Ajker Patrika

আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণ ৩ মাসে হয়েছে ৩ গুণ

অনলাইন ডেস্ক
আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণ ৩ মাসে হয়েছে ৩ গুণ

টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের শুরু করা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর আফগানিস্তানে এই প্রথম আবার তালেবানরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত দুই মাসে দেশটির যে বিস্তৃত অঞ্চলে তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে, তেমনটি ২০০১ সালের পর আর দেখা যায়নি।

গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে তালেবান গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত এলাকার মানচিত্র প্রতিনিয়ত বদলেছে। কখনো পিছু হটেছে, কখনো এগিয়ে গেছে। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে যে যুদ্ধ, তা এখনো চলছে। এত দিন সরকার পক্ষের সঙ্গে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ায় অনেকটাই বিপাকে পড়েছে আফগান সরকার। যত দিন যাচ্ছে দেশটির বিভিন্ন এলাকার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। যেসব অঞ্চলে এখনো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তাও কত দিন থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে এরই মধ্যে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি আফগানিস্তানে দুই পক্ষের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মানচিত্র নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে তারা বলছে, মানচিত্রে হওয়া পরিবর্তন এবং বিশেষ করে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে তালেবানদের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণের ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত কয়েক সপ্তাহে তারা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তারা সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে বেশ কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। পুরো দেশেই এখন তারা বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। বিশেষত দেশটির গজনি, ময়দান ওয়ারদক এলাকাসহ উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলে তারা রীতিমতো ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। এ ছাড়া কুন্দুজ, হেরাত, কান্দাহার ও লস্কর গা শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারি বাহিনী কত দিন ধরে রাখতে পারবে, তাও নিশ্চিত নয়।

এখানে নিয়ন্ত্রণ বলতে সেসব এলাকাকেই বোঝানো হচ্ছে, যেখানকার পুলিশ, প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্থাসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানরা করছে। যে হারে তারা আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে, তাতে গত দুই দশকে দেশটিতে করা মার্কিন বিনিয়োগ যে একেবারে মাঠে মারা গেছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলার পর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালায়। এবং নভেম্বরের মধ্যে দেশটির ক্ষমতা থেকে তালেবানদের উৎখাত করে। কিন্তু কাবুল ছাড়লেও যুদ্ধ চলতে থাকে। গত দুই দশক আফগানিস্তানের জন্য যুদ্ধই একমাত্র সত্য ছিল। সে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্রদের পাশাপাশি ছিল এই অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা। বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করতে গত দুই দশকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে ওয়াশিংটন। কিন্তু এখন দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর দেশটির সরকারি বাহিনী যেভাবে পিছু হটতে শুরু করেছে, তাতে এই বিনিয়োগ যে কোনো কাজে লাগেনি, তা একেবারে স্পষ্ট। মার্কিন পক্ষের চাপে তালেবানরা একসময় ছত্রভঙ্গ হলেও আফগানিস্তানের দুর্গম বিভিন্ন অঞ্চলে তারা পুনরায় একত্র হতে থাকে। আর এখন সেই এক জোট হওয়ার শক্তিটাই তারা দেখাচ্ছে।

এই পুরো সময়ে তারা একটু একটু করে পিছু হটলেও বেশ কিছু অঞ্চল কিন্তু বরাবরই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে তালেবানরা বরাবরই শক্তিশালী। এ অঞ্চলগুলোর মধ্যে হেলমান্দ উত্তরাঞ্চল, কান্দাহার, উরুজগান ও জাবুল প্রদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। শুধু এটুকুই নয়, ফারইয়াবের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান পার্বত্য এলাকায়ও তাদের শক্ত ঘাঁটি ছিল ও আছে।

২০১৭ সালে বিবিসির চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, আফগানিস্তানের বেশ কিছু জেলায় তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। একই সঙ্গে এমন বেশ কিছু অঞ্চল ছিল, যেখানে তাদের বেশ জোরালো উপস্থিতি ছিল। এসব অঞ্চলে প্রায়ই তারা নানা বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দিত। হামলার ব্যাপকতা ও হার দিয়েই কোনো একটি অঞ্চলে তাদের শক্তিমত্তাটি বোঝা যেত। পরে সেই হিসাবটি তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অঙ্কের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ, যেসব অঞ্চলে তালেবান হামলা বেশি হয়েছে, সেসব অঞ্চলকেই পরে তাদের নিয়ন্ত্রণে যেতে দেখা গেছে।

বর্তমানে এই নিয়ন্ত্রণ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। তালেবানদের দাবি তারা আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। যদিও এই দাবি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে এটা সত্য যে গত কয়েক মাসে তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার পরিসর অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে বাড়িয়েছে। ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স ডেমোক্রেসিসের লং ওয়ার জার্নালের ভাষ্য হচ্ছে, আফগানিস্তানের মোট ৪২১ জেলার মধ্যে ২২০টি এরই মধ্যে তালেবানদের দখলে চলে গেছে। তিন মাস আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫। অর্থাৎ, তিন মাসে তালেবানরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকার পরিসর ২৯৩ শতাংশ বাড়িয়েছে।

মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকেই আফগানিস্তানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে শুরু করে তালেবানরা

বিবিসির করা মানচিত্র পর্যালোচনাতেও এমনটিই দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, এরই মধ্যে তালেবানরা দেশটির প্রায় অর্ধেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমটির বিশ্লেষণে যদিও বলা হচ্ছে, এই নিয়ন্ত্রণ তালেবানরা কত দিন ধরে রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এমন বহু এলাকা রয়েছে, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ যেকোনো সময় যেকোনো পক্ষের কাছে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কাবুল সরকার তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে নিজেরাই সংশয়ে ভুগছে। এরই মধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা চেয়েছে।

এদিকে আজ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে আফগান সেনাদের কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের সীমান্তে প্রবেশ করা কিছু আফগান সেনাকে রীতি মেনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানায়, আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর ৪৬ সদস্য পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের চিত্রল শহরে প্রবেশ করে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন কর্মকর্তাও ছিলেন। পরে এই তাঁদের খাবার, আশ্রয় দেওয়াসহ রীতিমাফিক যাবতীয় সহায়তা দেওয়া হয়। যদিও পাকিস্তানের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে আফগান সরকার। কিন্তু পরে আজ মঙ্গলবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগান সরকারি বাহিনীর সদস্যদের একটি ভিডিও প্রকাশ করে।

আফগান সরকার নিশ্চিতভাবেই এই সময়ে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে তৎপর রয়েছে। যুদ্ধের ময়দান বা প্রশাসনিক তৎপরতা দুই ক্ষেত্রেই তারা পিছু হটছে। সমস্যা হলো নিজেদের এই পিছু হটাকে তারা আবার আড়াল করার চেষ্টা করছে। আর এই প্রবণতার কারণেই তালেবানরা ধরতে গেলে কোনো রক্তপাত ছাড়াই সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে বেশ কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এখন পর্যন্ত সমতল বা নদীবিধৌত এলাকাগুলোর শহরগুলোতেই আফগান সরকারের ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বাকি অঞ্চলগুলো এরই মধ্যে তালেবানদের হাতে গেছে, অথবা যাওয়া অপেক্ষায় রয়েছে। কাবুল সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মার্কিন বাহিনী বিমান হামলা চালিয়েছে গত কয়েক দিন। এর মধ্য দিয়ে হারানো কিছু অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে আফগান সরকার। কিন্তু তালেবানরা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বাইরের শক্তির অনুপস্থিতিতে তারা তা পারবে না বলেই মনে হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

খিলক্ষেতে ধর্ষণের অভিযোগে কিশোরকে গণপিটুনি, আহত ৭ পুলিশ

ইউএনওর গাড়িচালকদের চাকরি স্থায়ীকরণে বাধা কাটল

মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য গুরুতর: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

কুমিল্লায় সহকর্মীকে বেঁধে নারী এনজিও কর্মীকে যৌন নির্যাতন, নগ্ন ভিডিও করে টাকা আদায়

কোকাকোলা থেকে কোলগেট, মার্কিন পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে ইউরোপজুড়ে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত