মানুষ কেন তোতলায়, আজও যে কারণে রহস্য

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ০০
আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ৫৭

বিশ্বের ৮ কোটিরও বেশি মানুষ তোতলামি সমস্যায় ভোগেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, গায়ক–গীতিকার এড শিরানের মতো ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। এমনকি বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনও এই সমস্যায় ভুগতেন। 

এমন সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে এক–একটি শব্দ বা এক–একটি ধ্বনি উচ্চারণের মধ্যে অস্বাভাবিক বিরতি দিতে দেখা যায়। এই সমস্যার কারণে সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হতে পারেন। কেউ কেউ অবশ্য মানসিক চাপে পড়েও তোতলান। 

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ক্লিনিক্যাল স্পিচ ও ভাষা থেরাপিস্ট এলিনা ট্রিপোলিতি বলেন, বেশ বড় সংখ্যক মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক জানেন না কী কারণে এটি হয়। অন্তত তোতলামির ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কীভাবে কাজ করে তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না নিউরোবায়োলজি বা স্নায়ুবিজ্ঞান। 

গবেষকদের মতে, এই অবস্থাটি সম্ভবত একাধিক কারণে হতে পারে—যার মধ্যে জিনগত কারণ, মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতার পার্থক্য এবং ব্যক্তির আশপাশের পরিবেশও রয়েছে। 

এ ছাড়া স্ট্রোক ও পারকিনসনের মতো রোগে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

প্রাপ্তবয়স্ক যাদের তোতলামি রয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগেরই ‘ডেভেলপমেন্টাল স্টাটারিং’ বা বাড়ন্ত বয়সের তোতলামি ছিল। এটি সাধারণত ২ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে প্রথম শুরু হয়। কিন্তু বড় হওয়ার আগেই ৯০ শতাংশ শিশুর এই সমস্যা দূর হয়। এই ধরনের তোতলামির কারণও ব্যাখ্যা করা কঠিন। যদিও সাম্প্রতিক সময় বেশ কয়েকটি ধারণার কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। 

ডেভেলপমেন্টাল স্টাটারিংয়ের একটি প্রধান কারণ হতে পারে—জিনগত। এই ধরনের তোতলামি প্রায়ই পরিবার থেকে আসে। একজাতীয় যমজদের ওপর করা গবেষণায় দেখা গেছে যে, তোতলামির ৮০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে জিনের ভূমিকা থাকতে পারে। 

কয়েকটি ছোট গবেষণা এই তত্ত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। গবেষকেরা এমন কিছু নির্দিষ্ট জিন চিহ্নিত করেছেন, যা তোতলামির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এসব জিনের মধ্যে এমন জিনও রয়েছে, যা কোষের মধ্যে বিভিন্ন উপাদানের চলাচল বা মস্তিষ্কে ডোপামিনের রাসায়নিক নিঃসরণ ও স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত। 

দেখা গেছে, পুরুষেরা নারীদের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি তোতালামিতে আক্রান্ত। তবে এই পার্থক্যের কারণও বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। তবে কিছু তত্ত্ব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তোতলামি পাওয়া প্রতিরোধে নারীরা বেশি সক্ষম। 

যারা তোতলামিতে আক্রান্ত এবং যারা স্বাভাবিকভাবে কথা বলেন, তাঁদের মস্তিষ্কে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্যও দেখা যায়। মস্তিষ্কের ইনফিরিয়র ফ্রন্টাল গাইরাস এবং বাম মোটর কোর্টেক্সে এই পার্থক্য দেখা যায়। এসব অঞ্চল কথা বলার পরিকল্পনা এবং সম্পাদনের জন্য দায়ী। 

এ ছাড়া, ২০২৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তোতলামি হয়তো মস্তিষ্কে নিউরন নেটওয়ার্কের কোথাও ব্যাঘাতের কারণে হয়। অ্যামিগডালা, পুটামেন এবং ক্লস্ট্রামকে সংযুক্ত করে এই নেটওয়ার্ক। মস্তিষ্কের এই তিনটি অংশ যথাক্রমে আবেগ ও চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তথ্য আদান–প্রদানের সঙ্গে জড়িত। 

পরিবেশগত কারণও তোতলামিতে প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবারের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া একজন তোতলা ব্যক্তির উদ্বেগের কারণ হতে পারে, যা তাঁর উপসর্গকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। 

বছরের পর বছর তোতলামি নিয়ে গবেষণা সীমিত ছিল কারণ বিজ্ঞানীরা অন্য প্রাণীর ওপর এ নিয়ে গবেষণা করতে পারেননি। যেখানে মানুষের বিভিন্ন রোগ নিয়ে গবেষণায় গবেষণাগারে ইঁদুর, গিনিপিগ ইত্যাদি প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালানো যায়। তোতলামিতে তো সেটি সম্ভব নয়। আর গবেষণালব্ধ জ্ঞান ছাড়া লক্ষ্যভিত্তিক চিকিৎসা ঠিক করাও কঠিন হতে পারে। 

মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেটিভ সায়েন্সেস ও ডিসঅর্ডারের অধ্যাপক স্কট ইয়্যারাস বলেন, কয়েকটি গবেষণায় তোতলামির কমানোর জন্য ওষুধ ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে এমন কোনো ওষুধ নেই যা এই সমস্যাকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারে। 

তিনি আরও বলেন, যে ওষুধগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, তা কিছু মানুষের জন্য তোতলামি কমাতে সাহায্য করে এটি ঠিক, কিন্তু এটি কোনো প্রতিকার নয়। 

থেরাপি কিছু মানুষকে সহজে কথা বলতে সাহায্য করতে পারে। তোতলামিকে সব সময় রোগ হিসেবে না দেখে সমাজকে একে একটি ‘মৌখিক বৈচিত্র্য’ হিসেবে গ্রহণ করলে সেই মানুষদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়! 

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত