে বাঘের দেখা পাননি, তবে মনিরুল খান গুনে গুনে ১৬ বার বাঘ দেখেছেন এই বনে‘মোটামুটি ওটার থেকে ফুট পঁচিশেক দূরে গিয়ে নৌকাটা বাঁধা হলো। একটা ঝোপের আড়ালে থাকায় বাঘটার শরীরের ওপরের অংশটি দেখা যাচ্ছে। আমরা এখানেই অপেক্ষায় রইলাম। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়েই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণীটিকে দেখতে লাগলাম। কী আশ্চর্য! বাঘটাও একটু পরপর ঘুম থেকে জেগে মাথা তুলে আমাদের দেখছিল। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ছিল। এভাবেই চলতে লাগল। আমরা শুরুতে কোনো কথা না বললেও একপর্যায়ে যখন দেখলাম বাঘটার ডেম কেয়ার ভাব। অর্থাৎ আমাদের গুনায়ই ধরছে না। নিজেদের কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এভাবেই চলল।’ বলেন মনিরুল খান। 

তারপর বাঘের বিচরণ, অর্থাৎ চলাফেরার সময় হয়ে যাওয়ায় এটি উঠে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। তখন আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পান তাঁরা এটাকে। পূর্ণবয়স্ক আর চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী একটি মদ্দা বা পুরুষ বাঘ এটি। 

সুন্দরবনে মনিরুল খানের প্রথম বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলে আপনাকে টাইম মেশিনে চেপে চলে যেতে হবে গুনে গুনে ২২ বছর আগে। সেটা ২০০১ সাল, দিনটা ৯ আগস্ট। সেটি ছিল মনিরুল খানের পিএইচডির মাঠ পর্যায়ে কাজের প্রথম ভ্রমণ। তিন সঙ্গীসহ লঞ্চ থেকে নেমে কটকা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের জেটির পাশের একটা খালের জঙ্গল ধরে হাঁটছিলেন তাঁরা। শ্বাসমূলে ভরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেশ কসরত করে হেঁটে যেতে হচ্ছে তাঁদের। জঙ্গলের ভেতরে ভ্যাপসা গরম, শরীরের সঙ্গে ভেজা জবজবে পোশাক লেগে আছে। হঠাৎ সরু খালটার ওপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে এল ‘হাউউউ, হাউউউ’। বাঘ ডাকছে। 

রোমাঞ্চিত হলেন, জীবনে প্রথম শুনলেন বাঘের ডাক। তারপর তাঁদের চমকে দিয়ে খুব কাছ থেকেই ভেসে এল অপর একটি বাঘের ডাক। বনের ভেতরে একটা নয়, দুই–দুটো বাঘের এত কাছাকাছি থাকা মোটেই নিরাপদ নয়। দ্রুত বনের মধ্য দিয়ে ফিরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আকতারুজ্জামান কামাল। সুন্দরবন তাঁর নখদর্পণে। মনিরুল খানের অনুরোধেই ষাটোর্ধ্ব আকতারুজ্জামান কামাল তাঁদের সঙ্গে এসেছেন।

সাঁতরে নদী পেরোচ্ছে সুন্দরবনের বাঘ।বাঘকে বোকা বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। সুন্দরবনে আসার পথে মোংলা বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন মাটির এক হাঁড়ি। খুব সাবধানে টাওয়ার থেকে নেমে কাছাকাছি যেদিক থেকে বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছিল, সেদিকে একটু এগোলেন। তারপর একটা বুনো বরই ঝোপের নিচে লুকিয়ে কয়েকবার বাঘের ডাক নকল করলেন তাঁরা। যেন অন্য কোনো বাঘ এসেছে মনে করে বাঘটি এগিয়ে আসে। 

কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল ঘটনাবিহীনভাবে। তবে টেনশন, উত্তেজনায় তাঁরা রীতিমতো কাঁপছেন। তারপর সবুজ কার্পেটের মতো বিছিয়ে থাকা মাঠে দেখা দিল প্রকাণ্ড একটা মাথা। তাহলে এটাই সেই মদ্দা বাঘ, যেটা বাঘিনীকে ডাকছিল। অপলক চোখে সোজা তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। রোমাঞ্চে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুততর হলো তাঁদের। খালি চোখে দেখলেন, বাইনোকুলার দিয়ে দেখলেন। জীবনে প্রথমবার বাঘ দেখা বলে কথা। 

বাঘের দুই পাশের গাল থেকে ঝুলে আছে লম্বা লোম। বিকেলের পড়ন্ত রোদে চকচক করছে ওটার গায়ের সোনালি রং। মিনিট বিশেক তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকল ওটা, জায়গা থেকে না সরেই। তারপর ধীরেসুস্থে হেঁটে মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকে পড়ল। 

দ্বিতীয়বার বাঘ দেখেন ওই বছরই। তারিখটা ১৮ অক্টোবর। দিনের পর দিন শুধু বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল। শণের মাঠে শুকনো বালুতে বাঘের পায়ের ছাপ দেখে মনিরুল খান বলেন, ‘বাঘের পায়ের ছাপই তো শুধু দেখি, বাঘ তো দেখি না।’ যে ছাপটা দেখছিলেন, সেটা ছিল আকারে বিশাল। তো পায়ের ছাপ থেকে মাথা তুলতেই চমকে উঠলেন, দূরে হালকাভাবে গজিয়ে ওঠা শণের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বিশাল এক পুরুষ বাঘ। মনিরুল খান জানান, সুন্দরবনে যত বাঘ দেখেছেন, আকারে এটি ছিল সবচেয়ে বড়। 

হাতের লাঠি বাগিয়ে বাঘটার পিছু পিছু রওনা দিলেন তাঁরা। বাঘটা বেশ সামনে ছিল। একপর্যায়ে বাঘ মল ত্যাগ করতে বসল। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ওটার কাছাকাছি চলে গেলেন তাঁরা। ওই অবস্থায় ওটার ছবি তুললেন। বাঘটা তারপর ঘন জঙ্গলের দিকে রওনা হলো। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দেখেন আর কেবল একটি ছবি তোলা যাবে। উত্তেজনার বশে করলেন দুঃসাহসিক এক কাজ। বাঘের দিকে ক্যামেরা তাক করে লেন্স ফোকাস করে জোরে শিস দিলেন। বাঘটি ধীরেসুস্থে মাথা তুলে তাঁর দিকে তাকাল। তিনিও ঝটপট ছবি তুলে ফেললেন। আর ছবি তোলার সুযোগ ছিল না, তাই ক্যামেরা নামিয়ে বাঘটির দিকে তাকালেন। বাঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা যে কতটা কঠিন, তা হাড়ে হাড়ে বুঝলেন। বাঘ একবার তাঁর দিকে তাকাল। তারপর বড় বড় কয়েক লাফে গভীর জঙ্গলে ঢুকল। 

ছবি তোলার সময় বাঘটা যেন সরাসরি আলোকচিত্রীর দিকেই তাকিয়ে ছিল।পরদিন ১৯ অক্টোবর আবার বাঘ দেখলেন। মনিরুল খানদের ছোট্ট লঞ্চটি বাঁধা ছিল কটকা নদীর ঘাটে। সকালে ঘুম ভাঙল বাঘের ডাকে। গোটা এলাকা কাঁপছে দুটি বাঘের ডাকে। নদীর দুই পাড় থেকে একটু বিরতি দিয়ে ডেকেই যাচ্ছে বাঘ দুটি। লঞ্চের ওপর গেলেন টেপরেকর্ডার নিয়ে। উদ্দেশ্য, বাঘের ডাক রেকর্ড করা। 

কুয়াশার কারণে কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ কিছু দূরে নদীর পাড় ঘেঁষে কিছু একটাকে সাঁতরাতে দেখলেন। প্রথমে ভাবলেন কুমির। হঠাৎ কাছের জেলে নৌকা থেকে ভেসে আসা চিৎকার শুনতে পেলেন, ‘বাঘ, বাঘ’। বাইনোকুলার বের করে চোখে লাগাতেই, কুমিরটা হয়ে গেল বাঘ। ততক্ষণে সাঁতরে কটকা নদীর অন্য পাড়ে চলে গেছে বাঘটা। ঝটপট লঞ্চ স্টার্ট দিয়ে সেদিকে রওনা হলেন। বাঘটি পাড়ের কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে পিছু ফিরে লঞ্চের দিকে তাকাল। 

এভাবেই বারবার সুন্দরবনে বাঘের দেখা পেয়েছেন মনিরুল খান। প্রতিবার যে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাঘের দেখা পেয়েছেন তা নয়। কখনো কখনো খুব সামান্য সময়ের জন্যও ধরা দেয় বনের মহাপরাক্রমশালী প্রাণীটি তাঁর চোখের সামনে। কিন্তু তাঁর এতবার বাঘ দেখার রহস্য কী? মনিরুল খানের মতে, এর একটি কারণ বেশি সময় দেওয়া। আরেকটি বাঘের আচরণ সম্পর্কে জানা—অর্থাৎ কোথায়, কীভাবে সময় দিলে বাঘ দেখা যেতে পারে সেটা বোঝা।

একজন বন্যপ্রাণীপ্রেমী বা পর্যটকের বাঘ দেখার সম্ভাবনা বাড়াবে কখন প্রশ্ন করা হলে মনিরুল খান জানান, কম পর্যটক যখন থাকে, তখন। অর্থাৎ বর্ষাকাল বাঘ দেখার জন্য ভালো সময় হতে পারে। তখন এমনকি দিনের বেলায়ও বাঘ খোলামেলা জায়গায় চলে আসে। অন্যদিকে পর্যটক বেশি থাকলে তাদের বিচরণটা হয় মূলত রাতেই। বাঘ দেখার জন্য কোনো একটা জায়গায় রেকি করাটাও জরুরি মনে করেন তিনি। জঙ্গলের যে অংশে তাজা পায়ের ছাপ মিলবে, সেখানে সময় দিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত