গণপ্রতিরোধের শক্তি দেখিয়ে দিল দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষ

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সামনে বাধা পেয়ে বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির মুখপাত্র আন গোয়ি রিয়ং (৩৫) এক সেনার বন্দুকের নল চেপে ধরেন। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল গত মঙ্গলবার সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। পরে দেশটির পার্লামেন্ট, বিরোধী দল এবং রাজনীতিবিদদের চাপের মুখে দ্রুতই সেই সামরিক আইন তুলে নেন। এরপর থেকেই তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী দলগুলো তো বটেই নিজ দলের সদস্যরাও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির পার্লামেন্টে তাঁর অভিশংসন ভোট শুরু হয়েছে। হয়তো তাঁর পক্ষে অভিশংসন এড়ানো সম্ভব হবে না। তবে আকস্মিক এই সামরিক আইন জারি দেশটিকে একাধিক জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে—বিশেষ করে ইউন সুক-ইওলের রাজনৈতিক কৌশল এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সামরিক আইন জারির বিষয়টি দেশ ও বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। সামরিক আইন ঘোষণার করতে গিয়ে ইউন বলেন, বাজেট অচলাবস্থা, সরকারি কর্মকর্তাদের অভিশংসন এবং ‘সংবিধানিক শৃঙ্খলার লঙ্ঘনই’ এই পদক্ষেপের কারণ। ইউন দাবি করেন, বিরোধী দলের নেতৃত্বে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এবং দেশের বিচারিক প্রশাসনকে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে।

এই আদেশের পর, সেনাবাহিনীর জেনারেল পার্ক আন-সু সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক দল, জনসমাবেশ এবং শ্রম আন্দোলনের ওপর অবিলম্বে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, যা দক্ষিণ কোরিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূলভিত্তিতে কুঠারাঘাত করে। এমনকি গণমাধ্যমকেও সামরিক নিয়ন্ত্রণে আনা হয় তৎক্ষণাৎ।

রাজনৈতিক নেতা এবং বিভিন্ন পক্ষ এই পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেন। জরুরি ভিত্তিতে গভীর রাতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির এক অধিবেশনে—সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে এবং বাইরে প্রতিবাদকারীদের সমাবেশ চলাকালে—৩০০ আসন বিশিষ্ট ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ১৯০ সদস্যই সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ভোট দেন। অ্যাসেম্বলির চেয়ারম্যান উ উন-সিক এই আদেশকে ‘অবৈধ’ বলে ঘোষণা করেন এবং বলেন, ‘জনগণ শান্তিতে থাকতে পারে। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি জনগণের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্র রক্ষা করবে।’

ইউনের এই ভুল পদক্ষেপ তাঁর প্রশাসনের সংকট এবং নিজের দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলার মরিয়া চেষ্টাকেই তুলে ধরে। ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসা ইউনের জনপ্রিয়তা এখন ২০ শতাংশের ঘরে। বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ। নিজের দল পিপল পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) অভ্যন্তরীণ বিরোধ—বিশেষ করে চেয়ারম্যান হান ডং-হুনের সঙ্গে তাঁর সংঘাত— সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট ইউন বেশ চাপে আছেন।

ইউন প্রশাসন বিভিন্ন কেলেঙ্কারি এবং তদন্তের মুখোমুখি। যার মধ্যে রয়েছে ঘুষের অভিযোগ থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ কর্মকর্তা এবং তাঁর স্ত্রীর স্বার্থের সংঘাতের অভিযোগ। এ কারণেই প্রেসিডেন্টের হঠাৎ করেই সামরিক আইন জারির মতো পদক্ষেপকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটানোর প্রচেষ্টা এবং গভীর অগণতান্ত্রিক মনোভাব হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কোরিয়ার সামরিক শাসনের যুগ (১৯৬১–৮৭)–এর সঙ্গে এই ঘটনার মিল অত্যন্ত স্পষ্ট। পার্ক চুং-হি এবং চুন দু-হোয়ান শাসন সামরিক আইনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। চলমান ঘটনায় উত্তর কোরিয়ার সমর্থকদের বিরোধী শিবিরে ঘাপটি মেরে থাকার অভিযোগ এনে ইউন যে অজুহাত দেখিয়েছেন, তা দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসনের সময় ব্যবহৃত অজুহাতের স্মৃতিই ফিরিয়ে আনছে।

ইউন সুক-ইওলের অভিশংসন ও বিচার চেয়ে পার্লামেন্টের বাইরে জনতার বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
ইউন সুক-ইওলের অভিশংসন ও বিচার চেয়ে পার্লামেন্টের বাইরে জনতার বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি

তবে গত তিন দশক প্রমাণ করে, দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ গণতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসরণ সহ্য করবে না। ২০১৬–১৭ সালের ‘মোমবাতি আন্দোলন’ শান্তিপূর্ণভাবে প্রেসিডেন্ট পার্ক জিউন-হাইকে অপসারণ করার মাধ্যমে নাগরিক অংশগ্রহণের শক্তি প্রদর্শন করেছিল। কোরিয়ার নাগরিক সমাজ, ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক বজায় রেখেছে যা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোনো হুমকি এলে দ্রুতই সংগঠিত হতে পারে।

রাজনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজের দ্রুত প্রতিক্রিয়ার কারণে, এই সংকট শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে। তবে আসন্ন দিনগুলো অশান্ত হতে পারে এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি যেভাবে সেনা নেতৃত্ব এবং ইউন প্রশাসনকে প্রত্যাখ্যান করেছে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র: কার্নেগি এনডাওমেন্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত