ওষুধের সঙ্গে কিডনির সম্পর্ক

ডা. মো. মনিরুল ইসলাম ফাহিম
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৯: ৫০
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ১০: ২৬

আমাদের শরীরের যে গুরুত্বপূর্ণ কার্যকরী অঙ্গগুলো রয়েছে, তার মধ্যে কিডনি বা বৃক্ক অন্যতম। কিডনি একদিকে যেমন শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো শোষণ করে নেয় ও বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়, তেমনি শরীরের জন্য হরমোন তৈরি বা অম্ল ও ক্ষারের সামঞ্জস্যও বজায় রাখতে কাজ করে। এগুলো ছাড়াও কিডনির আরেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। সেটা হচ্ছে ওষুধ খাওয়ার পরে তার বর্জ্যকেও শরীর থেকে নিষ্কাশন করে দেওয়া।

বিভিন্ন সহজ ও কঠিন রোগের জন্য আমরা যেসব ওষুধ খেয়ে থাকি, সেগুলো কাজ শেষ করার পরে যে বর্জ্য তৈরি হয়, তা শরীর থেকে বের করে দেওয়া প্রয়োজন। সুস্থ কিডনি এ কাজটি প্রতিনিয়ত সুচারুরূপে পালন করে। ফলে ওষুধ শরীরে কোনো ধরনের বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু কিডনি অসুস্থ থাকলে প্রাণঘাতী অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ওষুধের সঙ্গে কিডনির বিভিন্ন সমস্যার সম্পর্ক। কিডনির সমস্যা মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে–একিউট কিডনি ইনজুরি (AKI), যা দ্রুততার সঙ্গে কিডনির সমস্যা তৈরি করে এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (CKD), যেটাতে কিডনির সমস্যা হতে অনেক সময় প্রয়োজন। অনেকের ধারণা, দীর্ঘ মেয়াদে ওষুধ খেলেই কিডনির সমস্যা হয়, যেটি আদতে সত্য নয়। এমনকি মাত্র এক ওষুধের একটি ডোজ খেয়েও কিডনির সমস্যা তৈরি হতে পারে। যাঁদের ক্রনিক কিডনি ডিজিজ আছে, তাঁদের ওষুধ নিষ্কাশনের ক্ষমতা কমে যায়। তাই স্বাভাবিক পরিমাণ ওষুধের বর্জ্যও পুরোপুরি নিষ্কাশন না হতে পেরে শরীরে রয়ে যায় এবং সেটা পক্ষান্তরে কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে এর ক্ষতি করতে পারে। অন্যদিকে কিছু ওষুধ আছে, যেগুলোয় খুব তাড়াতাড়ি এমনকি একটি মাত্র ডোজে একিউট কিডনি ইনজুরি হতে পারে। এসব ওষুধে অ্যালার্জিজনিত কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কিডনি অকেজো হতে পারে।

কোন ধরনের ওষুধ কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে

ব্যথানাশক ওষুধ
বিভিন্ন সমস্যায় আমরা প্রায়ই ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে থাকি। কিন্তু নিয়ম মেনে ওষুধ না খাওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ খাওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের কিডনির সমস্যা তৈরি হয়। যেসব ওষুধ কিডনির সমস্যা তৈরি করতে পারে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নন-স্টেরইডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ড্রাগস, যেমন আইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রোক্সেন, ডাইক্লোফেনাক ইত্যাদি। এমনকি হালের সেলেক্সিব-জাতীয় ওষুধ   কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক
যেসব অ্যান্টিবায়োটিক কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তার মধ্যে আছে সচরাচর ব্যবহৃত কিছু অ্যান্টিবায়োটিক। 
যেমন পেনিসিলিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, মেথিসিলিন, ভ্যানকোমাইসিন, অ্যামাইনোগ্লাইকোসাইড (যেমন জেন্টামাইসিন, ক্যানামাইসিন ইত্যাদি), সেফালোস্পোরিন, সেফুরক্সিম, সেফটাজিডিম, সেফাক্লোর, সেফালেক্সিন।

উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ
এনজিওটেনসিন রিসেপ্টর ব্লকার ও এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম ইনহিবিটর–এ ধরনের ওষুধ হঠাৎ করেই কিডনিকে অকেজো করে 
দিতে পারে।

বাতজ্বরের ওষুধ
হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন-জাতীয় ওষুধ কিডনির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

পাকস্থলীর আলসারের ওষুধ
পাকস্থলীর আলসার প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেয়ে থাকি, যেগুলোর মধ্যে একধরনের ওষুধ হচ্ছে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর। এই ওষুধ কিডনির রোগীদের ক্ষতি বাড়িয়ে দিতে পারে।

বিভিন্ন রোগ নির্ধারণ করার জন্য সিটি স্ক্যান ও এমআরআই করতে গিয়ে কিছু রং বা কন্ট্রাস্ট  ব্যবহার করা হয়, যেগুলো কিডনির জন্য ক্ষতিকর হয়ে যেতে পারে।

এ ছাড়া ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি-জাতীয় ওষুধ কিডনির ক্ষতি করতে পারে। মদ ও বিভিন্ন মাদক যেগুলো কিডনি দিয়ে নিঃসরণ হয়, সেগুলো কিডনিকে ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয়।

বিপদ এড়াতে যা করবেন

  • কিডনির অবস্থা বোঝার জন্য খুব সহজ ও সস্তা একটি রক্ত পরীক্ষা আছে, সেরাম ক্রিয়েটিনিন। ওষুধ-সংক্রান্ত কিডনির সমস্যা এড়াতে এই পরীক্ষা খুব 
    উপযোগী। কোনো ধরনের ওষুধ রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শুরু বা বন্ধ করবেন না, কারও প্ররোচনায় কোনো ধরনের ওষুধ খাবেন না।
  • চিকিৎসা নেওয়ার সময় দীর্ঘস্থায়ী রোগ ও চলমান ওষুধের পূর্ণ বিবরণ দিন।
  • যে ওষুধ যত দিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, ঠিক তত দিনই খাবেন, বেশি না, কমও না।
  • সিটি স্ক্যান, এমআরআই, কোলনোস্কপিসহ যে ধরনের পরীক্ষা করতে কন্ট্রাস্ট ডাই বা রং ব্যবহার করা হয়, এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
  • দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ  শুরু ও শেষ করার পর কিডনির কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করানো প্রয়োজন।
  • আগে থেকে কিডনির সমস্যার কারণে পানি খাওয়া বারণ না থাকলে যেকোনো ওষুধ খাওয়ার আগে ও পরে প্রচুর পানি 
    পান করুন।

লেখক: রেসিডেন্ট, নেফ্রোলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত