Ajker Patrika

আগের মতো নয় বলল তালেবান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক
আগের মতো নয়  বলল তালেবান

মাঝখানে চলে গেছে দুটি দশক। হয়েছে অনেক রক্তক্ষয়। অনেক অনেক ধ্বংস দেখেছে আফগানিস্তান। গত রোববার কাবুল যখন আবার তালেবানের দখলে গেল, তখন গোটা বিশ্ব ভীষণ উদ্বেগে ভয়ংকর প্রতিশোধ ও ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য আশঙ্কায় আতঙ্কিত ছিল। কিন্তু কোনো রক্তপাত হয়নি। এটি মৌনভাবে যে বার্তা দিয়েছিল গতকাল মঙ্গলবার কাবুলে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে সেটাই স্পষ্ট করল তালেবান। জানাল, আগের মতো আর নয়। এবার বদলে যাওয়া তালেবানকে দেখবে বিশ্ব।

গতকাল সন্ধ্যায় কাবুলে তালেবান মুখপাত্র যবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, গোটা বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন একটি সরকার তারা আলোচনার মাধ্যমে গঠন করতে চান। এ জন্য বিভিন্ন পক্ষকে এ সরকারে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

সোভিয়েত আগ্রাসনের পর গড়ে ওঠা তালেবান গোষ্ঠী ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল। সে সময় অন্য ধর্ম, শিক্ষা, নারীসহ বিভিন্ন প্রশ্নে তালেবানের অবস্থান নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এবার সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন নারীরা। পুরোনো শঙ্কা ঘিরে ধরেছে তাঁদের।

আফগানিস্তানের সংবাদ সংস্থা খামা নিউজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কাবুলে আসু সরকারের অংশ হতে নারীরা বিক্ষোভ করেছেন। গতকাল সকালে কাবুলের পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট-১০ এর সামনে করা এ বিক্ষোভ থেকে তাঁরা ভবিষ্যৎ সরকারের অংশ হওয়ার দাবি জানান। অবশ্য তাঁরা সরাসরি তালেবানের নাম উল্লেখ করেননি। এর কিছু আগে কুনার প্রদেশে জড়ো হয়ে কিছু তরুণ তালেবানের কাছে পুরোনো পতাকা অক্ষুণ্ণ রাখার আহ্বান জানান।

গতকাল দুপুরেই এ বিষয়ে বক্তব্য আসে তালেবানের কাছ থেকে। তারা সরকারের অংশ হওয়ার জন্য নারীদের আহ্বান জানায়। সন্ধ্যায় যবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আফগানিস্তানের নারীরা ইসলামি শরিয়ত ও আইন অনুসারে সব ধরনের সুবিধা ভোগ করবেন। নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজের অধিকার পাবেন। তবে পতাকা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি তালেবান। মুজাহিদ বলেছেন, এ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মুজাহিদ বেশ কিছু বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। বলেছেন, দেশের ভেতরে-বাইরে কোথাও তারা শত্রু চান না। যুদ্ধ শেষ। এখন আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে তাঁরা মনোযোগ দিতে চান। উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করতে চান। আফগানদের প্রতি দেশের এই উন্নয়ন বিপ্লবে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ভবিষ্যৎ সরকারে অংশ নিতে তালেবান পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে সব পক্ষকে আহ্বান করা হয়েছে। সঙ্গে যেসব রাজনীতিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাঁদের ফিরে আসার আহ্বানও জানান হয়। বলা হয়, সাধারণ ক্ষমা করা হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার সুযোগ ছেলেমেয়ে সবার জন্যই উন্মুক্ত থাকবে বলেও জানানো হয়েছে। তবে তারা এখনো নিজেদের নেতা হিসেবে কারও নাম ঘোষণা করেনি। ফলে সরকার গঠন করলে, কে বা কারা এর নেতৃত্ব দেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি গত রোববার দেশ ছেড়ে পালিয়ে এখন ওমানে আছেন বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে। তাঁর শেষ গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। নিজের পলায়নের কারণ হিসেবে তিনি শান্তির কথা বলেছেন। তালেবানও শান্তির কথা বলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না।

বহু মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে চাইছেন। তাদের আশ্রয় দিতে বিভিন্ন দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে আশ্রয় আবেদন খারিজ হওয়া আফগানদের যেন ফেরত পাঠানো না হয়, সে আহ্বানও জানিয়েছে। আর দুই দশকের ঘাঁটি তুলে চলে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগানদের আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে দ্বারে দ্বারে যাচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন পাকিস্তানসহ ন্যাটো মিত্র দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছেন। এমন অনুরোধ বাংলাদেশের কাছেও এসেছিল।

কিন্তু গতকাল সে অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টায় অবশ্য সাড়া দিয়েছে উগান্ডা। দেশটি ২ হাজার আফগানকে আশ্রয় দেবে বলে জানিয়েছে। আফগানদের অনেকে কী ভীষণভাবে পালাতে চাইছে, তা গত সোমবার উড়োজাহাজের চাকায় চড়ে দেশ ছাড়ার চেষ্টা দেখে বোঝা যায়। কোনো নিরাপত্তা ছিল না বিমানবন্দরের। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। আগের চেয়ে শৃঙ্খলা ফিরেছে। কাবুলের পথে-ঘাটে গাড়ি বের হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। কিন্তু স্বাভাবিকতা ফিরতে এখনো অনেক বাকি।

সম্ভাব্য সরকারে নানা পক্ষের মত নিতে হবে এটা বুঝে গেছেন তালেবান নেতারা। ফলে তাড়াহুড়া না করে ধৈর্যের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে চায়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো কী চায় তাও গুরুত্বপূর্ণ-এটা ভালোই বুঝেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র চায়, সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করুক তালেবান। চীন এরই মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তো অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েই দিয়েছেন।

সব মিলিয়ে সত্যিই আগের চেয়ে নমনীয় ও সহনশীল হলে তালেবানকে মেনে নিতে এখন অনেকেই প্রস্তুত বলা যায়। কাবুলের রাস্তাঘাটেও যান চলাচল শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে খামা প্রেসের খবরে। সঙ্গে এও বলা হয়েছে, দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। মানুষের চলাচলও আগের চেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে এর মধ্যেও শুরুর দিনই বেশ কিছু টিভি ও রেডিও চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ায় শঙ্কা তৈরি হয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও চ্যানেলের কার্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তারা বলছে—‘আমরা তো আছি।’ উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)।

এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তালেবান মুখপাত্র। বলেছেন, ‘আমরা সব ধরনের গণমাধ্যমের সঙ্গে সার্বিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখব, যাতে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। তবে কোনো গণমাধ্যম যাতে ইসলামবিরোধী কোনো বিষয় প্রচার না করে।’

তালেবান পক্ষ এখনো কট্টর কোনো অবস্থান এখনো নেয়নি। তবে সময়ের সঙ্গে এ অবস্থানের বদল হতে পারে। বিষয়টির দিকে কড়া নজর রেখেছে প্রতিটি পক্ষ। পরবর্তী সরকারের চেহারা নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে তারা। বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সম্মতি আদায় করতে হলে এর গত্যন্তরও নেই। কারণ, প্রতিটি পক্ষই রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছে। সে চেষ্টাতেই তারা আলোচনায় বসেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, শান্তি প্রক্রিয়ার শীর্ষ নেতা আবদুল্লাহ আবদুল্লাহসহ কাবুলের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ তালেবান নেতা ইমরান খান মুত্তাকী আলোচনায় বসেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক প্রতিবেদনে।  

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে খোদ আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনা হলেও দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল বলেই দাবি করছেন। গত সোমবার দেওয়া বক্তব্যে বাইডেন বলেন, ‘আফগানিস্তানে দেশ গঠনের কোনো লক্ষ্যই ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের। তবে জঙ্গি হামলা মোকাবিলার যে লক্ষ্য ছিল, সেটি সফল হয়েছে। আল কায়দাকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু বাইডেন যতই এই সিদ্ধান্তকে ‘সঠিক’ বলুন না কেন, বিভিন্ন মহল একে ‘স্বার্থপর সিদ্ধান্ত’ হিসেবেই দেখছে। তারা বলছে, দুই দশকের এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র একবারের জন্যও রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে যায়নি। ফলে যে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সফল হয়েছেন বলে দাবি করছেন, তা আসলে ফাঁকা বুলি। শান্তি ও স্থিতিশীলতার গল্পই ছিল এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের গল্পগুলোর কেন্দ্রে। তা আসেনি। তালেবানও এখন শান্তির কথা বলছে। এটি আসবে কিনা, তার উত্তর নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত