যেভাবে ভারতীয়দের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন মানবহিতৈষী রতন টাটা 

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১৬: ০২

ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত ও মানবদরদি শিল্পপতিদের একজন রতন নাভাল টাটা বা রতন এন টাটা। গতকাল বুধবার তিনি ৮৬ বছর বয়সে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। গত কয়েক দিন ধরেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। 

রতন টাটা ১৯৯১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ২১ বছর টাটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে টাটা গ্রুপের মূলধন ৫০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি ডলারে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টাটা গ্রুপকে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে কেবল শিল্পক্ষেত্রেই নয়, ভারতকে তিনি এগিয়ে নিয়েছেন অন্যভাবেও। দেশে এবং দেশের বাইরে তিনি ‘সবার আগে ভারত এবং ভারতীয়রা’—এই নীতির ব্যাপক প্রচার-প্রসার করেছেন। 

রতন এন টাটা মুম্বাইয়ের একটি পারসি পরিবারে জন্ম নেন ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর। শৈশবেই তাঁর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। এরপর তাঁকে লালনপালন করেন তাঁর দাদি নওয়াজবাই টাটা। রতন টাটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি ও হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন।

পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে রতন টাটা ১৯৬১ সালে টাটা স্টিলে যোগদান করেন। সে সময় তিনি সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গেই অফিস করতেন। দীর্ঘ সময় তিনি সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। আর বিষয়টি তাঁকে মানুষকে বোঝার অসাধারণ দক্ষতা দেয়, যা পরবর্তী সময়ে টাটা গ্রুপের সম্প্রসারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। 

রতন টাটা তাঁর পূর্বসূরি জাহাঙ্গীর রতনজি দাদাভাই টাটা বা জেআরডি টাটার স্থলাভিষিক্ত হন ১৯৯১ সালে। সে সময় ভারতের অন্যতম কনগ্লোরামেট বা শিল্পগোষ্ঠী ছিল টাটা গ্রুপ, যার বার্ষিক আয় ছিল ৫ বিলিয়ন তথা ৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু রতন টাটার মিশনারি নেতৃত্ব টাটাকে ভারতের গণ্ডি থেকে বের করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেয় এবং ২০১২ সাল নাগাদ গ্রুপের বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে। রতন টাটার নেতৃত্বেই টাটা গ্রুপ বিশ্বের শতাধিক দেশে বিভিন্ন ব্যবসায়—স্টিল থেকে শুরু করে মোটরগাড়ি হয়ে আইটি এবং অন্যান্য পণ্য সম্প্রসারণ করে। 

রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ ২০০০ সালে প্রথম কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে। সে বছর টাটা গ্রুপ ৪৫ কোটি ডলারের বিনিময়ে ব্রিটিশ চা কোম্পানি টেটলিকে কিনে নেয়। এর মধ্যে বিশ্ববাজারে ভারতীয় কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। 

এরপর ২০০৭ সালে টাটা গ্রুপ ব্রিটিশ-ডাচ স্টিল উৎপাদনকারী কোম্পানি কোরাস কিনে নেয় ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। পরে এর নামকরণ করা হয় টাটা স্টিল ইউরোপ। এই কোম্পানি কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় টাটা। 

কোরাস কিনে নেওয়ার এক বছর পর টাটা গ্রুপ রতন টাটার নেতৃত্বে আরও একটি দারুণ উদ্যোগ নেয়। এবার প্রতিষ্ঠানটি ব্রিটেনের আইকনিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার কিনে নেয়। ২০০৮ সালে ২৩০ কোটি ডলারের বিনিময়ে টাটা গ্রুপ জাগুয়ারকে অধিগ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে টাটা গ্রুপ বৈশ্বিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। 

জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার কিনে নেওয়ার বছরই (২০০৮ সালে) টাটা গ্রুপ ভারতে ‘টাটা ন্যানো’ গাড়ি নামায়। মূলত টাটার ‘সবার আগে ভারত ও ভারতীয়রা’—এই নীতির প্রতিফলন ছিল এটি। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল মূলত বিশ্বের সবচেয়ে কমদামি গাড়ি উৎপাদন, যার মূল্য ছিল মাত্র ১ লাখ রুপি। তবে এই উদ্যোগ বাণিজ্যিক সফলতার মুখ দেখেনি। 

ব্যবসার বাইরেও সামাজিক পরিমণ্ডলে রতন এন টাটার প্রভাব ছিল। তিনি করপোরেট দুনিয়ায় সামাজিক কল্যাণ ও টেকসই ব্যবস্থা আনয়নের অন্যতম পথিকৃৎ। যেমন, টাটা গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান টাটা সনসের নিয়ন্ত্রণে থাকা টাটা ট্রাস্ট ভারতের অন্যতম শীর্ষ দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়ন এবং টেকসই জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। 

কোভিড-১৯ মহামারির সময় রতন এন টাটা ৫০০ কোটি রুপি দান করেছিলেন। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে তিনি একটি এক্সিকিউটিভ সেন্টার নির্মাণে ৫০ মিলিয়ন ডলার তহবিল যুগিয়েছেন। এ ছাড়া, কলকাতার টাটা মেডিকেল সেন্টার এবং বেশ কিছু শিক্ষামূলক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি দেশের অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের চেষ্টায় অবদান রেখেছেন। 

মুম্বাই ২০০৮ সালের নভেম্বরের ২৬ তারিখে টাটা গ্রুপের মালিকানাধীন হোটেল তাজে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা করার জন্য ‘তাজ পাবলিক সার্ভিস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন রতন এন টাটা। রতন টাটার নম্র ও সাদাসিধে আচরণ তাঁকে ভারত ও ভারতের বাইরে একজন প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করে তুলেছে। অন্যান্য করপোরেট ম্যাগনেটদের বিপরীতে তিনি নিজেকে খুবই সাধারণভাবে উপস্থাপন করতেন। 

রতন এন টাটা ২০২১ সালে দুই বছর ধরে অসুস্থ এক কর্মীকে দেখতে মুম্বাই থেকে পুনেতে গিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর এই উদ্যোগ ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। সমাজ ও অর্থনীতিতে দারুণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ভারত সরকার ২০০০ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ ও ২০০৮ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। 

পোষা প্রাণী ও বেওয়ারিশ প্রাণীর প্রতি রতন এন টাটার ভালোবাসা ছিল। মুম্বাইয়ে অবস্থিত টাটা সনসের বৈশ্বিক হেডকোয়ার্টারে বেওয়ারিশ কুকুরের যত্ন নেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট দলই গঠন করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ১ কোটি অনুসারী আছে। 

তথ্যসূত্র: আউটলুক বিজনেস

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত