রাজধানীর মিরপুরের সাপটি রাসেলস ভাইপার নয়, এই সাপ চেনার উপায়

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
Thumbnail image

দেশজুড়ে গত কদিন ধরেই বিরাজ করছে ‘রাসেলস ভাইপার’ আতঙ্ক। সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার উদ্ধার, মেরে ফেলা বা এই সাপের দংশনে আহত বা নিহত হওয়ার খবর আসছে। কোথাও কোথাও রাসেলস ভাইপার সাপ দাবিতে মারা হচ্ছে ভিন্ন প্রজাতির সাপ। এই সাপ নিয়ে সংবাদমাধ্যমেও একাধিক ভুল তথ্য প্রচারের ঘটনা শনাক্ত করেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। গতকাল মঙ্গলবার (২ জুলাই) জাতীয় সংবাদমাধ্যমসহ বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালে দাবি করা হয়, এবার নাকি রাজধানীর মিরপুরে দেখা গেছে রাসেলস ভাইপার! 

এমন দাবি করে সংবাদ প্রকাশ করেছে ভোরের কাগজ, যুগান্তর, কালবেলা, ঢাকা প্রকাশ, বিডি ২৪ লাইভসহ বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল। যদিও আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ১ নম্বর চিড়িয়াখানা রোডের একটি বাসায় রাসেলস ভাইপার ভেবে মেরে ফেলা সাপটি ভিন্ন প্রজাতির। 

সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত রাসেলস ভাইপার দাবিতে মেরে ফেলা সাপের ছবিটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাপটির গায়ের রং চকলেট বাদামি। গায়ে সাদা ডোরা রয়েছে এবং ডোরাগুলো বিচ্ছিন্ন রিংয়ের মতো। সাপটির গায়ের এমন বর্ণনার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ঘর গিন্নি সাপের। আর রাসেলস ভাইপারের গায়ের রং বাদামি এবং গায়ে গোলাকার চাঁদের মতো নকশা থাকে। নকশাগুলোর ভেতরের প্রান্ত কালো ও বাইরের প্রান্ত সাদা। মাথা ও ধড়ের সংযোগ স্থলে ঘাড় স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। দুই সাপের এই দৈহিক বর্ণনা থেকে এটি স্পষ্ট, রাসেলস ভাইপার ভেবে মেরা ফেলা সাপটি ঘর গিন্নি। ঘর গিন্নির ইংরেজি নাম কমন উলফ স্নেক। এটি গাছে, মাটিতে ও মানব বসতিতে বসবাসকারী মাঝারি আকারের নির্বিষ সাপ। 

রাজধানীর মিরপুরে পাওয়া সাপটি নির্বিষ ঘর গিন্নি। ছবি: ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনভিন্ন প্রজাতির সাপকে রাসেলস ভাইপার হিসেবে সংবাদমাধ্যমে উপস্থাপনের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে নীলফামারীর জলঢাকায় ২৯টি বাচ্চাসহ মেরে ফেলা হয় সাইবোল্ডের পাইন্না সাপ নামে মৃদু বিষধর একটি সাপ। এ সাপকে রাসেলস ভাইপার দাবি করে সংবাদ প্রকাশ করে একাধিক জাতীয় সংবাদমাধ্যম। এ নিয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। 

একাধিক সংবাদমাধ্যমে এমন বিভ্রান্তির কারণ সাইবোল্ডের পাইন্না সাপের শারীরিক গঠনের সঙ্গে রাসেলস ভাইপারের সাদৃশ্য। বিশেষ করে দুই সাপের গায়ের ডোরায় কিছুটা সাদৃশ্য এ বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে খালি চোখেই দুই প্রজাতির এ সাপের মধ্যে পার্থক্য ধরা যায়। 

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের প্রচারিত লিফলেটে সাইবোল্ডের পাইন্না সাপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি পানিতে বসবাসকারী মোটাসোটা সাপ। মৃদু বিষধর ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। এই প্রজাতির সাপ সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে। পেটে বাচ্চা থাকলে একটু বেশি মোটা দেখায়। এদের গায়ের রং বাদামি, জলপাই সবুজ বা কালচে। সাদা বা সোনালি–হলুদ ডোরা থাকে। ডোরাগুলো দেহের দুই পাশে জুড়ে গিয়ে ইংরেজি বর্ণমালা ইউ–এর মতো প্যাটার্ন তৈরি করে। 

সাইবোল্ডের পাইন্না সাপ মৃদু বিষধর ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ছবি: বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের প্রচারিত লিফলেটআবার সরকারের বন ও পরিবেশ বিভাগের কর্মকর্তাদেরও রাসেলস ভাইপার না চেনার মতো ঘটনা ঘটছে। গত শুক্রবার (২৮ জুন) লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মেঘনা নদীর তীরে একটি রাসেলস ভাইপার পিটিয়ে মারে স্থানীয়রা। তবে কমলনগর উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান বলেন, সাপটি রাসেলস ভাইপার নয়। রাসেলস ভাইপারের ধরনের সঙ্গে অনেকাংশেই মিল নেই। এটি অন্য কোনো প্রজাতির সাপ।  

বাংলাদেশে চন্দ্রবোড়া নামে পরিচিত সাপটিই এখন রাসেলস ভাইপার নামে সংবাদমাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে। এই সাপের দুটি প্রজাতির কথা জানা যায়। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii। এটি পাওয়া যায় বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে। অপর দিকে Daboia siamensis নামের প্রজাতিটির দেখা মেলে চীন, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান এবং কম্বোডিয়ায়। সর্পবিদ প্যাট্রিক রাসেলের নামে এই সাপের নামকরণ। রাসেল ১৭৯৬ সালে ‘এন একাউন্ট অব ইন্ডিয়ান সার্পেন্ট’ শিরোনামের লেখায় এর সম্পর্কে জানান। 

রাসেলস ভাইপার আক্রমণাত্মক নয়, আবার দেশের সবচেয়ে ভয়ংকর বিষধর সাপও নয়। গোটা বিশ্বের সাপদের মধ্যে বিষের তীব্রতার বিবেচনায় চন্দ্রবোড়ার অবস্থান ৩৭ তম। বাংলাদেশের এর চেয়েও বেশি তীব্র বিষযুক্ত সাপ রয়েছে পাঁচ প্রজাতির। 

সাপ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের তৈরি একটি ফটোকার্ড থেকে জানা যায়, জিনগত পার্থক্যের কারণে রাসেলস ভাইপারের বেশ কিছু ধরন পাওয়া যায়। প্রতিষ্ঠানটি ভারত, বাংলাদেশে প্রাপ্ত রাসেলস ভাইপারের এমন জেনেটিক মিউটেশন (জিনগত পরিব্যক্তি) নিয়ে ফটোকার্ডটি তৈরি করেছে। 

রাসেলস ভাইপারের সাধারণ ধরনটি হলো, এর সারা দেহে কালো রংয়ের গোলাকার নকশা থাকে। নকশার প্রান্তে থাকে সাদা রং। এর বাইরে ভারতে সাপটির একটি ধরন পাওয়া যায়। এই ধরনের রাসেলস ভাইপারের দেহে সাদাটে বাদামি রং প্রকট থাকে এবং পিঠে দুটি সমান্তরাল কালো রেখা থাকে। মাঝখানের অঞ্চলটি গাঢ় বাদামি। মাথার নকশা অস্পষ্ট।

রাসেলস ভাইপার সাপের কয়েকটি জেনেটিক মিউটেশন। ছবি: ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনআরেকটি ধরন হচ্ছে, দেহের সব রং-ই প্রকট হয়। গোলাকার নকশাগুলো থাকে দেহের দুই পাশে। পিঠ সাদাটে বাদামি, তবে লেজের দিকে কালো বৃত্তযুক্ত গোলাকার নকশা স্পষ্ট হয়। মাথায় কোনো নকশা থাকে না। এই ধরনটি দেখা গেছে রাজশাহীতে।

রাসেলস ভাইপারের অপর একটি ধরনটি পাওয়া গেছে বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুরে। এই সাপের দেহের দুই পাশে কালো বৃত্তযুক্ত গোলাকার নকশা থাকলেও পিঠে এক জোড়া কালো সমান্তরাল রেখা রয়েছে।

এ ধরনের একটি সাপকেই কমলনগর উপজেলা বন কর্মকর্তা অন্য কোনো প্রজাতির সাপ দাবি করেছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত