বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম

ডা. উম্মে নুসরাত আরা
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২২, ০৯: ৫৩
আপডেট : ০৮ মে ২০২৪, ২২: ৩৯

থ্যালাসেমিয়া হিমোগ্লোবিন ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত একধরনের বংশগত রক্তস্বল্পতার রোগ। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে এক প্রকার লৌহ মিশ্রিত পদার্থ, যেটি আমাদের রক্তের লোহিত কণিকার মধ্যে থাকে। এই হিমোগ্লোবিন আয়রন ও গ্লোবিন প্রোটিন দিয়ে তৈরি। গ্লোবিন আলফা ও বিটা এই দুই জোড়া 
চেইন দিয়ে তৈরি।

থ্যালাসেমিয়া রোগে এ দুই জোড়া গ্লোবিনের যে কোনো এক জোড়ার তৈরি হওয়া কমে যায়। আলফা চেইন তৈরিতে সমস্যা হলে তাকে আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা চেইন তৈরিতে কোনো সমস্যা হলে তাকে বিটা থ্যালাসেমিয়া বলা হয়। এক জোড়া চেইনের তৈরি হওয়া যখন কমে যায়, তখন সঙ্গের অন্য জোড়ার তৈরি হওয়া বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া গ্লোবিন লোহিত কণিকায় জমা হয়ে লোহিত কণিকাটি ভেঙে যায়। 

বাংলাদেশে পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ 
লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। প্রতিবছর নতুন করে প্রায় ৭ হাজার থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্ম হচ্ছে।

 থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালাসেমিয়া দুটি প্রধান ধরনের হতে পারে—আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।

আলফা থ্যালাসেমিয়া
এই রোগের জন্য ১৬ নম্বর ক্রোমোজোমে উপস্থিত আলফা চেইন উৎপাদনকারী জিনের রূপান্তর বা মিউটেশন বা ডিলিশন দায়ী। চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল তৈরি হয়। বাবা-মা থেকে পাওয়া চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে, তত বেশি মারাত্মক সমস্যা হবে।

বিটা থ্যালাসেমিয়া
এই রোগের জন্য ১১ নম্বর ক্রোমোজোমে উপস্থিত বিটা চেইন উৎপাদনকারী জিনের রূপান্তর বা মিউটেশন দায়ী। বাবা-মা থেকে পাওয়া জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। এ ক্ষেত্রে-

  • একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট।
  • দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর।

 থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গগুলো মূলত রক্তস্বল্পতাজনিত উপসর্গ। যেমন-

  • ক্লান্তি
  • অবসাদ
  • শ্বাসকষ্ট
  • ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
  • রক্ত অধিক হারে ভেঙে যাওয়া ও অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া
  • জন্ডিস হয়ে ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া
  • অস্থির ঘনত্ব কমে যেতে পারে
  • নাকের হাড় দেবে যাওয়া ও মুখের গড়নে পরিবর্তন হওয়া
  • শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
  • অতিরিক্ত আয়রন জমা হয়ে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়া।

সংক্রমণ
এটি একটি বংশগত রোগ। তাই বাবা-মা দুজনই যদি বাহক হন, তাহলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে, আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা-মা দুজনই যদি রোগী হন, তাহলে সব সন্তান রোগে আক্রান্ত হবে। তাঁদের সুস্থ সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার যদি মা-বাবার একজন রোগী হন, অন্যজন সুস্থ থাকেন, তাহলে কিছু সন্তান বাহক হবে; কিছু সুস্থ হবে।

চিকিৎসা
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা প্রতি মাসে রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। প্রয়োজন অনুসারে প্রতি মাসে এক থেকে দুই ব্যাগ রক্ত লাগতে পারে। চিকিৎসা না করা হলে এ রোগীরা রক্তশূন্যতায় মারা যায়। আবার বারবার রক্ত নেওয়ার কারণে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যায়। ফলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তাই অতিরিক্ত লৌহজনিত জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি দেওয়া হয়। 
থ্যালাসেমিয়ার স্থায়ী চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। কিন্তু এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অন্যান্য চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে জিন থেরাপি ও স্টেম সেল থেরাপি। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রোগের প্রতিরোধ।

প্রতিরোধ

  • স্ক্রিনিং টেস্ট এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যামে যারা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হিসেবে চিহ্নিত হবে, তাদের প্রত্যেককে বংশবিষয়ক পরামর্শ  দিতে হবে।
  • রোগটি মা-বাবার কাছ থেকেই সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাই যদি বিয়ে করার আগে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয়, তাহলে রোগটি ছড়িয়ে পড়বে না।
  • গর্ভবতী হওয়ার পর প্রি-নেটাল ডায়াগনোসিস নামে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় সন্তান সুস্থ হবে নাকি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে। 

এইসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

লেখক: শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত